যোগেন চৌধুরীর ‘চারুবাসনা’ কী জানেন? আজ তার বিশেষ দিন

অনুরাধা ঘোষ

গোটা একটা বছর পেরিয়ে এলো ‘চারুবাসনা’, যাকে আমরা মুখ্যত জানি ‘যোগেন চৌধুরী সেন্টার ফর আর্টস’ নামে। এই শিল্পসংস্থা- যা একই সঙ্গে শিল্প সংগঠনও বটে- শিল্পী যোগেন চৌধুরীর বহুদিনের ঐকান্তিক ইচ্ছে ও প্রচেষ্টার ফসল। তার প্রথম বছরের যাত্রাপথটি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায় যে বাংলার শিল্পচর্চা ও শিল্পগবেষণার ইতিহাসে একটি দৃঢ় স্থান অধিকার করতে পারার সম্ভাবনাটি তার ক্রমেই নিশ্চিত হচ্ছে। বাংলার এত সমৃদ্ধ শিল্প-ঐতিহ্য নিয়ে সেভাবে যে কোনো মিউজিয়ম গড়ে উঠল না, তা নিয়ে অন্য অনেক পূর্বসূরী শিল্পীদের মতই ক্ষুন্ন ছিলেন যোগেন চৌধুরী নিজেও। সংস্কৃতির এই বিশেষ দিকটি উত্তরপুরুষদের জন্য সংরক্ষণ করার দায়িত্বটি স্বীকার করে নিয়ে প্রায় একার প্রচেষ্টায় শিল্পী গড়ে তুলেছিলেন এই চারুবাসনা, 2019 এর 20 এপ্রিল। আনোয়ার শাহ রোডে, সাউথ সিটির উল্টোদিকে একটি পাঁচতলা ভবনের প্রশস্ত পরিসরে যাত্রা শুরু করেছিল এই সংস্থা। ঐদিন উদ্বোধনের মুহূর্তটির সাক্ষী ছিলেন শঙ্খ ঘোষ, রবীন মন্ডল, গনেশ হালুই, পার্থপ্রতিম দেব, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, প্রণবরঞ্জন রায় ও আরও নক্ষত্রপ্রতিম ব্যক্তিত্বরা। একতলার চমৎকার প্রদর্শনীকক্ষে আমরা দেখেছিলাম জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্যর কিউরেশনে মহাভারত-কেন্দ্রিক একটি চমৎকার প্রদর্শনী। বাংলার যে শিল্পীরা আজ স্মরণীয় হয়ে আছেন, তাঁদের অনেক শিল্পসৃষ্টিই বিদেশি শিল্পানুরাগীদের সংগ্রহের অংশ হয়ে পাড়ি দেয় বাংলা বা ভারতের বাইরে। ফলে নতুন প্রজন্ম তাঁদের কাজের ধারাবাহিকতার ধারণাটি থেকে অনেক সময় বঞ্চিত হয়। সে কথা মাথায় রেখেই হয়তো, যোগেন চৌধুরীর ছবির একটি বিপুল সংগ্রহ স্থায়ী প্রদর্শনী হিসেবে দুটি সম্পূর্ণ তল জুড়ে রয়েছে।

ছাত্রজীবনের কাজ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক শিল্পসৃষ্টি- সবই রয়েছে এই প্রদর্শনীতে। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে- যখন শিল্পী শুরু করছেন তাঁর ছাত্রজীবন- সেই সময় আর্ট কলেজের শিল্পশিক্ষার ধরন ঠিক কিরকম ছিল, সে সম্পর্কে একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ধারণা পাওয়া যায় এই ছবিগুলি মন দিয়ে কালানুক্রমিক ভাবে দেখলে। শিল্পীর ব্যক্তিগত ক্রমবিকাশের ইতিহাসের সঙ্গে একাকার হয়ে যায় দেশের আর্থসামাজিক ইতিহাস, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, মানুষের সমষ্টিগত গতিপথটিও। রয়েছে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ লাইব্রেরি, শিল্পীর নিজস্ব বিপুল গ্রন্থসংগ্রহ নিয়ে। যে কোন শিল্প-গবেষকের কাছে তা অতি মূল্যবান। শিল্প-সংক্রান্ত রেসিডেন্সির জন্য ভবনের একটি অংশ নির্দিষ্ট, রয়েছে মেধাবী গবেষকদের জন্য দুটি স্কলারশিপের ব্যবস্থাও। ছবি রেস্টোরেশনের জন্য রয়েছে একটি স্বতন্ত্র ইউনিট। প্রদর্শনীকক্ষটিতে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রদর্শনী হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। নবীন, প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন শিল্পীদের ছবি দেখানোর ব্যাপারেও আগ্রহী এই সংস্থা। পাঁচতলায় বিরাট একটি সেমিনারের জায়গা। সেখানে প্রায়ই কবিতা, ছবি বা গান নিয়ে আলোচনাসভা চলে। শুধু প্রদর্শনী বা শিল্প-গবেষণাই নয়, ‘চারুবাসনা’ নজর দিচ্ছে শিল্পসমালোচনার দিকেও। এখান থেকেই প্রকাশিত হয় ছবি-সংক্রান্ত জার্নাল ‘আর্টইস্ট’, যেখানে ছবি নিয়ে লেখেন দেশ ও বিদেশের বহু বিখ্যাত শিল্প- সমালোচক। বাংলার গুনী শিল্পীদের মধ্যে অনেকেই নিজেদের কাজ নিয়ে আলোচনা ও প্রচারের ক্ষেত্রে তেমন স্বচ্ছন্দ নন; এর ফলে তাঁদের গতিপথ মাঝে মাঝে অমসৃণ হয়ে পড়ে। এই বাধা অতিক্রমের জন্যই প্রাথমিকভাবে এই জার্নালটির সূচনা। কিন্তু এখন এর চরিত্র সর্বভারতীয়, এটি আদৃত হচ্ছে বিদেশেও।

এই বিস্তৃত কর্মকান্ড নিয়ে যে বছরটি কাটল ‘চারুবাসনা’র, সেটি যথার্থ উদযাপনযোগ্য। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে সেই উদযাপন, সেই সহর্ষ ফিরে-দেখা কার্যত অসম্ভব। তবু কাজ তো থেমে থাকে না শিল্পীদের, স্তব্ধ হয় না শিল্পধারা। থামে নি ‘চারুবাসনা’র কাজও। পরবর্তী পদক্ষেপের প্রস্তাবনা অব্যাহত রয়েছে, পরিকল্পনাও।

Previous articleকোভিড-১৯ জাতি, ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সীমা দেখে আসেনি, সবাই আজ একই চ্যালেঞ্জের মুখে, এখন দরকার ঐক্য ও সৌভ্রাতৃত্ব : মোদি
Next articleকিটের গুণমান খারাপ, ত্রুটিপূর্ণ, রাজ্যের অভিযোগ মানলো নাইসেড, ICMR