ন্যায় বিচার না পেয়েই কি এনকাউন্টারে স্বস্তি? সঞ্জয় সোমের কলম

সঞ্জয় সোম

ধর্ষক আর খুনিদের মধ্যে প্রায়শই একটা প্রভেদ করা হয়, যেন ধর্ষণ অপরাধ হিসেবে খুনের চেয়ে বর্বরতায় একটু কম মাত্রার। আমাদের দেশে তো খুনের ক্ষেত্রেও ঢালাও মৃত্যুদণ্ডের ব্যবস্থা নেই, শুধুমাত্র নৃশংসতার পরাকাষ্ঠা পার করে গেলে, অর্থাৎ ঘটনাটি যদি বিরলের মধ্যেও বিরলতম বলে চিহ্নিত হয়, একমাত্র সে ক্ষেত্রেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়, নচেৎ নয়। ধর্ষণ মানে খুনেরও অধম, একটি নারীর অন্তরাত্মাকে ইচ্ছাকৃতরূপে নৃশংসভাবে হত্যা করা। ধর্ষকের বিকৃতকাম যৌন ক্ষুধা পূরণ করার জন্য অথবা লিঙ্গবৈষম্য থেকে উদ্ভূত পুরুষশ্রেষ্ঠতার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত ধর্ষণ একজন স্বাভাবিক সুস্থ প্রত্যয়ী মানুষকেও মানসিকভাবে সারা জীবনের মতন পঙ্গু করে দিতে পারে। আজকের দিনেও সমাজ একজন প্রাপ্তবয়স্কা ধর্ষিতাকে আর পাঁচজন মেয়ের চেয়ে ভিন্ন চোখে দেখে, যেন তিনিই সাধ করে অপরাধের আবহ তৈরি করে দিয়েছেন। কোনও অপরাধ না করে, নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে অন্যের লালসার শিকার হয়ে, একটি মেয়ে যখন দিনের পর দিন এই অবুঝ সমাজ, এই নির্লিপ্ত প্রশাসন আর এই দীর্ঘসূত্রি বিচারব্যবস্থার সঙ্গে লড়তে লড়তে ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখন সে রোজ নতুন করে মরে। তার ধর্ষক যখন বীরদর্পে বাড়িতে এসে শাসায়, মুখ খুললে তার ছোটবোনটাকেও তুলে নিয়ে গিয়ে একই দশা করবে বলে ধমকি দেয়, আর বাড়ির লোকও যখন লোকলজ্জার ভয়ে তার চরম অবমাননাকে ধামা চাপা দিতে চায়, তখন মেয়েটি কি আশা নিয়ে বাঁচবে বলতে পারেন? এটা খুন নয়? একজন মানুষের মন মেরে দেওয়া কি তার শরীরটাকে মেরে দেওয়ার চেয়ে কোনো অংশে কম অপরাধ? খুন অনেকসময় অনিচ্ছাকৃত হতে পারে কিন্তু ধর্ষণ সমস্ত ক্ষেত্রেই ইচ্ছাকৃত এবং বহুক্ষেত্রেই পূর্বপরিকল্পিত। তাহলে ধর্ষণ সর্বক্ষেত্রে বিরলতম অপরাধ নয় কেন, যার একমাত্র শাস্তি হবে মৃত্যুদন্ড?

আমি মনে করি ধর্ষকদের যে সাজা পাওয়া উচিত, হায়দরাবাদ পুলিশ তাদের ঠিক সেই সাজাই দিয়েছে। এই চার ধর্ষক পালাতে গিয়েছিল, পুলিশ গুলি করেছে, ঘটনাস্থলেই চারজনের মৃত্যু হয়েছে, এখানেই ব্যাপারটা মিটে গেল। আমি এটাকে এনকাউন্টার ইত্যাদি বলতে রাজি নই, অপরাধী পালাতে গেলে পুলিশের যা কর্তব্য, পুলিশ তাই করেছে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন যে এদের অপরাধ প্রমানসাপেক্ষ এবং যতক্ষণ না আদালতে প্রমান হচ্ছে এরাই ধর্ষক, এরা নির্দোষ। বটেই তো। সেই উন্নাও এর সন্দিগ্ধ ধর্ষকও তো নির্দোষ ছিল যাকে সুপ্রিম কোর্ট ক’দিন আগে বেল দিলেন আর সে ছাড়া পেয়েই ফিরে গিয়ে ধর্ষিতাকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে মেরে দিলো। এখন প্রশ্ন হলো, যে বিচারব্যবস্থা বিরলতম অপরাধ বস্তুটি আসলে কি এবং সন্দিগ্ধ ধর্ষকের মতন বিরলতম অপরাধীর সাথে ঠিক কিরকম আইনি আচরণ করা উচিত সেটাই ঠিক করতে পারেন না, তার ওপর সাধারণ মানুষ ভরসা রাখতে পারেন কি? হায়দরাবাদের মানুষও রাখতে পারেননি, দেশের মানুষ তো নয়ই কারণ তাঁরা দেখছেন যে সেই কবেকার নির্ভয়াকাণ্ডের অপরাধীদের এখনো ফাঁসি হয়নি, আরো কত হাজার হাজার ধর্ষনের মামলা সারা দেশ জুড়ে নানান আদালতে ঝুলে রয়েছে, ধর্ষিতারা নীরবে চোখের জল ফেলছেন। স্বাভাবিকভাবেই হায়দরাবাদের পুলিশের গুলিতে এই চার ধর্ষক মারা যাওয়াতে দেশের একদম সাধারণ মানুষ, বিশেষতঃ সারাক্ষন ভয়ে ভয়ে থাকা কন্যাসন্তানের আত্মীয়রা, সমাজের বাপ-মা-ভাই-বোনেরা স্বস্তি অনুভব করছেন। যাঁরা মানবাধিকারের দোহাই দিচ্ছেন, তাঁদের এই সামাজিক স্বস্তির কারণ বুঝতে হবে। ধর্ষকের মানবাধিকার থাকবে আর ধর্ষিতার মানিবাধিকার থাকবে না? তাঁর আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের মানবাধিকার থাকবে না? বিচারব্যবস্থা যদি যথাসময়ে সুবিচার দিতে না পারে, তাহলে মানুষ কোথায় যাবে? এক্ষেত্রে পুলিশ তার কর্তব্য করেছে বলে বাহবা পাচ্ছে। কেউ কি ভেবে দেখেছেন, দেশের সরকার থেকে নিয়ে সভ্য সমাজ, আইনসভা থেকে নিয়ে আইনরক্ষক, অধিকাংশ সময়ই ধর্ষনের ক্ষেত্রে সবাই কেন নিজের নিজের যথাযথ কর্তব্যপালনে ব্যর্থ হন?

এর মধ্যে আমার একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গও আছে। দুর্ভাগ্যক্রমে আমি মেয়ের বাপ নই, যদিও মনে মনে দারুন আশা ছিল যে আমাদের একটি ফুটফুটে মেয়ে হবে, তার নাম রাখবো সুপর্ণা। দ্বিতীয় সন্তানটিও ছেলে হবার পর বোঝা গেল যে এই জন্মে আর মেয়ের বাপ হওয়া ভাগ্যে নেই। এখন ছেলেরা বড় হয়েছে, উন্মুখ হয়ে আছি কবে পুত্রবধূরা ঘরে আসবেন আর আমাদের বাড়িতে সেই অধরা কন্যাদের স্নেহের শাসন কায়েম হবে। মেয়েরা আমার প্রাণের ধন, আমার অপূর্ন সাধ। আর মেয়েরা আমাদের মায়ের জাত তো বটেই। তাই মেয়েদের ওপর অত্যাচার আমার সহ্যের সীমার বাইরে, আমি কিছুতেই মাতৃশক্তির ওপর বর্বরতা মেনে নিতে পারিনা। রাস্তায় অল্পবয়সী মেয়েদের দেখলে আমার মনে হয় ওই বুঝি আমার সেই আদরের সুপর্ণা যাচ্ছে। জোর করে কেউ তার মনটাকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে, তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে যন্ত্রনা দিয়ে দিয়ে তার শরীরের অবমাননা করছে, এসব কল্পনা করলেই আমার মাথায় রক্ত চড়ে যায়। তাই যখন এই ধরণের এনকাউন্টার হয়, সত্যি বলছি, আমারও স্বস্তি হয়। খুব স্বস্তি হয়। আমি চাই দুনিয়ার সমস্ত ধর্ষকের সঙ্গে এমনটাই হোক। ইতরদের সাথে স্বাভাবিক সামাজিক আচরণ করলে আমাদের মায়েদের মানসিক ও শারীরিক হত্যালীলা কিন্তু আটকানো যাবে না। বিরলতম অপরাধীর সাথে বিরলতম দুর্ব্যবহারই যথাযথ।

Previous articleবৃহত্তম ঝুলন্ত ফুটব্রিজ তৈরি হতে চলেছে কলকাতায়
Next articleতোমায় আমায় মিলে