লকডাউনে যেসব প্রতিভা নোবেলের মনোনয়ন পেতে পারে!!

বাসু মুখোপাধ্যায়

লকডাউনে অনেকের সুপ্ত প্রতিভা প্রকাশিত হচ্ছে। যেমন সম্প্রতি হঠাৎ করে জানা গেল আমার এক ভাগ্নে ভাল চুল কাটতে পারে। পড়াশোনা নিয়েই থাকত সে, তার যে এমন জাবেদ হাবিবসম প্রতিভা আছে কারুর জানা ছিল না। সেলুন বন্ধ ফলতঃ তাকে নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি পড়ে গেল। প্রথমে বাড়িতেই একজনের শৌখিন দাড়ি ট্রিম করল। তারপর একে একে বাড়ির সমস্ত পুরুষের চুল কাটতে হল। তারপর পাড়ারও কয়েকজন মাস্ক পরে এসে চুল ছেঁটে গেল।

ভালই চলছিল কিন্তু একদিন এমন ঘটনা ঘটল যে ভাগ্নে কাঁচি-চিরুনি-রেজার ছুঁড়ে ফেলে দিল। প্রতিবেশী তলাপাত্রদাদু খালি গা’য় এসে হাত তুলে বগলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “মাথায় চুল তো নেই। তুই এটাই পরিষ্কার করে দে।”
ভাগ্নে সেই যে ক্ষৌরকর্ম ত্যাগ করল আর শত অনুরোধেও তাকে দিয়ে ও কাজ করানো যায়নি।
.
মিষ্টি দোকান খুলে গেছে। আমি কদিন ধরেই বলছি, “যাই মিষ্টি নিয়ে আসি।”
বউ আমাকে কিছুতেই যেতে দেবে না। তার এক কথা, “কিনে আনার কোনও দরকার নেই। আমিই তোমায় মিষ্টি বানিয়ে খাওয়াব।”
আমি জানি ও এইভাবে কায়দা করে আমার মিষ্টি দোকানে যাওয়া আটকাচ্ছে।
লক ডাউন কেটে যাবে কিন্তু বউয়ের মিষ্টি বানানো হবে না।
কিন্তু ভেতরে ভেতরে যে ইউটিউবে মিষ্টি বানানোর কলা-কৌশল শিখছিল সে আমার জানা ছিল না।
হঠাৎ বউ ঘোষণা করল, “আজ বিকেলে গোলাপ জামুন বানাবো।”
চারটার সময় রান্নাঘরে ঢুকল বউ। তার আগে বলল, “সাড়ে পাঁচটায় পাবে গোলাপ জামুন। একটু ধৈর্য ধরে বসে থাকো। যাতে তুমি ছোঁক ছোঁক না করতে পারো তাই দরজা বন্ধ করছি।”
.
ছটা নাগাদ বউ রান্নাঘরের দরজা ফাঁক করে মুখটা বের করে বলল, “চিনি, গুঁড়ো দুধ, সুজি আর ঘি এনে দিতে পারবে? একটা কাগজ নিয়ে এসে পরিমাণগুলো লিখে নাও!”
আমি বুঝলাম শুধু একরকম নয়, দু-তিন রকমের মিষ্টি প্রস্তুত হচ্ছে।
আমি বেরোলাম। কিছু দূরে একটা মুদি দোকান আছে।
বউ জিনিসগুলো নিয়েই আবার রান্নাঘরের দরজা বন্ধ করে দিল।
.
সাতটা বেজে গেল। রান্নাঘরের কাছে গিয়ে গলা চড়িয়ে বউকে বললাম, “চা কি আজ হবে না?”
বউ ঝাঁঝিয়ে উঠল, “একবেলা চা না খেলে কী হয়? যেটা করছি সেটা ভাল করে করতে দাও। চুপ করে বসে থাকো।”
আরও দু ঘন্টা কেটে গেল। ভাবলাম আজ রাতে রুটির সঙ্গে নানা রকম মিষ্টি পরিবেশিত হবে বোধহয়।
রাত এগারোটায় আর থাকতে না পেরে বউকে বললাম, “দেরি আছে নাকি?”
বউ রান্নাঘরের ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “তোমার ধৈর্য বলে কী কোনও বস্তুই নেই?”
আমি বুঝলাম ভাল জিনিস পেতে আরও অপেক্ষা করতে হবে।
.
রাত সাড়ে বারোটার সময় বউ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল। মুখ-চোখের অবস্থা ভাল নয়। ও দৌড়ে বাথরুমে যেতেই আমি রান্নাঘরে ঢুকলাম।
রান্নাঘরের হান্ডুল-বান্ডুল অবস্থা! চারিদিকে ছত্রখান হয়ে ডেকচি-কড়া-বাটি পড়ে আছে। বিভিন্ন পাত্রে বিভিন্ন আকারের বস্তুসমূহ উঁকি মারছে। টেস্ট করতে গিয়ে দেখলাম কোনটা খুব শক্ত। কোনও পাত্রে রস জমে শক্ত খটখটে হয়ে গেছে, এঁটে বসা ছানা-সুজির পিণ্ডকে হিলানো যাচ্ছে না। কোনওটা ফেটে-ফুটে ছেতরে গেছে। হায় রে গোলাপ জামুন!
বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসে বউ থমথমে মুখে বলল, “আজ রুটি করা হয়নি, মুড়ি খেয়ে নেবে?”
আমি বললাম, “গোলাপ জামুন দিয়ে? হ্যাঁ খাব খাব।”
বউ বলল, “না ফ্রিজে তরকারি আছে, গরম করে দিচ্ছি।”
তারপরে যুদ্ধশেষে পরাজিত সেনানীর মতো ছলছলে চোখে বলল, “ধুস এই লকডাউনের সময় কত জিনিস নষ্ট করলাম। খুব অন্যায় হল! আমার দ্বারা গোলাপ জামুন-টামুন হবে না। রসগোল্লা ট্রাই করলেই হত।”
বউয়ের বিধ্বস্ত মুখটা দেখে মায়া হল। বললাম, “হবে না মানে? আমি খেয়ে দেখেছি এক্সেপসেনাল হয়েছে। সব খাওয়া যাবে। একটুও নষ্ট হয়নি।”
বউ শুকনো মুখে কাতরস্বরে বলল, “আমাকে বাচ্চা মেয়ে পেয়েছ? ভোলাচ্ছ? ওগুলো মিষ্টি না ঘোড়ার ডিম হয়েছে!”
আমি বললাম, “কেন মিষ্টিই হয়েছে। ঠিক গোলাপ জামও নয় আবার জিবে-গজাও নয়, মাঝামাঝি কিছু একটা তো হয়েছে। স্বাদে মিষ্টিই তো! খেয়ে নেব সব ঝেড়েঝুড়ে। আমি এই বিশেষ মিষ্টিগুলোর নামকরণ করলাম লকডাউন-মিঠাই।”
অনেকক্ষণ পরে বউ হাসল। বলল, “বলছ?
এবং তিনি যে ফর্মে ফিরেছেন তা বোঝা গেল যখন তিনি বললেন, “তা বলে একসঙ্গে সব হাঁকপাঁক করে খেয়ে নিও না। রয়েসয়ে খাবে। তোমার যা নোলা!”
আহা কান জুড়িয়ে গেল…

Previous articleশুয়ে শুয়ে বই পড়ছেন? জানেন, এটারও একটা নাম আছে?
Next articleকরোনা আক্রান্ত হয়ে রাজ্যে এই প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু