Saturday, May 17, 2025

অবোধের গোবধে আনন্দ,কণাদ দাশগুপ্তের কলম

Date:

Share post:

কণাদ দাশগুপ্ত

বাংলায় একটা কথা আছে, ‘অবোধের গোবধে আনন্দ’৷ দিল্লিতে আম আদমি পার্টির জয়ের পর এ রাজ্যে তৃণমূলের উচ্ছ্বাসকে কটাক্ষ করে বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ এই ‘অবোধের গোবধে আনন্দ’ বলে কটাক্ষ করেছিলেন।

ভুবনেশ্বরে পূর্বাঞ্চলীয় পরিষদের বৈঠকের পরেও কিছু মন্তব্য করেছেন দিলীপ ঘোষ৷ শুক্রবার সাংবাদিক বৈঠকে তিনি দাবি করেছেন, “অমিত শাহের সামনে কিচ্ছু বলেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চুপ করে বসেছিলেন”। দিলীপবাবুর এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক মহল এবার তাঁকেই সেই কটাক্ষ ফিরিয়ে দিয়ে বলছে, “একেই বলে অবোধের গোবধে আনন্দ৷ না হলে একজন সাংসদ কখনও কেন্দ্রের ডাকা প্রশাসনিক বৈঠকের প্রকৃত তথ্য না জেনে এভাবে অসত্য কথা বলতে পারেন? উনি প্রচারের কাঙাল। সব সময়ই উল্টো পাল্টা কথা বলে প্রচারের আলোয় থাকতে চান। আসলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর এই ছক আঁচ করতে পারেনি বিজেপি৷ ধাক্কা খেয়ে এখন গো-বধের আনন্দ পেতে চাইছে বঙ্গ-বিজেপি”৷

মুখ্যমন্ত্রী কি সত্যিই ওই বৈঠকে চুপ ছিলেন ? বাংলার স্বার্থে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এই গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে কিছুই বলেননি ? এমন ভাবনা সত্যিই শিশুসুলভ৷ রাজ্যে ঝিমিয়ে যাওয়া কর্মী- সমর্থকদের চাঙ্গা করতে বিজেপি এই বিভ্রান্তিকর প্রচার হয়তো করছে৷ বাস্তব একেবারেই এমন নয়, এমন হওয়ার কথাও নয়৷

ভুবনেশ্বরে পূর্বাঞ্চলীয় পরিষদের বৈঠকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে স্মরণ করিয়ে দেন, “কেন্দ্র ও রাজ্যে সমন্বয়ের দায়িত্ব শুধুই রাজ্যের নয়, কেন্দ্রেরও ভূমিকা আছে৷ কেন্দ্র সেই দায়িত্ব পালন করুক৷” বৈঠকে দু’দফায় কথা হয় পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর সম্পর্ক এবং দাবিদাওয়া নিয়ে। বাংলার সঙ্গে বঞ্চনা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন মুখ্যমন্ত্রী। বাংলার বকেয়া টাকা থেকে কয়লার রয়্যালটি প্রসঙ্গ টেনে জোরালো দাবি জানান বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ৷ বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে বৈঠকে ঠিক কী কী বলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি বলেছেন :

◾সমন্বয়ের দায়িত্ব শুধুই রাজ্যের নয়, কেন্দ্রেরও ভূমিকা আছে৷ বৈঠকের শুরুতেই তা স্পষ্ট করে দেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাজ্যগুলির উন্নয়নের স্বার্থে কেন্দ্রের আরও দায়বদ্ধ হওয়া উচিত৷ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ আমলাদের একের পর এক উদাহরণ দিয়ে তা বুঝিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। তথ্য দিয়ে বাংলার প্রতি কেন্দ্রের ধারাবাহিক বঞ্চনার অভিযোগ আনেন মুখ্যমন্ত্রী৷

