পুরনো মানুষগুলোর সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে ঘরানা, কুণাল ঘোষের কলম

কুণাল ঘোষ

ক্ষিতিদা চলে গেলেন।
শ্রদ্ধা, প্রণাম।
এই মানুষগুলোর সঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে একটা যুগ, একটা ঘরানা।
সাংবাদিকতার শুরুর সময় এঁদের সান্নিধ্য পেয়েছিলাম। তাঁদের সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটালেই অনেক কিছু বোঝা হয়ে যেত।
তখন আমরা সব দলের দফতরগুলিতে নিয়মিত যেতাম। সময় দিতাম। মোবাইল দূর অস্ত্, ফোনের উপরও নির্ভর করেছি কম। যেতাম সরাসরি। এবং প্রায় রোজ।

দুপুর শুরু করতাম ফরওয়ার্ড ব্লক অফিস থেকে। বহু ক্ষেত্রেই সঙ্গে বর্ষীয়ান সাংবাদিক কৃত্তিবাস ওঝা, মানে রণেন মুখোপাধ্যায়। ফরওয়ার্ড ব্লক দফতরে একমেবদ্বিতীয়ম্ অশোক ঘোষ। কলকাতায় থাকলে দেবব্রত বিশ্বাস। সিপিআই দফতরে নন্দগোপাল ভট্টাচার্য, গীতা মুখোপাধ্যায়রা। মঞ্জু মজুমদার তখন তুলনায় জুনিয়র। আরএসপির ক্রান্তি প্রেসে মাখন পাল। আর দফতরে নিখিল দাস। ক্ষিতিদা, দেবুদা মন্ত্রী, পার্টি অফিস থেকে আসতেন। বিধানসভায় স্পিকার হাসিম আবদুল হালিম।
এই ঘরানা রাজনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। সাংবাদিকতাকেও সঠিক দিকনির্দেশ করেছেন। অকপটে বুঝিয়ে দিতেন কী ঘটছে, কী হতে পারে। অতীতের গল্প মুগ্ধ করত।

এখন ফাস্ট ফুডের মত ফাস্ট জার্নালিজম। কাজে যোগ দিয়েই ফোন, মেসেজ, ব্রেকিং।
তখন সময় দেওয়া যেত। নেতৃত্বের মানুষগুলোকে চেনার, বোঝার। ফরওয়ার্ড ব্লকের অশোক ঘোষ যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতেন, মনে হত আমরা ছাত্র, শিক্ষকের সামনে বসে। শুধু বাংলা নয়, গোটা দেশের খুঁটিনাটি। আর হালিমসাহেবের ঠোঁটের ডগায় গোটা বিশ্ব।

এঁদের মধ্যে ক্ষিতিদা বিদ্রোহী ইমেজের। মাঝেমধ্যেই বড়শরিক সিপিএমের উল্টোকথা বলে শিরোনাম। কদিন টানাপোড়েন।
তখন এই নেতারা নিজেদের দলের পত্রিকাগুলিকেও কত প্রাসঙ্গিক রাখতেন। লোকমত, গণবার্তা, কালান্তরকে পড়তে হত গুরুত্ব দিয়েই। আত্মসমালোচনার সুর তো ওখান থেকেই শুরু।

সিপিআইএম বড় দল। বাকিরা ছোট শরিক। কিন্তু আমি বরাবর মুগ্ধ হয়ে দেখেছি এই ছোট দলের বড় নেতাদের। জীবনযাত্রা, চিন্তাভাবনা, ব্যক্তিত্ব, কর্মক্ষমতা, এসব অন্য অভিজ্ঞতা। আমি এবং আমার মত আরও কয়েকজন সৌভাগ্যবান, ঐ সময়টা আমরা দেখেছি এবং এই ঘরানার নেতাদের আমরা পেয়েছি। বামপন্থীদের মধ্যে এই তালিকায় এস ইউ সির প্রভাস ঘোষের নামও অবশ্যই রাখব। মনে পড়ছে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে ঝগড়ায় কোণঠাসা হয়ে শেষে একাকি অসুস্থ ফ্ল্যাটবন্দি যতীন চক্রবর্তীর কথা। হাতে কাজ কম থাকলে চলে যেতাম ওখানে। দাপুটে ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা কমল গুহকেও দেখেছি কখনও বামফ্রন্টের দাপুটে মন্ত্রী, কখনও দলছুট বিদ্রোহী নেতা।

কংগ্রেসি বৃত্তেও এমন মনে রাখার মত মানুষ আছেন। গণি খান, সিদ্ধার্থশংকর রায়, প্রণব মুখোপাধ্যায়, অজিত পাঁজাদের নাম ভোলা যাবে না। তবে বাম আর কং, দুটো ঘরানা সম্পূর্ণ আলাদা। শ্রেণিচরিত্রেই তফাৎ। বরং একটা সময়ে বাম নেতাদের দফতর বা চারপাশ আর মমতাদির বৃত্ত, দুটো ছিল একরকম। কংগ্রেসি ঘরানার বদলে মমতাদির বামঘরানাই ছিল বেশি।

ক্ষিতিদার চলে যাওয়ার খবরটা পেয়েই বড্ড পুরনো কথা মনে পড়ছে।
এঁরা সব চলে যাচ্ছেন।
আমরাও পাল্টে গেলাম।
জীবনটা কত কী হারিয়ে ফেলছে।
পুরনো সম্পর্ক, মূল্যবোধ, পদ্ধতি সব শেষ। এখন এক অন্য জগত। অন্য দৌড়। হয়ত ভালো। এগিয়ে যাওয়া। হয়ত খারাপ। শেষের সেদিনের দিকে আত্মঘাতী দৌড়।

প্রথমে হেঁটে, পরে বাসে, একসময় সাইকেলে ঘুরে সাংবাদিকতা করেছি।
তখন, এই ঘরানা, এই মানুষগুলোর স্পর্শ ভিতটা গড়ে দিয়েছিল বলে আজও, এত কিছুর পরেও এখনও দাঁড়িয়ে আছি।

ব্যক্তি ক্ষিতিদার স্মৃতিচারণ করলাম না।
আমি সত্যি পুরো সময় আর মানুষগুলোকে খুব মিস করছি।

আরও পড়ুন-ক্ষিতিদার অনুরোধের কাজ আমাকে সম্পূর্ণ করতেই হবে

 

Previous articleপরীক্ষায় বসতে পারেনি, ‘বিষপানে’ মৃত ছাত্র
Next articleফড়নবিশ পারবেন গদি রাখতে? মরিয়া দিল্লি