বইমেলায় বইচুরি ? একটা শুধু শর্ত আছে

অপু দে

[ দেশের পাঁচটি বৃহত্তম বাংলা গ্রন্থ প্রকাশনার একটি দে’জ পাবলিশিং-এর কর্ণধার সুধাংশুরঞ্জন দে’র সুযোগ্য পুত্র৷ ইতিমধ্যেই গ্রন্থ প্রকাশনার জগতে বিশিষ্ট স্থান অর্জন করে ফেলেছেন অপু৷
কলকাতা বইমেলার প্রাক্কালে তাঁর মজার অভিজ্ঞতার কথাই বলেছেন ]

বইমেলায় বইচুরি ? মোস্ট ওয়েলকাম ।

শুধু একটা ছোট্ট শর্ত আছে । যদি বই চুরি করতে গিয়ে চোর ধরা পড়ে , তাকে বইচুরির ওপর নির্ভুল বাংলা বা ইংরেজিতে একপাতার আর্টিকেল লিখতে হবে । কেন সে বই চুরি করে , এ-ব্যাপারে স্পষ্টভাবে তার নিজের বক্তব্য জানাতে হবে । তা হলেই সাতখুন মাফ । আর্টিকেল লেখো , জমা দাও , চুরির বই বগলদাবা করে বাড়ি চলে যাও । খেল খতম , পয়সা হজম ।

বইচোরদের শায়েস্তা করতে কয়েক বছর আগে ‘পাবলিশার্স অ্যান্ড বুক সেলার্স গিল্ড ‘ – এর তরফে এমনই একটা নিয়ম করা হয়েছিল । এবং প্রকাশক হিসেবে এই মজার নিয়মটাকে আমি সর্বান্তঃকরণে সমর্থন করেছিলাম । সব দিক থেকেই এটা বেশ ভালো বন্দোবস্ত বলে মনে হয়েছিল আমার । বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে , আহা! কর্তৃপক্ষ কত সহৃদয় পদক্ষেপই না নিয়েছে , কোনও হুজ্জুতি নেই , অথচ ভেতরে ভেতরে ব্যাপারটার মধ্যে পুরোদস্তুর ভয়ের আবহাওয়া গমগম করছে৷ অনেকটা পরীক্ষায় ফেল করার মতো । আর্টিকেল লেখার এই আচমকা চ্যালেঞ্জ উতরাতে না পারলে জনসমক্ষে আত্মসম্মান নিয়ে টানাটানির সম্ভাবনাও উজ্জ্বল । ভেবেছিলাম , এই নিয়ম প্রতি বছর বইমেলাতেই প্রযোজ্য হবে৷ সেই মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি ।

◾◾

অনেক বইচোর দেখেছি । অনেক বইচোরকেই বামাল-সহ ধরেছি । হিসেব করলে, এখনও পর্যন্ত , হাফ-সেঞ্চুরি নিঃসন্দেহে হয়ে গিয়েছে । মনে আছে, জীবনের প্রথম বইচোর-কে পাকড়েছিলাম কলকাতা বইমেলায়, আমাদের দে’জ পাবলিশিং-এর স্টলে। তখন আমার বয়স তেরো-চোদ্দো হবে।
খুব ছোটোবেলা থেকেই আমি বইমেলার স্টলে বসতাম৷ প্রথম-প্রথম আমার কাজ ছিল ক্যাশ মেমোতে ডেলিভারি স্ট্যাম্প মারা৷ আস্তে আস্তে অন্য পোস্টে প্রোমোশন হয় । বইমেলায় আমাদের স্টলে কোথায় কী বই রাখা আছে সে-সব আমার মুখস্থ থাকত । লেখকের নাম বা বইয়ের নাম শোনামাত্রই বলে দিতে পারতাম স্টলের কোন দিকে সেই বইটা সাজানো রয়েছে । লোকজন আশ্চর্য হয়ে যেত । অনেকে আবার বিশ্বাসই করত না যে , এতটুকু একটা ছেলে স্টলে বসতে পারে । কেউ কেউ ভাবত , আমি বুঝি কোনও অভিভাবকের সঙ্গে দে’জ- এর স্টলে বই দেখতে বা কিনতে এসেছি । বইচোরদের এই অনভিজ্ঞতা , এই দুর্বলতার জায়গাটাই আমি কাজে লাগাতাম । আমি যে ‘ওয়াচম্যান’ এই সন্দেহটা তারা করত না । তাছাড়া , আমার ভেতরে কেমন একটা ‘ইনস্টিংকট’ কাজ করত । যাকে দেখে একবার সন্দেহ হত এই লোকটা বই চুরি করতে পারে , তার পিছু ছাড়তাম না । অলক্ষ্যে নজর রেখেই চলতাম এবং ঘটনাচক্রে দেখা যেত সেই লোকটা সত্যিই বইচোর ।