◾বৈঠকে সরাসরি অমিত শাহকেই প্রশ্ন করে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান, ‘‘ফণী এবং বুলবুলের পরে আপনার সঙ্গে কথা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীও ক্ষয়ক্ষতি বাবদ অর্থ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু টাকা মিলল না কেন?’’
◾বিজেপি-সহ বিরোধীদের অভিযোগ, বাংলায় আইনের শাসন নেই। রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়ও হামেশাই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে এ ধরনের মন্তব্য করেন৷ ওদিকে, শুক্রবার পূর্বাঞ্চলীয় আন্তঃরাজ্য পরিষদের বৈঠকে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের উপস্থিতিতেই কেন্দ্রের শীর্ষকর্তারা জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মোকাবিলায় পশ্চিমবঙ্গ যথেষ্ট ভাল কাজ করছে। তবে কেন্দ্রকে আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক তথ্য পাঠানোর ক্ষেত্রে রাজ্যের দীর্ঘসূত্রতা আছে৷ বৈঠকে আইনশৃঙ্খলার প্রসঙ্গ উঠতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অমিত শাহের উদ্দেশ্যে বলেন, ৬০ দিনের মধ্যে চার্জশিট পেশ করায় রাজ্য পুলিশের সাফল্য ৫০ শতাংশেরও বেশি। কলকাতা পুলিশের সাফল্য ৯০ শতাংশের মতো। নারী এবং শিশুদের উপর কোনও অপরাধের তদন্তে সক্রিয় থাকে রাজ্য প্রশাসন। অল্প সময়ে তদন্ত শেষ করা হয়। ৩ দিনে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, এমন নজিরও আছে। মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, এই ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রে রাজ্য ‘জিরো টলারেন্স’ মনোভাব নিয়ে চলে।
◾রাজ্যের নাম পরিবর্তনের পক্ষেও ফের সওয়াল করেন মুখ্যমন্ত্রী ৷ রাজ্যের নাম ‘বাংলা’ করার দাবি দীর্ঘদিনের৷ কেন্দ্র বিষয়টি ঝুলিয়ে রেখেছে৷ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে পশ্চিমবঙ্গের নাম পরিবর্তনের বিষয়টি মনে করিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী।

◾বৈঠকে মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেন, ‘‘রাজ্যে যেমন নির্বাচিত সরকার, কেন্দ্রেও তেমনই নির্বাচিত সরকার৷ যার যেটা প্রাপ্য, তার সেটা পাওয়া উচিত। কারও ব্যাপারে অন্য কারও খবরদারি করা উচিত নয়। সংবিধান অনুযায়ী সবাই চলুক।
◾রাজ্যের ঘাড়ে প্রায় ৩ লক্ষ কোটি টাকার দেনার প্রসঙ্গ তুলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী বৈঠকে বলেন, ‘‘কেন্দ্রীয় সরকার করের বন্টন খাতে অর্থের পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে।কেন্দ্র GST-র ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্য অর্থও সময়মতো দিচ্ছে না । বিভিন্ন প্রকল্পে কেন্দ্র নিজের অংশীদারিত্ব কমাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, GST-র ক্ষতিপূরণ বাবদ দু’মাসের মধ্যে অর্থ পাওয়ার যে প্রতিশ্রুতি ছিল কেন্দ্রের থেকে কার্যত তা পাওয়া যাচ্ছে ছ’মাসের মধ্যে। এতে আমাদের আর্থিক ভাবে অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের ৫০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রের কাছে প্রাপ্য।
◾এই ধরনের কেন্দ্রীয় বঞ্চনার কারনেই রাজ্য নিজেই কিছু আয়ের রাস্তা খুঁজে নিতে বাধ্য হয়েছে৷ নিজের মতো আয় করে সামাজিক প্রকল্পগুলির বিপুল খরচ চালাতে হচ্ছে।
◾রাজ্যের প্রতি কেন্দ্রেরও যে কিছু করণীয় রয়েছে, এ দিন তা উল্লেখ করে মমতা বৈঠকে বলেছেন, রেলের দীর্ঘসূত্রতার কারণে গত প্রায় ৩ বছর ধরে মাঝেরহাট সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পূর্ণ করা যাচ্ছে না। সময় মতো রেলের ছাড়পত্র পাওয়া যায়নি। ফলে সমন্বয় যে উভয় দিক থেকে হওয়া প্রয়োজন, সেই দাবি এ দিন তুলেছেন তিনি।
◾ কোনও অনুগ্রহ বা দাক্ষিণ্য নয়, সংবিধান অনুসারেই কেন্দ্রীয় সরকার দেশের রাজ্যগুলিকে অর্থ এবং বিভিন্ন প্রকল্পে সহযোগিতা করতে বাধ্য৷ এই দাবি জানিয়েই বাংলার প্রাপ্য অর্থ এবং বিভিন্ন প্রকল্পে সহযোগিতা যে আরও প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করতে যাবতীয় তথ্য দেন মুখ্যমন্ত্রী।
◾নদী-জল বন্টনের নীতি তৈরির দাবি জানিয়ে মমতা বলেন, বিহার যেভাবে তেনুঘাটে জল ধরে রাখে এবং বর্ষার ভরা মরসুমে তা ছেড়ে দেয় তাতে বাংলায় বন্যাপরিস্থিতি তৈরি হয়, সেই প্রক্রিয়ায় বদল আনা প্রয়োজন।
◾বিভিন্ন প্রকল্পে জমির ব্যবস্থা করার ব্যাপারে রাজ্য যে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করবে, সে কথা বৈঠকে জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। বাগডোগরা বিমানবন্দরর সম্প্রসারণ হোক, বা পশ্চিম মেদিনীপুর-সহ একাধিক এলাকায় রেলওয়ে ওভারব্রিজের জন্য জমির ব্যবস্থা ইত্যাদি সব ক্ষেত্রেই কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে সহযোগিতা করতে রাজ্য সব সময় তৈরি৷
◾পূর্বাঞ্চলের বিহার, ঝাড়খণ্ড এবং ওড়িশার কিছু এলাকায় এখনও মাওবাদী প্রভাব থাকলেও বাংলায় তারা আর সক্রিয় নয়। সেই কারণে বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুর এবং বীরভূমের একাংশ কেন্দ্রের মাওবাদী তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। শুধু নতুন জেলা ঝাড়গ্রামকে “সিকিয়োরিটি রিলেটেড এক্সপেন্ডিচার” বা SRE তালিকাভুক্ত করে রেখেছে কেন্দ্র। ঝাড়গ্রাম বাদে রাজ্যের মাওবাদী প্রভাবিত বাকি সব এলাকা থেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনী প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। তবে কোথাও নজরদারি এবং নিরাপত্তা রক্ষার কাজে ঢিলেমি নেই৷ রাজ্য নিজেই সে কাজ করছে।
◾ রানীগঞ্জের খনি অঞ্চলের ধসের সমস্যায় বহু মানুষের ক্ষতি হচ্ছে। বারবার বলা সত্ত্বেও কেন্দ্র অর্থ দিচ্ছে না।
◾কয়লা সব নিয়ে যাচ্ছে, কিছুই দিচ্ছে না৷ বাংলা, বিহার, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা মনে করে, কয়লার সেস এবং রয়্যালটি পাওনা নিয়ে সমস্যার সমাধান হওয়া জরুরি।
◾ এক রাজ্যে অপরাধ করে বহু ক্ষেত্রে অপরাধী অন্য রাজ্যে পালিয়ে যায়। তাই রাজ্যগুলির মধ্যে পুলিশ ও প্রশাসনিক স্তরে সমন্বয় বাড়ানো গেলে অপরাধীকে ধরার কাজ দ্রুত করা সম্ভব। প্রস্তাবটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে কেন্দ্র।
◾বৈঠকে উপস্থিত কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ আমলারা রাজ্যের ভূমিকার প্রশংসা করে প্রস্তাব দেন, সব তথ্য কেন্দ্রকে ঠিক সময়ে জানালে তা অনলাইন তথ্যভাণ্ডারে ‘আপলোড’ করা যাবে। তাহলে গোটা দেশ তা জানতে পারবে। মুখ্যমন্ত্রী এই প্রস্তাব মেনে সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
◾কোনও মন্তব্য না করলেও বৈঠকে মমতার সব বক্তব্য বিশেষ মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ৷
◾বৈঠকের পর মমতা জানান, ”NRC, CAA ও NPR নিয়ে আলোচনা হয়নি। কারন বৈঠকের কর্মসূচিতে এসব ছিলো না।”
বৈঠক শুরুর আগে দিল্লি হিংসার প্রসঙ্গ তোলেন মমতা। দিল্লিতে শান্তি ফেরানোর জন্য শাহের কাছে আর্জি জানান মুখ্যমন্ত্রী।

