Saturday, December 27, 2025

করোনা আমাদের ‘খই ছেটানো’ সমাজকেও ধ্বংস করে দিচ্ছে

Date:

Share post:

সুভাষ দত্ত
বিশিষ্ট পরিবেশবিদ

এই করোনা-কালে হঠাৎই একটা বৈপরীত্য বড্ড বেশি চোখে পড়ছে৷

এমন তো ছিলো না আমাদের শহর, আমাদের সমাজ বা চারধারের পরিস্থিতি ! এই সংকটকালে আমাকে, আমার মতো অনেককেই সম্ভবত ভাবিয়ে তুলছে।

কয়েকটি টুকরো ঘটনা !

লকডাউনের অনেক আগে আমার ছেলের বন্ধু রাহুল এডিনবরা থেকে ভাইয়ের বিয়েতে দক্ষিণ কলকাতার কসবায় নিজেদের বাড়িতে এসেছিলৈ। লকডাউনে আটকে যায় কলকাতাতেই৷ দিনকয়েক আগে হঠাৎই পাড়ার দোকানদার রাহুলকে জানায়, ‘সে যেহেতু বিদেশ থেকে এসেছে, তাই তাকে মাল বেচা যাবে না। পাড়ার দাদারা তাই বলেছেন’।

রাহুল এ কথার প্রতিবাদ করতেই তাকে এবং তার ভাইকে কয়েকজন মিলে মারধোর করলো৷ থানা পুলিশ করে তবে স্বস্তি।

এক বৃদ্ধ হার্টের রোগী, সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর নিজের বাড়িতে ফিরতে গেলে তার পড়শিরা পথ আটকে দাঁড়ালো। পুলিশের সাহায্যে তাকে বাড়ি ফিরতে হয়েছে, এমনই খবর।

পরিস্থিতি এখন এমনই যে পাশের বাড়িতে কেউ একটু জোরে হাঁচি-কাশি দিলে, চিন্তিত হয়ে প্রতিবেশী পুলিশ বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ফোন করছেন। পরিচিত বা প্রতিবেশী কারও যদি করোনা উপসর্গ দেখাও দেয়, খোঁজ নেওয়ার পরিবর্তে তাঁকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে মানুষ৷ আপনজনদেরও কি এভাবেই আমরা এককথায় ঝেড়ে ফেলবো ?

এই সমাজ তো আমাদের অচেনা৷ আজ বড্ড মনে পড়ছে একটা কথা৷ ১৯৮১-র ডিসেম্বর মাস। তখন প্রাইসওয়াটার হাউসে চাকরি করি। প্র্যাকটিসে আসবো। ওই সংস্থার প্রথম ভারতীয় এবং প্রথম বাঙালি সিনিয়র-পার্টনার আর এন সেনের কেয়াতলা লেনের বাড়িতে একদিন গেলাম। অনেক কথাবার্তার শেষে উনি বললেন “জানো সুভাষ, প্রাইস আমাকে সাহেব পাড়ায় এক প্রাসাদোপম ফ্ল্যাটে থাকতে বলেছিলো। কিন্তু আমি এই কেয়াতলাতেই থেকে গেলাম। কেন জানো? আমি ওই সাহেব পাড়ার প্রাসাদোপম ফ্ল্যাটে মরলে পাশের ফ্ল্যাটের লোকটা জানলাটা খুলে ‘সরি’ বলে ফের জানলা বন্ধ করে দেবে। আর এখানে মরলে খই ছড়িয়ে, বলহরি ধ্বনি দিয়ে প্রতিবেশীরা শ্মশানে নিয়ে যাবে। এই আপনজন আর কোথায় পাবো ?”

