মে দিবসের ডাক: কীসের মে দিবস?

পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক

আমেরিকায় মে দিবস পালন করা হয় না। আমেরিকার লেবার ডে হয় সেপ্টেম্বর মাসে। তাছাড়া, আপনারা বলতে পারেন, করোনা ক্রাইসিসের সঙ্গে মে দিবসের সম্পর্ক কী? বলতে পারেন, এ কী হযবরল নাকি? না, এর নাম বেড়ালের তালব্য শ আর রুমালের মা নয়। করোনা ক্রান্তির সঙ্গে শ্রমিক আন্দোলনের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে। কিন্তু আজকের আমেরিকায় বিশেষ কেউ তা জানে না। আসলে, আমেরিকায় এখন বিশেষ কিছুই কেউ জানে না। একটা ইন্টেলেকচুয়াল ভ্যাকুয়ামের মধ্যে সবাই দিন কাটাচ্ছে। সেদিক থেকে দেখতে গেলে এই দেশের সঙ্গে আমাদের ভারতের বা বাংলা দেশের খুব বেশি মিল। ওই যে, সত্যজিতের জন্মদিনের কথা লিখেছিলাম, “জানার কোনো শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই।” আমার এই দুটো দেশে এখন এই মহাভারত চলছে, যেখানে এমন লোকজন রাজত্ব করছে, যাদের সঙ্গে হীরক রাজার বা হাল্লা রাজার তফাৎ বিশেষ নেই।
শুন্ডীরাজ্যে ভয়াবহ কোন অসুখে মানুষের কথা বলার শক্তি কেড়ে নিয়েছিল কোন অপদেবতা। আর হীরক রাজ্যে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র আর শিক্ষককে মগজধোলাই মেশিনের মধ্যে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর, গায়ক চরণদাসকে হাত পা বেঁধে, মুখ বন্ধ করে বনের মধ্যে গিয়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।
আমেরিকায় শ্রমিক শ্রেণীকে এই উপরের সব কিছুই করা হয়ে গেছে। তাদের কথা বলার শক্তি কেড়ে নেওয়া হয়েছে ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নিয়ে। বললে বিশ্বাস করবেন না, এই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাস মহাসঙ্কটে আজ পর্যন্ত সরকারি হিসেবেই তিন কোটি শ্রমিক বেকার। এর সঙ্গে যুক্ত করুন হিসেবের বাইরে থাকা বৈধ কাগজহীন আরো এক কোটি শ্রমিক। মেক্সিকান, ল্যাটিন আমেরিকান, চীনা, বাংলাদেশী, ভারতীয়, আফ্রিকান।
হ্যাঁ, ভারতীয় ইমিগ্রেন্টদের মধ্যেও অনেক কাগজহীন মানুষ আছেন। অবশ্য, সবজান্তা ভারতীয় ও বাঙালি ইমিগ্রেন্টরা ঠিক যেমন মৃতের সংখ্যাটাকেই ফেক বলে বাতিল করে দিচ্ছেন, ঠিক তেমনি এসব তথ্যকেও খারিজ করে দেবেন।
আমেরিকায় ১৯৪০ থেকে ১৯৮০ পর্যন্ত যাকে বলা হয় “মার্কিন পুঁজিবাদের স্বর্ণযুগ” — সেই জমানায় কিন্তু উপার্জন ও ধনবৈষম্য অনেক কম ছিল। শ্রমিক ইউনিয়ন আজকের তুলনায় অন্ততঃ চারগুণ বেশি শক্তিশালী ছিল।
আজকের মতো এই চরম অমানবিক, নিষ্ঠুর সিস্টেম তখন ছিল না।
আজকে আমেরিকায় মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে উপার্জনবৈষম্য সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। একজন গড়পড়তা শ্রমিক যা উপার্জন করে, তার কোম্পানির মালিক তার তুলনায় অন্তত ৪৫০ গুণ উপার্জন করে। ম্যাকডোনাল্ড, জেনারেল ইলেকট্রিক, মনস্যান্টো, ওয়াল মার্ট, এক্সন এই জাতীয় কোম্পানির মালিকরা আরও অনেক বেশি।
আমাদের নিউ ইয়র্ক শহরে গত তিন বছর ধরে আমাদের ইউনিয়ন স্ট্রাইক চালিয়ে যাচ্ছে স্পেকট্রাম কেবল কোম্পানির বিরুদ্ধে — স্বাস্থ্যবীমা ও অন্যান্য দাবিদাওয়ার ভিত্তিতে। স্পেক্ট্রামের সিইও টমাস রাটলেজ এক বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলার উপার্জন করেছেন। আমার ক্লাসে আমার শ্রমিক ইউনিয়ন ছাত্রছাত্রীরা হিসেব করে দেখিয়েছিল, রাটলেজ এক ঘণ্টায় যা রোজগার করেন, সেই কোম্পানির একজন সাধারণ শ্রমিককে সেই অর্থ উপার্জন করতে তিন মাস কাজ করতে হবে। কিন্তু তিনি তাঁর কোম্পানির লেবারারদের স্বাস্থ্যবীমা বা পেনশন দেবেননা কিছুতেই।
আমি পুঁজির বিরুদ্ধে নই। কিন্তু আমি এই নিষ্ঠুর, সভ্যতাবিরোধী, বর্বর, অমানবিক পুঁজিবাদের বিরোধী।
১৮৮৬ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে শিকাগো হে মার্কেটে আটঘন্টা মজুরি চালু করার দাবিতে শ্রমিকরা জমায়েত হয়, শান্তিপূর্ণ সমাবেশে পুলিশ গুলি চালায়। তারপর সেখানে বোমা পড়ে। তারপর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সাতজন শ্রমিককে বোমা ছোঁড়ার কোনো প্রমাণ ছাড়াই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই ঘটনার পর আমেরিকায় শ্রমিক শ্রেণী তীব্রভাবে সংগঠিত হয়, এবং এই স্ট্রাইককে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের জন্মতারিখ হিসেবে পালন করা শুরু হয়।
কিন্তু আমেরিকার আজকের প্রজন্ম, এমনকী তাদের বাবামায়েরাও এই ইতিহাস জানে না। আমেরিকার মিডিয়া, আমেরিকার স্কুল ও কলেজ, এবং আমেরিকার এস্টাব্লিশমেন্ট এই দিনের তাৎপর্য সম্পূর্ণ ভুলিয়ে দিয়েছে। ঠিক যেমন ভুলিয়ে দিয়েছে আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট ও নাৎজি বাহিনীকে পরাস্ত করার পিছনে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিশাল রেজিস্টেন্স ও আত্মত্যাগের ইতিহাস।
আমি বহু মার্কিন শ্রমিক পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। এরা অনেকেই যথেষ্ট শিক্ষিত এবং রাজনৈতিকভাবে উদারপন্থী। কিন্তু তারা এই ইতিহাস সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ।
মগজধোলাই করার জন্যে হীরক রাজার নির্দেশে হাত পা মুখ বেঁধে ফেলে বনের মধ্যে গর্তে ফেলে দেওয়ার দরকার হয় না আর। আমেরিকার শাসকশ্রেণী এবং তাদের মিডিয়া এমন নিঃশব্দে ও সূক্ষ্মভাবে মগজধোলাই করেছে, যাতে কয়েক প্রজন্ম ধরে মানুষকে প্রকৃত জ্ঞান এবং ইতিহাসের বিশ্লেষণ থেকে আলাদা করে রাখা হয়েছে।
এই হল নয়া উদারনৈতিক আর্থ-রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নয়া কৌশলের মগজধোলাই। আমেরিকার মিডিয়াতে মে দিবসে একটাও শ্রমিক আলোচনা নেই। করোনাভাইরাসের এই মহাসঙ্কটে কেন আমেরিকার তিন কোটি মানুষ রাতারাতি বেকার, তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই এদিন। কেন পৃথিবীর অন্য অনেক ধনী, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় মানুষের কাজ কেড়ে নেওয়া হয়নি, কিন্তু আমেরিকায় হয়েছে, সে ব্যাপারটা সিএনএন, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পোস্ট বা এনপিআর সম্পূর্ণ চেপে গেছে।
কেন দরিদ্র, স্থূলতা-, হেপাটাইটিস- বা হাঁপানি-আক্রান্ত মানুষ আমেরিকার মতো মহাধনী দেশে হাজারে হাজারে মারা যাবে, তার কোনো কারণ অনুসন্ধান আমেরিকার মিডিয়া করবে না। ভারতের মিডিয়াও তাদের নতুন আন্তর্জাতিক প্রভুর সেই নির্দেশ, সেই মডেলই অনুসরণ করবে।
আমেরিকার মিডিয়া মে দিবস জিনিষটা যে কী, তা কখনো তাদের ক্রেতাদের জানাবে না। মানুষ মনে করবে, মে দিবস একটা কমিউনিস্ট ও জঙ্গি ব্যাপার। শিকাগো হে স্কোয়ারে যে ঘটনা ঘটেছিলো, তার জন্যে আমার শ্রমিক ইউনিয়নের ছাত্রছাত্রীরাই ১৮৮৬’র শ্রমিক স্ট্রাইককেই দায়ী করবে।
আজকের আমেরিকায় কেউ জিজ্ঞেস করবে না, কেন তিন কোটি মানুষের কাজ চলে যাবার দিনেই আমেরিকার স্টক মার্কেট ১৯৮৭ সালের পর থেকে সবচেয়ে উঁচু লাফ দেবে। মালিকরা পার্টি দেবে এই দিনেই।
কেউ জানে না। জানার ইচ্ছেও কারুর আর নেই। রাটলেজ এবং তার এক বছরে একশো মিলিয়ন ডলার উপার্জন, এবং তিন বছর ধরে লাগাতার রাস্তায় নেমে লড়াই করে যাওয়া আমাদের ইউনিয়নের ১৮০০ পরিবার আজ এই মে দিবসে আর একটা হতাশাগ্রস্ত দিন কাটাবে।
করোনাভাইরাস পৃথিবীর যেসব দেশ একেবারে আটকে রাখতে পেরেছে, সেসব দেশে মে দিবসে শ্রমিকরা আবার রাস্তায় নেমে লড়াই করবে অধিকার ও উপার্জন রক্ষার দাবিতে।
কিন্তু আমেরিকার মানুষ জানতেই পারবে না, কিউবা, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, জার্মানি, রাশিয়া, জাপান বা ফিনল্যান্ডের কথা।

Previous articleরেশনে কম, রণক্ষেত্র লালগোলা, পালাল পুলিশ!
Next articleসত‍্যজিৎ শতবর্ষে মমতার শুভেচ্ছা, নেট দুনিয়ায় হট কেক