এত কিছুর পরেও যাদের ধারনা ওই বৈঠকে “অমিত শাহের সামনে কিচ্ছু বলেননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। চুপ করে বসেছিলেন”, তারা ‘অবোধ’ না ‘নির্বোধ’ তা না হয় রাজ্যের মানুষই স্থির করুক৷

আরও পড়ুন-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুয়াদের নিয়ে বিশেষ প্রতিযোগিতা ‘হ্যাকাথন’ অনুষ্ঠিত হল অ্যাডামাস বিশ্ববিদ্যালয়ে

spot_img

Related articles

এবার নাম বদলের রাজনীতি বিহারে! গয়া হল ‘গয়াজি’

বিজেপি জমানায় নাম বদলের রাজনীতি নতুন নয়। আর তার শীর্ষে অবশ্যই যোগি আদিত্যনাথের রাজ্য উত্তর প্রদেশ। তবে এবার...

আইএমএ বাংলার নির্বাচন বাতিল ঘোষিত! দুমাসে কমিটি গঠনের নির্দেশ

চিকিৎসকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (IMA) রাজ্যের ২০২৫-২৭ নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই বাতিল করে দেওয়া হল কেন্দ্রীয় শাখার তরফে। নির্বাচন...

নির্দেশ দেখে পদক্ষেপ: ডিএ নির্দেশে প্রতিক্রিয়া চন্দ্রিমার

রাজ্য সরকারের কর্মীদের ২৫ শতাংশ ডিএ (DA) দেওয়ার নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের। এক ঘোষণায় সরকারি কোষাগার থেকে প্রায় ৯...

টুটু বোসের ইস্তফা প্রসঙ্গে দেবাশিসের পাল্টা মুখ খুললেন সৃঞ্জয়

মোহনবাগানে(Mohunbagan) নির্বাচনের ডঙ্কা বেজে গিয়েছে। সেইসঙ্গেই চড়তে শুরু করেছে উত্তেজনার পারদ। এই মুহূর্তে অবশ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল...