মারণঝড়ের সময় রাস্তায় কিছুক্ষণ

বিশ্বজিৎ সেনগুপ্ত

কয়েকদিন আগে পুরোনো কলকাতা গল্পে 1978র বন্যানিয়ে লিখেছিলাম। ভাবতে পারিনি দু দিন বাদেই সেই স্মৃতি বাস্তব হয়ে ফিরে আসবে। কেউ ফেবুতে বলছিল আমফান লিচুফান হয়ে মজফরপুর চলে যাবে। কিন্তু সে আজ বুঝিয়ে দিয়ে গেল যে সে কত ভয়ঙ্কর। বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় সিটি কলেজের পিছনে গিয়েছিলাম রুটি আনতে রোজের মতো। প্রথমেই বাধা। রাজাবাজার সাইন্স কলেজ বাসস্ট্যান্ডের পাশে একটি বিশাল মহীরুহ ভেঙে পড়ে আছে মাটি থেকে উপরে। ট্রামলাইনের রেলিং ভেঙে রাস্তার অন্য পার পর্যন্ত প্রসারিত। দেওয়াল চেপে কোনক্রমে বাসস্ট্যান্ডের পাস দিয়ে মেন রোডে পড়লাম। সামনের দিকে এগোতে প্রবল বাধা হাওয়ার। ক্রমে বিদ্যাসাগর স্ট্রিট ধরে এগিয়ে জয়ের সময় রাস্তায় হাটু জল। Amherst st থানার পাশে একটি বড় গাছ ভেঙে পড়ে আছে । প্রবল হাওয়া সঙ্গে এলোপাথাড়ি বৃষ্টি। একই রাস্তা দিয়ে ফিরছি এবার দেখি সার্কুলার রোডে আরও দুটো গাছ ভেঙে পড়ল। বাড়ি ফিরে আবার সাড়ে সাতটা নাগাদ বের হলাম খাবার দিতে। প্রথমে ফেডারেশন হলে বিমলবাবু। হাওয়ার বেগ এত, আর এতজল জমে যে ফেডারেশন স্ট্রিটে ঢোকা যাচ্ছে না। তারমধ্যে একটা গাছ আড়াআড়ি ভাবে ভেঙে পড়ে আছে স্টেট ব্যাংকের সামনে থেকে ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালযের উপর। সাইকেল রাস্তার মুখে রেখে হাটু জল ঠেঙিয়ে টিফিন কৌটো দিয়ে এগোতে লাগলাম। গড়পার রোডে ধোকা গেল না মুখেই একটা গাছের বিরাট ডাল ভেঙে পড়ে আছে। এবার রামমোহন রায় রোড। মুখেই একটা গাছের বিরাট দল ভেঙে আছে। পাশ দিয়ে ঢুকলাম। এখানেও হাঁটু জল। রামমোহন রায় রোড দিয়ে দিনেন্দ্র স্ট্রিটে ঢুকতেই প্রবল হাওয়ার বেগ। সঙ্গে অল্প জল জমা। 35 এক্সচেঞ্জের সামনে গাছ ভেঙে আছে। কিছুটা এগিয়ে যুগীপাড়া রোড। এতটাই হাওয়ার বেগ আর জল জমা যে সাইকেল সোজা রাখা যাচ্ছে না। হেঁটে হেঁটে খাবার দিয়ে উল্টোদিকে নিউ কলোনী। একে অন্ধকার তাতে জল জমা। এখানেও হেঁটে হেঁটে ঢুকতে হল। ফেরার পথে দিনেন্দ্র স্ট্রিটে পড়তেই অন্ধকার। জে এন রায় হাসপাতালের সামনে সাউন্ড প্রুফ জেনারেটর চলছে। কিছুটা এগিয়ে রামমোহন রায় রোড ছাড়াতেই রাস্তা বন্ধ। শ্রী বিদ্যমন্দির স্কুলের সামনে থেকে পরপর চারটে গাছ পরে আছে একটার সাথে ল্যাম্পপোস্টের আলো ভেঙে রাস্তার মাঝে জ্বলছে। লজন চিৎকার করল ফুট দিয়ে আস্তে আস্তে যান রাস্তায় তার চিরে কারেন্ট হয়ে আছে। ফুটপাত ঘেঁষে চলার সময় উপরে পড়া গাছগুলোর শিকড় চোখে মুখে লাগছে। এবার গড়পার পাঁচ মাথার মোড়ে একটা গাছ ভেঙে পড়ে আছে। সন্তর্পনে ফুটপাথ দিয়ে জলের মধ্যে রাস্তায় নামছি সোনার তরী ক্লাবের সামনে পিছনে সাবধান বাণী অন্ধকারের মধ্যে, বিশ্বাজিৎদা দেখে যাবেন। অন্ধকারে মুখ দেখতে পেলাম না। মনে হল যেন তারক। কে তারক নাকি? হ্যাঁ। এবার গন্তব্য বিপ্রদাস স্ট্রিট। এখানে জল নেই তবে প্রবল হাওয়ার ধাক্কা। এবার ফিরতি পথে গড়পাড় রোড ধরে এগিয়ে চলা। একটি গাছ ভেঙে বাঁ দিকে থেকে মার্লিন আবাসনের পাঁচিলের উপর পড়ে আছে। তোলা দিয়ে গলে গেলাম। কিন্তু নামতেই হল সাইকেল থেকে। পার্শিবাগান পোস্ট অফিসের সামনে একটা গাছ ভেঙে ডান ফুটপাথে পরে আছে। রাস্তায় জল জমে আছে, সাবধানে সাইকেল চালাতে হচ্ছে, আবার 96 গড়পর রোডের সামনে বড় গাছ ভেঙে পড়েছে। এবার সাইকেল থেকে নেমে আস্তে আস্তে সার্কুলার রোদে এলাম। ক্যাপিটল নার্সিং হোমের সামনে যত গাড়ি থাকে সব ট্রাম লাইনের ট্রাকে এনে রেখেছে। না হলে গাছ পরে চেপ্টে যাবে। 100 সার্কুলার রোডের সামনে দুটি গাছ জড়ামরি হয়ে পড়ে আছে তলায় একটা গাড়ি আর দুটো ল্যাম্পপোস্ট। আলোটা তখনও জ্বলছে। এবার এগিয়ে গেলাম সুকিয়া স্ট্রিটের দিকে। রাস্তা পার হয়ে ঢুকলাম। 30 গজ এগিয়ে বাজারের গেটের সামনে সাইকেলের সিটটা ডুবে গেল। না আর রিস্ক নেওয়া ঠিক হবে না। এবার বাড়ি ফিরে চল। আবার ফিরতি পথে অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে রাজাবাজার মোড়। কত যে ডালপালা পরে আছে। গলির মুখে হাঁটুর ওপরে জল। রাস্তার মুখের বাড়িগুলিতে জল ঢুকেছে। যেতে বাড়ি এলাম। বাড়িতে এসে দেখি উঠোনে জল উঠেছে। ডেটল দিয়ে গরম জলে স্নান করলাম। আমফানের কীর্তি শহরময় ছড়িয়ে আছে। নিজের চোখে যা দেখলাম এ জীবনে ভুলব না।

 

Previous articleএবার থেকে পড়ুয়ারা একইসঙ্গে দুটি ডিগ্রি কোর্স করার সুযোগ পাবে
Next articleকাল মুখ্যমন্ত্রীর দক্ষিণ ২৪পরগণা সফর অপরিবর্তিত