তো , এমনই সন্দেহের বশে সেবার দুটো ছেলেকে অনেকক্ষণ ধরে ‘ফলো’ করছি । তাদের বয়স আমার চেয়ে সামান্য বেশি৷ স্টলের এখানে – ওখানে গিয়ে তারা নানারকম বই উল্টেপাল্টে দেখছে । নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে । একসময় একজন টুক করে একটা বই তার ঝোলায় ভরে নিল । যদ্দূর খেয়াল হচ্ছে , বইটা ছিল গায়ক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের গান নিয়ে লেখা । অ্যাডভেঞ্চারের উত্তেজনায় ছেলে দুটো খেয়াল করেনি , আমি ওদের ঠিক পিছনে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছি । অপারেশন সেরে তারা যেই না স্টলের অন্যদিকে যাবে , আমি শান্ত করে বললাম, দাদা , বইটা ফেরত দিন । ওরা তো ঘাবড়ে গিয়েছে৷ একজন তোতলাতে – তোতলাতে বলল , কোন বই ?
আমি আরও ঠান্ডা গলায় বললাম , যে বইটা এক্ষুনি ঝোলায় ভরেছেন ।
এরপর বেচারা আর কী করে ! কাঁচুমাচু মুখে বইটা বের করে দিল । আমি বইটা নিয়ে সোজা ক্যাশ মেমো করতে দিয়ে দিলাম৷ এটা একটা অলিখিত নিয়ম । বই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে বইটা আপনাকে কিনতে হবে । পরে , এই নিয়মটাকে আমি আরেকটু কড়া করেছি । এখন বই চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লে আপনাকে বই তো কিনতেই হবে , উপরন্তু কোনও ডিসকাউন্ট পাবেন না । যাই হোক , ক্যাশ মেমো করতে দেওয়া ছাড়া আমি কিন্তু সেবার বাড়তি কোনও হইচই করিনি । পাঁচজনকে জড়ো করে সালিশি বসাইনি । একবারও জিগ্যেস করিনি – ভাই , কেন বই চুরি করলে ? আমার আচরণে চোর ছেলেটাও হয়তো একটু অবাক হয়েছিল । টাকা পেমেন্ট করে বই নিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে আলতো ভঙ্গিতে বলেছিল, সরি , এই লাইনে প্রথমবার তো , তাই !
আজও মাঝে – মাঝে কথাটা মনে পড়ে ।
আরেকবার একজন ধোপদুরস্ত প্রৌঢ়কে ধরার পর যেই না বলতে যাব বইটা আপনাকে কিনতে হবে কিন্তু আমি কিছু বলার আগেই তিনি বলেছিলেন ‘ বইটা চট করে বিল করে দিন তো ! ‘ বিল মিটিয়ে তিনি হুড়মুড়িয়ে স্টল থেকে বেরিয়ে যান । স্মৃতি যদি বিশ্বাসঘাতকতা না করে , সেবারের বইমেলায় ওই ভদ্রলোককে আর আমাদের স্টলে দেখিনি ।

◾◾

প্রতি বছর বইমেলাতে যখন বই নিয়ে যাই , মেনে নিই যে , যত টাকার বই নিয়ে যাচ্ছি তার এক – দু ‘ পার্সেন্ট ক্ষতি হবেই । মানে , কিছু বই চুরি যাবে৷ শতচেষ্টা করেও আটকাতে পারব না । আমি কেন , সব প্রকাশকই এই হিসেবটা মাথায় রাখেন । কিন্তু এরকম মানসিক প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও একবার মেজাজ সংবরণ করতে পারিনি । রাগে – হতাশায় বইচোরের গায়ে হাত তুলেছিলাম , যা আমার স্বভাববিরুদ্ধ ।
সে-বছর , পরে হিসেব করে দেখেছি , আমাদের স্টল থেকে প্রায় ৩০ হাজার বই চুরি গিয়েছিল৷ এবং চুরির ঘটনাটা ধরা পড়ে বইমেলার শেষদিন , তাও মেলা শেষ হওয়ার ঘণ্টা চার – পাঁচেক আগে ।
একটি ছেলে একক প্রচেষ্টায় এই দুঃসাহসিক কাণ্ড ঘটিয়েছিল ।
তার চুরির টেকনিক এত বুদ্ধিদীপ্ত , প্রশংসা না করে পারা যায় না ।
ভিড়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে , বইমেলাতে সাধারণত একাধিক কাউন্টার খোলা হয় । স্টল থেকে বই কিনলে , সংলগ্ন কাউন্টারের স্টাফ সঙ্গে সঙ্গে ক্যাশ মেমো করে দেবে । সেই ক্যাশ মেমো থাকবে আপনার কাছে , আর বই চলে আসবে মূল কাউন্টারে ।
এবার যখন আপনি মূল কাউন্টারে আসবেন , তখন ক্যাশমেমো অনুযায়ী আপনার থেকে টাকা নেওয়া হবে এবং পাশের ডেলিভারি কাউন্টার থেকে আপনার কেনা বই আপনাকে বুঝিয়ে প্যাক করে দেওয়া হবে । এই চোর-ছেলেটা করত কী, ‘In’ লেখা দরজা দিয়ে স্টলে ঢুকে র‍্যান্ডম বই কিনত । আমাদের টেম্পোরারি কাউন্টারের স্টাফ সেইসব বইয়ের বিল করে দিত । বই চলে আসত মূল কাউন্টারে । ক্যাশ মেমো থাকত ছেলেটার হাতে । কিন্তু ছেলেটা ক্যাশ মেমো নিয়ে ক্যাশ কাউন্টারে আসত না । ও ক্যাশ মেমোগুলো পকেটে ভরে ‘Out’ লেখা দরজা দিয়ে সোজা স্টলের বাইরে চলে যেত । ‘Out’ গেটে যে রক্ষী আছে , সে তাকে আটকাতো না । কারণ ছেলেটার কাছে তো কোনও বই নেই । পকেটে ক্যাশমেমো রয়েছে , কিন্তু পকেট সার্চ করার প্রশ্ন আসে না । এভাবে , একবার বাইরে যেতে পারলেই কেল্লা ফতে ।

কীরকম ?

না, বাইরে গিয়ে ছেলেটা ক্যাশমেমোগুলোর ওপর দে’জ – এর নিজস্ব ‘Paid ‘ লেখা রবার স্ট্যাম্পের ছাপ মেরে নিত । কী করে জানি না আমাদের দোকানের হুবহু ‘Paid ‘ স্ট্যাম্প ও জোগাড় করেছিল । তারপর ‘Paid ‘ স্ট্যাম্প মেরে , ক্যাশমেমোগুলো পকেটে ভরে সে ‘ In ’ গেট দিয়ে ফের আমাদের স্টলে ঢুকত এবং সোজাসুজি ডেলিভারি স্টলে গিয়ে বই চাইত । আমরা ‘Paid ‘ লেখা ক্যাশমেমো মিলিয়ে ওকে বই দিয়ে দিতাম । সংশয়ের অবকাশ কোথায়! এই ফন্দি করে ছেলেটা আমাদের প্রায় পথে বসিয়েছিল । রাতে হিসেব মেলাতে গিয়ে আমরা জেরবার । দেখছি যত টাকার বই বিক্রি হয়েছে , সেই পরিমাণ ক্যাশ আমাদের হাতে জমা পড়েনি । অথচ নিয়মে কোনও গরমিল নেই । কী করে হচ্ছে তবে চুরি ?

যদি ছেলেটা আরেকটু মাথা ঠান্ডা রাখতে পারতো , আমরা হয়তো এত বড় জোচ্চুরিটা কোনওদিন ধরতেই পারতাম না । এখানে বলে রাখি , ছেলেটা কিন্তু কোনও দিগগজ পড়ুয়া বা অর্থাভাব-পীড়িত বইপ্রেমী নয় । সে একজন সাদামাটা চোর । যে কোনও বই চুরি করে চোরাবাজারে বেচতে পারাটাই ওর চৌর্যবৃত্তির লক্ষ্য । বই ডেলিভারি নেওয়ার সময় ও প্রতিদিন একসঙ্গে পাঁচ-ছ ‘ টা করে ক্যাশ মেমো নিয়ে আসতো ৷ প্রত্যেকটা ক্যাশমেমোতে আবার সাত – আটখানা করে বই । উদ্দেশ্য সহজ । একদানে যতগুলো সম্ভব বই হাতিয়ে নেওয়া । কিন্তু একসঙ্গে অনেকগুলো ক্যাশমেমো যখন থাকে , তখন সব দোকানেই গ্র্যান্ড টোটাল-টা প্রথম পাতায় যোগ করে দেওয়া হয় ।
সেবার বই ডেলিভারি দেওয়ার সময় আমাদের স্টাফ হঠাৎ দ্যাখে যে, একাধিক ক্যাশমেমো থাকা সত্ত্বেও গ্র্যান্ড টোটাল-টা প্রথম ক্যাশমেমোতে যোগ করে দেওয়া হয়নি । কী ব্যাপার ! এমন হওয়ার তো কথা নয় ! তার মনে সন্দেহ হয় । ছেলেটাকে জিগ্যেস করে, ‘ দাদা , আপনি যেন কত টাকা দিয়েছেন ? ’ দেখা গেল , ছেলেটা যে উত্তর দিচ্ছে , তার সঙ্গে গ্র্যান্ড টোটাল মিলছে না । মানে গ্র্যান্ড টোটাল যদি বারোশো হয় , ছেলেটা বলেছে, আমি হাজার টাকা দিয়েছি । কখনও বলছে , পনেরোশো দিয়েছি । অর্থাৎ একেক বার একেক রকম কথা । সেটাই স্বাভাবিক । বইমেলা আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে, এই সময় একজন চোর কোমর বেঁধে বইচুরি করবে , না ক্যাশ মেমো-তে গ্র্যান্ড টোটালের হিসেব করবে ! ছেলেটার অসংলগ্ন কথাবার্তা শুনে আমাদের সন্দেহ বদ্ধমূল হয় । সবাই মিলে ভালমতো জেরা করতেই চুরির ব্যাপারটা ধরা পড়ে গেল । ওকে যখন হাত মুচড়ে গিল্ডে এর অফিসে নিয়ে যাচ্ছি , তখন ছেলেটা চেষ্টা করেছিল চুপিসাড়ে জামার ভেতর থেকে নকল রবার স্ট্যাম্প ফেলে দিতে, পারেনি । দিতে পারলে ওর ধারাবাহিক কুকীর্তি প্রমাণ করা কঠিন হত । ছেলেটাকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম । কয়েকদিন শ্রীঘরেও ছিলো৷ কিন্তু টাকার গচ্চাটা আমাদের মেনে নিতে হয় । এরকম গেরোয় যাতে আর না পড়ি সেজন্য বইমেলাতে এখন নতুন নিয়ম চালু করেছি । ‘Paid ’ লেখা নকল রবার স্ট্যাম্প দিয়ে এবার আমাদের ঠকানো মুশকিল ।

◾◾

মাস দুয়েক আগের ঘটনা৷ কলেজ পড়ুয়া দুজন বইচোর ধরেছি৷ থুড়ি ধরেছিলাম আসলে একজনকে ! যে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে । জেরার মুখে সে স্বীকার করল , তার সঙ্গীও একটা বই চুরি করেছে । কোথায় সেই সঙ্গী ? বােঝা গেল , হাওয়া গরম দেখে সে পিঠটান দিয়েছে । ঝগড়াঝাটি না করেও এই ধরনের পরিস্থিতি কী করে সামলাতে হয় , এতদিনে সেই অভিজ্ঞতা হয়ে গিয়েছে । ঠান্ডা মাথায় ছেলেটাকে বললাম , তোমাকে বইটা কিনতে হবে । সে বলল , টাকা নেই । এটাই যে বলবে , জানতাম। ওকে এবার বললাম , তা হলে বন্ধুকে ডাকো । দ্যাখো , দুজনে মিলে যদি কেনা সম্ভব হয় । ফার্স্ট ইয়ারের বইচোর ফোন করে তার বন্ধুকে ডাকল । বন্ধুটি তুলনায় বড় , থার্ড ইয়ারে পড়ে । অভিজ্ঞতাতেও কিঞ্চিৎ সমৃদ্ধ । সে প্রথমেই আমার সঙ্গে তর্ক জুড়ল । তার প্রতিপাদ্য সে বই চুরি করেনি । তখন আমি প্রয়োগ করলাম ব্রহ্মাস্ত্র । বললাম , হতে পারে । হয়তো তুমিই ঠিক বলছ । কিন্তু তুমি যদি ঠিক বলো , তা হলে তোমার বন্ধু ভুল বলছে । মানে , ও নিজে ফেঁসেছে বলে তোমাকেও কেস খাওয়ানোর চেষ্টা করছে । আর যদি তোমার বন্ধু ঠিক বলে , তবে তুমি মিথ্যে বলছ । ভাল করে ভেবে দ্যাখো , তোমাদের মধ্যে কে ঠিক বলছে । ভেবেছিলাম , ওরা নিজেদের মধ্যে কাজিয়া শুরু করবে । কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ করলাম , এরকম কঠিন পরিস্থিতিতেও ছেলে দুটির পারস্পরিক নির্ভরতা টোল খেল না । ওরা সত্যিকারের ভাল বন্ধু । কেউই চায় না , তার জন্য বন্ধুর অসম্মান হয় ।

শেষে থার্ড ইয়ারের ছেলেটি স্বীকার করল যে , সে বই চুরি করেছে । বইটা বনসাই চর্চা সংক্রান্ত । কেন চুরি করেছ ? উত্তরে জানাল , এই বইটা সে বাবাকে উপহার দেওয়ার জন্য চুরি করেছিল । পকেটে যথেষ্ট টাকা থাকলে চুরি করত না , কিনেই বাবাকে দিত ।
সব জেনে , সব শুনে আমি সেদিন একটু আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম । আজ আমাদের প্রকাশনা যে – স্তরে উন্নীত হয়েছে , আমাদের ব্যবসার পরিধি যত দূর সম্প্রসারিত হয়েছে — সেই সাফল্য | কিন্তু একদিনে আসেনি । এর পিছনে লুকিয়ে রয়েছে কঠিন আর্থিক যুদ্ধ , হার – না – মানা জেদ এবং সদিচ্ছা । আমি সেই ইতিহাস জানি । ‘পকেটে টাকা থাকলে বনসাই – এর বইটা কিনেই বাবাকে দিতাম ’ এটা শোনার পর আমি ছেলে দু ‘টোকে প্রতিশ্রুতি দিই যে , ভবিষ্যতে কোনও বই পড়তে বা কিনতে হলে তারা যেন চুরির পথে না হাঁটে । যেন আমাকে এসে একবার বলে । ওদের ইচ্ছে কতটা মেটাতে পারব জানি না , তবে একটা চেষ্টা করে দেখব ।
বই চুরি করে ধরা পড়েও , ছেলে দু ’ টো সেদিন হাসতে হাসতে ফিরে গিয়েছিল ।
ওদের স্বপ্নময় মুখ আমি অনেকদিন ভুলতে পারব না ।

◾◾

কেন লোকজন বই চুরি করে ?
কারণটা আমার কাছে আজও স্পষ্ট নয় । হয়তো মজা পায় বলে , হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে বাজি লড়েছিল বলে , হয়তো সত্যিই টাকা ছিল না কিন্তু বইটার দরকার ছিল । হয়তো , এটা একটা মানসিক নেশা । জানি না সত্যি কী জন্য বইচোর বই চুরি করে । তবে অন্যান্য চুরির থেকে বই চুরির একটা আলাদা মর্যাদা রয়েছে । চোরকে ধরতে পারলে প্রথমে রাগ হয় । পরে , সেই রাগ পড়েও যায় ।
একবার যেমন , একজন বন্ধুর মারফত একটা ছেলের সঙ্গে আলাপ হল । কিছুক্ষণ কথা বলার পর নতুন | ছেলেটি জানাল তোর দোকান থেকে কত বই যে ঝেড়েছি তুই জানিস না ! চুরির কথা স্বয়ং মালিককে কেউ যে এমন বুক বাজিয়ে বলতে পারে , এমন ধারণা ছিল না । শুনে প্রথমে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম । অথচ ছেলেটার ওপর রাগ করতে পারিনি । দিব্যি হাসি – ঠাট্টা করে বাকিটা সময় কাটিয়েছিলাম । | কেন রাগ করতে পারিনি ? শক্ত – শক্ত দু ‘ চার কথা কেন সেদিন বলতে পারিনি ? বহুবার নিজের মনে – মনে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি । শেষে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে — তুমি যত বড় ব্যাসটম্যান – ই হও , শূন্য রানে তোমাকেও একদিন আউট হতে হবে । আমি হয়তো বইচোর ধরার ম্যাচে হাফ – সেঞ্চুরি করেছি , কিন্তু এমনও তো দিন গিয়েছে যেদিন একটাও রান পাইনি , আমার উপস্থিতিতে আমার দোকান বা স্টল থেকে বইচোর কাজ সেরে সটকে পড়েছে ।
এটাই আমাদের জীবন , আমাদের বেঁচে থাকা । এখন , নিজের বেঁচে থাকার ওপর কত আর রাগ করা যায় ।

Previous articleআলেজান্দ্রোর  জার্সি নিয়ে অভিনব সেলিব্রেশন লাল-হলুদের
Next articleহাড়োয়ার স্কুলে সরস্বতী পুজোর অনুমতি দিতে হবে ,কুণাল ঘোষের কলম।