‘তোমাদের ভবিষ্যতে বসে এ লেখা লিখছি’ , ফ্রান্সেস্কা মেলান্দ্রি কণাদ দাশগুপ্তের কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

গেট ক্র্যাশ বা অনুপ্রবেশ নয়, সাহিত্যের আঙ্গিনায়

হাত ধরে ডেকে এনে ‘করোনা- সংক্রমণ’ ঘটিয়ে দিলেন ফ্রান্সেস্কা মেলান্দ্রি৷

মেলান্দ্রি এই মুহুর্তের ইতালির সামনের সারিতে থাকা সাহিত্যিক৷ খুব সামনে থেকে দেখেছেন করোনা-আগ্রাসন৷ আজ এখনও তিনি লকডাউনেই৷

ফরাসি সংবাদপত্র, Libération, গত ১৯ মার্চ ফ্রান্সেস্কা মেলান্দ্রি-র এই ‘চিঠি’ ছাপা হয়৷ ‘চিঠি’ বলেছেন মেলান্দ্রি নিজেই, “Letter from your future”! আর এই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই সাহিত্যজগত “করোনা-আক্রান্ত” করে দিলেন মেলান্দ্রি৷
প্রতিবেদনটি ছাপার পরই তা গোটা দুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে৷ অনুবাদ হয়েছে বহু ভাষায়৷ করোনার মতোই ‘অতিমারি’ হয়ে উঠেছে এই “Letter from your future”!
লকডাউনে থেকে ফ্রান্সেস্কা মেলান্দ্রি তাঁর ইউরোপিয়ান বন্ধুদের উদ্দেশ্যে এই লিখেছেন এই ‘চিঠি’৷

দুনিয়াজুড়ে আজ করোনা-ত্রাস৷ এই ত্রাসের সময়ে ফ্রান্সেস্কা মেলান্দ্রি এই ‘চিঠি’-তে এমন অনেক কথাই বলেছেন, যা এই দেশে বসে আমরাও ভাবছি, কিন্তু বলতে পারছিনা৷ ফরাসি ভাষায় লেখা মূল লেখাটির ইংরেজি অনুবাদ দিনকয়েক আগে
প্রকাশিত হয়েছে৷ সেই ইংরেজি থেকেই বাংলা অনুবাদের অক্ষম এক প্রচেষ্টা৷

•••••••••••

আমি ইতালি থেকে বলছি৷ আমি এখনও সেখানেই, যেখানে কয়েক দিনের মধ্যে তোমরাও থাকবে৷ অর্থাৎ আমি এখন ‘তোমাদের ভবিষ্যতে’।

আসলে তোমাদের থেকে আমরা কয়েক কদম এগিয়ে আছি৷ ঠিক যেভাবে উহান ছিলো আমাদের থেকে কয়েকদিন এগিয়ে, তেমনই।

শুরুর সময় এই ইতালিতে সব জেনেও আমরা ঠিক যে ধরনের আচরণ করেছিলাম, আমি দেখতে পাচ্ছি, সবকিছু জেনেবুঝে ঠিক একই আচরণ তোমরাও করছো৷ আমাদের মতো তোমরাও বলছো, “ও কিছু নয়, এটা একটু ঠাণ্ডা লাগা জ্বরের মতোই, সেরে যাবে নিজে থেকেই”। তোমরা কিন্তু আমাদের পরবর্তী পরিস্থিতি দেখেছো৷ আমরা যেমন উহান দেখেছিলাম৷ এবং বুঝতে পারছি, তোমরাও ঠিক আমাদের মতোই করছো৷ যখন ওরা তোমাকে তোমার বাড়ির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে বলবে, তখন তোমাদের কেউ কেউ তর্ক করে মিশেল ফুকো’র কোনও উদ্ধৃতি দেবে, তারপরে হবস-এর কথা বলবে৷ তবে এটা জেনো, খুব তাড়াতাড়ি তোমাদের অন্য কাজ করতে হবে।
লকডাউনে তোমরা এখন ঘরে আটকে৷ হয়তো এখন জর্জ অরওয়েল কিংবা হবস-এর থিওরি নিয়ে সময় কাটাচ্ছো৷ হয়তো ভাবছো, এই বন্দিদশাটা আসলে আসলে সরকারের একটা চাল৷ কিন্তু বিশ্বাস করো, আর মাত্র কয়েকদিন পর তোমরা এসব ভাবার আর কোনও সুযোগই পাবে না। তোমরা তখন খাওয়া-দাওয়া নিয়ে ভাববে, নেটফ্লিক্স নিয়ে চিন্তা করবে, হোয়াটস অ্যাপ, ফেসবুকে একে অন্যের সাথে কথা চালাচালি করবে, এই লকডাউনে কীভাবে সময় কাটানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা করবে৷
জেনে রেখো, এর কিছুদিন পর তোমাদের কাছে এসব আলোচনাও অর্থহীন লাগবে। তুমি বুকশেলফ থেকে কোনও apocalyptic literature বা ডিস্টোপিয়ান বই নিয়ে পড়ার চেষ্টা করবে৷ কিন্তু কিছুদিন পরেই বুঝতে পারবে তোমার আসলে ওসব পড়ার দরকার নেই৷ কারণ, তুমি তো এইরকম একটা জগতেই বাস করা শুরু করে দিয়েছো।

আমরা দেখতে পাচ্ছি যে তোমরা আমাদের মতোই আচরণ করেছো৷ এই ইতালি থেকে, তোমাদের ভবিষ্যত থেকে, আমরা বুঝতে পারছি, তোমরা যারা পরিবার থেকে দূরে আছো, তোমরা যে কোনও মূল্যে চাইবে প্রিয়জনের সাথে হয়তো একটা শেষ আলিঙ্গন কিংবা বহুবছর অভিমানে কথা না বলা মানুষগুলোকে ফোন করে দেখবে তারা আদৌ বেঁচে আছে নাকি! এখন হয়তো তুমি তোমার বড় হয়ে যাওয়া সন্তানকে মিস করতে শুরু করবে৷ এই ভাবনা আগে তোমার কখনও হয়নি৷ তুমি দেখবে, এই বেদনা হঠাৎই তোমার বুকে যেন ঘুঁষি মারছে৷ আমি জানি, তুমি যে লোকগুলোকে আর দেখতে চাওনা বলে কসম খেয়েছো, তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে চাইবে, “আপনি কেমন আছেন ?”
ওদিকে, ঘরে থেকে থেকে তোমার ওজন বাড়বে হয়তো, তুমি অনলাইনে ফিটনেসের একগাদা মডিউল নিয়ে বসবে। সুপারশপে যাওয়ার বাহানায় তুমি একা বাইরে বেরিয়ে একবার দেখতে চাইবে তোমার মতোই অন্য কোনও মানুষকে। তোমার তখন মানুষের হট্টগোল, চেঁচামেচি শুনতে ভীষণ মন চাইবে, কিন্তু তুমি পারবেনা। হট্টগোল, চেঁচামেচি শোনাবেই বা কে ?

ঠিক এই রকম সময়ে তুমি আরও ভালোভাবে মানুষ চিনতে শুরু করবে। আমরা যেমন চিনেছি৷ নিজের মানুষের আসল রূপ দেখে তুমি আতঙ্কিত হবে। আবার যাকে কোনওদিন মানুষ বলে ভাবতেই পারোনি, সে তোমাকে সাহায্য করতে ছুটে আসতে চাইবে।

মানুষের অনুপস্থিতিতে এখন প্রকৃতি হয়তো সুস্থ হয়ে উঠবে৷ সেসব তুমি দেখবে৷ বুঝতে চাইবে না৷ তখন তুমি ভাববে, প্রকৃতি সুস্থ হলে আমার কি? আজ এখন আমার বাজার করার খরচ কে দেবে? ঘরের ভেতর থাকতে থাকতে তোমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। তোমরা ভাববে, এই লকডাউন শেষ হলেই ডিভোর্সের মামলা করবো। আবার তোমাদের অনেকেই এই বন্দিকালে নতুন জীবন আনবে পৃথিবীতে৷ সদ্য ভূমিষ্ঠ সেই শিশুর দিকে তাকিয়ে তোমরা অনেকেই হয়তো একটা অপরাধবোধে তাড়িত হবে৷ হয়তো ভাববে, কেন এমন একটা পৃথিবীতে তাকে নিয়ে এলে !

তোমাদের ভবিষ্যতের ঠিকানায় বসে আমরা জানি, এখন তোমরা ভাবছো, এই অসুখ সাম্যবাদী৷ ধনী-গরীব মানছে না। কিন্তু আমাদের মতো তোমরাও এক সময় দেখবে বিশাল লনওয়ালা ডুপ্লেক্স বাড়ির লকডাউন আর জীর্ণ বস্তির লকডাউন এখনও এক হতে পারেনি।

আমরা ইতালিতে আছি। তোমাদের থেকে মাত্র কয়েক সপ্তাহ কিংবা কয়েক দিনের ভবিষ্যতে। ভবিষ্যতে কী হবে তোমরা যেমন জাননা, আমরাও জানিনা।
তবে একটা জিনিস আমি জানি। আমি জানি, একদিন যখন এই বিভীষিকা শেষ হয়ে যাবেই৷ তখন কোনও কিছুই আর আগের মতো থাকবে না৷
রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সম্পর্ক, সৃষ্টি, সব কিছুর সংজ্ঞা আবার নতুন করে লিখতে হবে। লিখতে হবেই৷
________

Previous articleবিনা চিকিৎসায় করোনা রোগীর মৃত্যু পাকিস্তানে, ভাইরাল ভিডিও
Next articleজরুরি পরিষেবায় যুক্ত ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য বীমা ৫ লক্ষ থেকে বাড়িয়ে ১০ লক্ষ, ঘোষণা মুখ্যমন্ত্রীর