বৃহস্পতিবারের বইমেলা। বই কেনা, উদ্বোধন, বৃষ্টি, খাওয়া, গলা ছেড়ে গান, বহু পরিচিতের সঙ্গে দেখা, এসব তো ছিলই। কিন্তু দু’টি জিনিস চোখ টানল। বইমেলাকে নিয়ে যা কিছু বলার জায়গা তৈরি করে দিল।

গিয়েছিলাম আমরা। অগ্রজ সাংবাদিক কুণাল ঘোষ, ভাতৃস্থানীয় পার্থ, অনির্বাণ এবং শঙ্করদা। মেলায় দেখলাম সিএএ-এনআরসি- এনপিআর বিরোধী সভা। মানব বন্ধন। স্লোগান। নিজের মনেই প্রশ্ন, হঠাৎ বইমেলায় কেন প্রতিবাদ? রাস্তার প্রতিবাদ উঠে আসবে কেন বইমালায়! যে প্রতিবাদের জন্য রয়েছে রাজপথ, ডোরিনা ক্রসিং, রানি রাসমনি রোড, এমনকী গোটা কলকাতা, তা কেন বইমেলায়! বইমেলার সঙ্গে কী আদৌ তা মানানসই? এ প্রতিবাদ তো আরও এক প্রশ্ন তুলে দিয়ে যেতে বাধ্য… আজ হচ্ছে নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদে। কাল যদি তার স্বপক্ষে কোনও মানববন্ধন হয়, তা করতে দেওয়া হবে তো!

আর এ নিয়ে দু’চার কথার মাঝ মধ্যিখানে কথা বলতে বলতে কুণালদার এক পরিচিত হঠাৎ হাত ধরে নিয়ে গেলেন তাঁর স্টলে। ইনফরমেশন অ্যান্ড অ্যাকশন ফর পিপলস রাইট। সৌজন্যে অমিতাভ চৌধুরী। এ রাজ্যে তথ্য জানার অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ। স্টলে নয়, নিয়ে গেলেন স্টলের পিছনে। সেখানে গান্ধী মূর্তিতে মালা দেওয়ার পর তিনি এলেন আসল তথ্যে। সামনে টাঙানো ব্যানার। সেখানেই রয়েছে আসল রহস্য। তিনিও নয়া নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রতিবাদে এক তালিকা তৈরি করেছেন। যেখানে বইমেলার দিনগুলিই তাঁর উপজীব্য বিষয়। অর্থাৎ ২৯জানুয়ারি থেকে ৯ফেব্রুয়ারি। এই এক ডজন দিন। কী রয়েছে সেখানে? অমিতাভবাবু যখন বোঝাচ্ছেন, ভিড় জমে গিয়েছে চারপাশে। বললেন যাঁরা বলছেন বা ভাবছেন দেশটা স্বাধীন হয়েছে শুধু এক সম্প্রদায়ের হাত ধরে, তাদের মুখে জোর থাপ্পড় এই তালিকা। বইমেলার শুরুর দিন থেকে যে তালিকা তৈরি হয়েছে… ২৯ জানুয়ারি নবাব ফাজিল মহম্মদ খানের ফাঁসি। ৩০জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকাণ্ড। ৩১জানুয়ারি মানিক আয়াশিটকে পুলিশি হেফাজতে অত্যাচার করে খুন। ১ফেব্রুয়ারি আমান আলি সাবে রোহিল্লার ফাঁসি। ২ফেব্রুয়ারি রানি চেন্নামানার জেলে মৃত্যু। ৩ফেব্রুয়ারি ভবানীপ্রসাদ ভট্টাচার্যর ফাঁসি। ৪ফেব্রুয়ারি চৌরিচোরার হত্যাকাণ্ড। ৫ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম অস্ত্রলুণ্ঠনকারীদের আশ্রয় দেওয়ায় পুলিশের অত্যাচারে মৃত্যু হিমাংশুমোহন বোসের। ৬ফেব্রুয়ারি মোতিলাল নেহরুর মৃত্যু। ৭ফেব্রুয়ারি শিবাজি স্বামী আয়ার, বিখ্যাত আইনজীবীর জন্ম। যিনি লড়েছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীদের হয়ে। ৮ফেব্রুয়ারি বন্দি করে শের আলিকে পাঠানো হলো আন্দামানের সেলুলার জেলে। সেখানে গিয়ে তিনি ভাইসরয় লর্ড মেয়োকে খুন করলেন এই দিনে। ৯ফেব্রুয়ারি বার্মায় নেতাজির আইএনএ সেনার হয়ে লড়াইয়ে নেমে বার্মায় ব্রিটিশ সেনার হাতে মৃত্যু হল কিষাণ দাসের।

অমিতাভবাবুর স্পষ্ট কথা, যাঁরা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনে জাতি-ধর্মের ভিত্তি তৈরি করছেন, তাঁদের কাছে এই ১২ দিনের ইতিহাস আসলে সপাটে চড়। দেশটা স্বাধীন হয়েছিল হিন্দু-মুসলিম-শিখ-ইশাহিদের কাঁধে কাঁধ দিয়ে লড়াইয়ের মধ্যে দিয়ে। তাহলে নাগরিকত্ব দেওয়ার সময়ে মুসলিমদের জন্য রয়েছে অন্য দেশ, এ প্রশ্ন কেন আসবে?এ তো শুধু বইমেলার ১২দিনের ইতিহাস তুলে ধরেছি। ৩৬৫ দিনের হিসাব লিখতে বসলে উপন্যাস হয়ে যাবে।

একদিকে সরব, দেখনদারি, মানব বন্ধনের শক্তি প্রদর্শনের প্রতিবাদ, অন্যদিকে নীরব অথচ তথ্যের সরব উপস্থিতির মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ। বইমেলার সঙ্গে যা আক্ষরিক অর্থেই মানানসই। ধন্যবাদ অমিতাভ চৌধুরীকে। দ্রষ্টব্য হোক ১৫৭ নম্বর স্টল। তাঁকে দেখে যদি শুভবুদ্ধির উদয় হয়!