ঠিকই, সমাজ তো আমাদের এইভাবেই চলতে শিখিয়েছে। কিন্তু এই করোনা-কালে যে সব ঘটনা ঘটেছে, যে সব ঘটনার কথা কানে আসছে, তা দেখে এবং শুনে মনে হচ্ছে, আমাদের সমাজ যেন ঠিকমতন তৈরিই হয়নি।

নিজের মনের সঙ্গেই এখন চলছে আমার জোর লড়াই। হুট করে কখন, কোথায় যে মন’টা চলে যাচ্ছে, আমি খেই হারাচ্ছি।

আমি আগাগোড়াই একটু ‘কম বুঝি’ মানুষ। সেদিন ঠিক বুঝতে পারিনি সেনসাহেব ঠিক কি বলতে চেয়েছিলেন। পরে বুঝেছি৷ বছর দুয়েক আগে এক টিভি চ্যানেলের ডাকে আসিয়ানা হাউসিং এস্টেটে একটা প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম। সঞ্চালক প্রশ্ন করলেন, ‘উত্তর কলকাতার পুরোনো বসত এলাকার সঙ্গে এই ধরনের নতুন কমপ্লেক্সের পার্থক্যটা ঠিক কোথায়?’

আমার উত্তর ছিলো, “পুরোনো কলকাতার মানুষের সামাজিক মেলামেশাটা অনেক বেশি। রকে বসে আড্ডা দিতে দিতে বা চায়ের দোকানে গুলতানি করতে করতেই ওখানে একটা সমাজ গড়ে উঠেছে। আর আসিয়ানা’র বাসিন্দারা জানালা খুলে কার ক’টা এবং কত দামের গাড়ি এটা দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সমাজ এখন আর আগের মতো নেই।”

বড় শহরগুলি ঘিরে নতুন নতুন বসত এলাকা গড়ে উঠেছে। পয়সাওয়ালা মানুষ ঝাঁ চকচকে সুন্দর, বাড়ি বানিয়ে বা ফ্ল্যাট কিনে বসবাস করছেন একথা ঠিকই, কিন্তু সামাজিকতা সেখানে একেবারেই গড়ে উঠছে না। প্রায় ৪০ বছর আগে আর এন সেনের সেই ‘খই ছেটানো’ সমাজ আজ কি হারিয়ে যাচ্ছে ? যে দোকানদার ওইরকম ব্যবহার করেছিলেন বা যে প্রতিবেশীরা অসুস্থ বৃদ্ধকে বাড়িতে ঢুকতে দেননি, ভগবান না করুন, তাঁদের যদি কোন উপসর্গ দেখা দেয়, তখন কি হবে?

এই মহা সংকটকালে এসব কথা অবশ্যই ভাবা দরকার। এই সুস্থ ভাবনা থেকেই তো গড়ে ওঠে সমাজ। করোনাভাইরাস আমাদের যেন শেখাচ্ছে, সবাইকে আগে মানুষ হতে হবে, মানসিকতা ও সামাজিকতা গড়ে তুলতে হবে। জীবজন্তুরাও সমাজ গড়ে তোলে আর মানুষ কি আজ নিজের তৈরি করা সেই ‘খই ছেটানো’ সমাজটাকে হারিয়ে ফেলবে?

spot_img

Related articles

পরচুলা নিয়ে ঝামেলার জের, ‘দৃশ্যম ৩’- তে অক্ষয় খান্নাকে নিয়ে ধোঁয়াশা!

প্রথম দুই সিনেমায় বিজয় সালগাঁওকার অধরা, তৃতীয় দফায় কি সব রহস্য ফাঁস হবে? ‘দৃশ্যম ৩’-র (Drishyam 3) ঘোষণা...

‘জনগণমন’ প্রথম গাওয়া হয়েছিল আজকের দিনে, জাতীয় সংগীতকে স্মরণ অভিষেকের

জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে রচিত হওয়ার অনেক আগেই 'জনগণ মন অধিনায়ক জয় হে' গানটি রচিত হয়েছিল। কবিগুরুর সেই অমর...

তাপমাত্রার পারদের পতন অব্যাহত, শনিবার মরশুমের শীতলতম দিন

বছর শেষের বাংলা জুড়ে শীতের (Winter) জমাট ব্যাটিং, প্রতিদিনই নামছে তাপমাত্রার (Temparature)পারদ। কলকাতা সহ গোটা রাজ্যে তাপমাত্রার পারদ...

শীতের আমেজে মিতিন মাসি স্পেশাল স্ক্রিনিংয়ে তারকা সম্ভার

মহিলা গোয়েন্দা চরিত্র হিসেবে বাঙালি পাঠকের মনে বড় অংশ জুড়ে আজও মিতিন মাসি( Mitin Masi)। আর সেই মিতিনকে...