সিনেমার ছায়া থেকে বেরিয়ে মঞ্চ মাতালো ‘দাদার কীর্তি’, কুণাল ঘোষের কলম

কুণাল ঘোষ

সিনেমাগুলিকে নাটকে মঞ্চস্থ করা যদি লক্ষ্য হয়, তাহলে বলতেই হবে, বুকের পাটা আছে। তার উপর সেই সিনেমা যদি হয় জনপ্রিয়, যার দৃশ্য ও চরিত্রগুলি দর্শকদের কাছে বিশেষ পরিচিত, তাহলে কাজটা নিঃসন্দেহে আরও কঠিন।

আর এই কঠিন কাজটা যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে করে দেখালো নৈহাটি ব্রাত্যজনের “দাদার কীর্তি”। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যানভাসে তরুণ মজুমদার যে অপরূপ ছবিটি এঁকে রেখেছেন; দর্শকদের স্মৃতিতে তা উজ্জ্বল থাকলেও নিজস্ব সাবলীলতায় একশোয় একশো তুলে নিয়ে গেল এই রোমান্টিক মিউজিকাল কমেডি।

চেনা গল্প। চেনা চরিত্র। অচেনা উপস্থাপনা। নতুন একঝাঁক মুখ। নতুন ফর্মুলা। অথচ স্বাদ অটুট। পরিচালক অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়,” তরুণবাবুর গল্পবিন্যাস রেখেই নতুনত্ব। কোনো সিন-কাট নয়। মঞ্চে সবসময়ই কিছু না কিছু হবে। আর থাকবে প্রচুর নাচগান; লক্ষ্য দর্শকদের চূড়ান্ত নস্টালজিয়ায় পৌঁছে দেওয়া।” ব্রাত্য বসুর জাদুস্পর্শ আর পার্থ ভৌমিকের যোগ্য অভিভাবকত্বে পরিচালক গোটা ভাবনাটা রূপায়ণে সফল।

সবচেয়ে বড় কথা, দর্শকের চেনা লেগেছে সব। অবচেতনে তুলনা আসবেই। কিন্তু বাজি রেখে বলতে পারি, উপস্থাপনা ও অভিনয়ের গুণে কখনও পর্দার পরিচিত চরিত্রকে কেউ মিস্ করেন নি। বরং বুধবার সন্ধের অ্যাকাডেমি মঞ্চ বারবার করতালিতে বুঝিয়েছে, ভালো লাগছে।

পরীক্ষায় ব্যর্থ বোকাসোকা কেদারকে মধুপুরে কাকার বাড়ি পাঠানো হয়েছে। খুড়তুতোভাই সন্তু। সন্তুর বান্ধবী বীণা। বীণার দিদি ভয়ানক রাশভারি সরস্বতী। পাড়ার ছন্দবাণী ক্লাবের দলবল আর তাদের কেন্দ্রে ভোম্বলদা। চেনা গল্প, চেনা চরিত্র সময়োপযোগী হয়েছে মোবাইল, হোয়াটঅ্যাপ, ফেসবুকের ব্যবহারে কিংবা লাফিং ক্লাব বা চিট ফান্ডের উল্লেখে। সবটাই মানানসই। জমজমাট। গানের ব্যবহার দারুণ। কেদার আর সরস্বতীর রসায়ন সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক।

টিমওয়ার্ক অপূর্ব, তবু,’ম্যান অফ দি শো’ যদি বাছতে হয়, তাহলে ভোম্বল ভট্টাচার্যর ভূমিকায় প্রসেনজিৎ বর্ধন। অনুপকুমারকে এক বিন্দু ছোট না করেও টেবিল চাপড়ে বলা যায়, মঞ্চে অমন তুখোড় অভিনেতার ছায়াতে তিনি এতটুকু ঢাকা পড়েন নি। অনুপকুমারকে মিস্ করতে দেন নি এক মুহূর্তের জন্যেও।

কেদার, সরস্বতী ও অন্যান্য চরিত্রে দেবরাজ ভট্টাচার্য, শ্রীজিতা ঘোষ, ঋক দেব, সায়নী ঘোষসহ প্রতিটি মুখই দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। দেবরাজ আজকের কেদারের চরিত্রে যথাযথ বাছাই। বৌদির ভূমিকায় দেবযানী সিংহর কথা একটু আলাদাভাবে বলব। ‘দেবদাস’-এ চন্দ্রমুখীর চরিত্রেও দেখলাম। মঞ্চটা ব্যবহার করে দর্শক আকর্ষণের ক্ষমতা ভালো। বহুমুখী চরিত্রের জন্য প্রস্তুত লম্বা দৌড়ের ঘোড়া। সরস্বতী, বীণাদের বাবার চরিত্রে পার্থ ভৌমিক। অনায়াস, সাবলীল অভিনয়।

আবার বলছি, এই গোটা টিমটার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব তরুণবাবুর তারকাখচিত সিনেমাটি থেকে দর্শকের মন সরিয়ে সমান্তরাল ভালোলাগার অনুভূতি উপহার দেওয়া। তাপস, মহুয়া, দেবশ্রী, অনুপকুমার, কালী ব্যানার্জি, সন্ধ্যা রায়- এঁদের ছায়া থেকে চরিত্রগুলোকে বার করে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেছে নৈহাটি ব্রাত্যজন। পুরো টিম, মানে অতনু,সুরজিৎ, সুমিতা, রূপা,নিবেদিতা, পার্থপ্রতিম, সুশান্ত, সায়ন্তন, সৃজনী, অরণ্য, অঞ্জন, প্রত্যুষসহ বাকি সকলেই এই টিমের সাফল্যের সমান অংশীদার। মঞ্চ, আলো, আবহ যথাযথ। কোরিওগ্রাফিতে আবার সেই প্রসেনজিৎ বর্ধনের প্রশংসা করতে হয়। আর মঞ্চের বৈচিত্রপূর্ণ ব্যবহার আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে।

আবহ ও কন্ঠসঙ্গীত গোটা নাটককে নতুন উচ্চতা দিয়েছে। গানে সমাদৃতা, নূতন, প্রসেনজিৎ, দেবরাজের সঙ্গে চমক দেবশ্রী রায়। সিনেমার আসল বীণার কন্ঠে ” বয়েই গেছে।” প্রযোজনা নিয়ন্ত্রণ জিতব্রত পালিত। মূল সিনেমার জোরদার গানের দিকটা মঞ্চেও অটুট।

অন্ত্রপ্রণর তথা নৈহাটি ব্রাত্যজনের কর্ণধার পার্থ ভৌমিকের কথায়,” নৈহাটির প্রতিভাদের নিয়ে এই গ্রুপ। তারপর ব্রাত্যর সঙ্গে কথা। ঠিক হয়, সিনেমাগুলি থেকেই নাটক হবে। সেইমত আমরা করেছি ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ও আলহান্দো ইনারিতুর সিনেমা থেকে ‘একুশে গ্রাম।’ এবার তরুণ মজুমদারের ছবি থেকে এই ‘দাদার কীর্তি’। আজকের দুনিয়ায় যে সামাজিক অবস্থান, বন্ধুত্ব, সম্পর্ক, প্রেম নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তা ফিরিয়ে আনার তাগিদে এই নাটক, যা পুরোনো স্মৃতিকে রোমাঞ্চিত করবে।”

নৈহাটি ব্রাত্যজনের “দাদার কীর্তি” এই সব দিক থেকেই পুরোমাত্রায় সফল। এমন প্রোডাকশন বাংলা নাটককে সমৃদ্ধ করবে এবং আরও বেশি দর্শককে টেনে আনবে, এটা নিশ্চিত।

পুনশ্চ: ব্রাত্য বসু মন্ত্রী, বিধায়ক হয়েও নাটকের পূজারি। আর নৈহাটির দক্ষ বিধায়ক পার্থ ভৌমিক নৈহাটি ব্রাত্যজনের দরদী কর্ণধার ও অভিনেতা। রাজনীতি, সমাজের অন্য দায়িত্ব সেরেও যাঁরা প্রাণের টানে এমন সুস্থ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, বোধহয় এমন কিছু মানুষের জন্যেই অতি অন্ধকারেও একটা রূপোলি রেখা আশার আলো দেখাতেই থাকে।

Previous articleসাতসকালে বেলাইন ট্রেনের ৮টি কামরা, তারপর যা হল
Next articleCAA: 26শে হবে বাম-কংগ্রেস ধরনা, গ্রামে 5 হাজার সভার লক্ষ্য সিপিএমের