রবীন্দ্রনাথ, বিধান রায় আর একটা জন্মাইতে পারে, মনোহর আইচ নয়!

দেবদত্ত বিশ্বাস, হংকং

‘রবীন্দ্রনাথ , বিধান রায় আর একটা জন্মাইতে পারে, কিন্তু মনোহর আইচ আর জন্মাইবো না’ । লোকটা বলেকি ? পাগল নাকি ! রাত তখন সাড়ে দশটা হবে। রাঁচির অশোকা হোটেলের ৩১২ নম্বর ঘরে আমি, নন্দু, চন্দন ( ওঁর সহচর ) , আর তিনি, অর্থাৎ ৮৪ বছরের ( তখন ওঁর বয়স ৮৪ ) বিশ্বশ্রী মনোহর আইচ। আজই সন্ধ্যায় ওঁর ‘অনারে’ রাঁচি শহরের বিশিষ্ঠদের সমাবেশে চৌধুরী স্যারের ব্যবস্হাপনায় হোটেলের পক্ষ থেকে একটা সংবর্ধনা আর ওঁর দেহসৌষ্ঠব প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। নিজের বাজানো বাংলার ঢাকের রেকর্ড করা ক্যাসেট চালিয়ে, লাল ল্যাঙ্গোট পরে , বলে বলে শরীরের প্রতিটা পেশী ঢাকের বাজনার তালে তালে তরঙ্গ তুলে দেখালেন চার ফুট এগারো ইঞ্চির ‘পকেট হারকিউলিস ‘, ৮৪ বছরের তরুন, বিতর্কিত , মেজাজি , ১৯৫২ সালের ‘বিশ্বশ্রী’ মনোহর আইচ।

আমি ভাবছি শরীরের ওপর যার এতো কন্ট্রোল দেখলাম এই সন্ধ্যেবেলায়, মন বা কথার ওপর তার কোনো কন্ট্রোল নেই কেনো এখন এই রাত সাড়েদশটায় ? দিব্যি চিড়ে দ্ই খেতে খেতে বলে চল্লেন – ‘বিধান রায় বড় ডাক্তার আসিলো, আমার বয়সে আইস্যা ও ডাক্তারী করতে পারতো না, আর রবীন্দ্রনাথ , রুগী হইয়া ৮২ বসর বাচ্ছিল, আমার বয়সে আইলে মাথার ঠি ক থাকতো না, আলফাল লিখতো’। সত্যি বলছি এ বক্তব্য বোঝার বয়স , ধৈর্য্য বা ম্যাচিওরিটি তখন আমার ছিলনা। ওটাকে গড়পরতা বাংগালীর বুড়ো বয়সের ভীমরতিই ধরে নিয়েছিলাম। ‘জেঠু , শুয়ে পরুন, অনেক রাত হয়েছে , কাল আবার কলকাতার ট্রেন ধরতে হবে’ বলে পাশ কাটানোর চেষ্ঠা করলাম। ‘ আরে সুভাষ চক্কোত্তি জোর কইরা ……. , বিজেপি থিকা আইলো …….‘ – আরও ঘন্টা খানেক সহ্য করে আমি আর নন্দু নিজের ঘরে ফিরে এলাম।

পরের দিন হাতিয়া এক্সপ্রেস ধরে সারারাত জার্নিকরে হাওড়া ফিরলাম। বাক্স প্যাটরা নিয়ে স্টেশনে নামতেই দেখি শার্প সবুজ রংএর হাতকাটা জামা, আর টুপি পরে চন্দনকে পিছনে রেখে হাওড়া স্টেশনের ভিড়ের আগে আগে গট গট করে হেঁটে এগিয়ে চলেছেন বিশ্বশ্রী। এতো সত্যজিতের ‘নায়ক’। ‘জেঠু বাই বাই’ বলার দুঃসাহসও হলোনা ঐ থুতনি উচুকরে হাজার মানুষের মধ্যে হেঁটে যাওয়া মানুষটাকে, যিনি নিজের গর্বে অন্তর থেকে গর্বিত, আস্থাশীল। তিনি যেনো বাঙালি, কিন্তু আম বাঙালি নন, ভেতো , কিন্তু ভেতো বাঙালি নন। সত্যিইতো বেঁচে থাকলে যে বয়সে মানুষ অপরের তুলে দেওয়া চামচে ওষুধ খায় , সেখানে তিনি ট্রাপিজিয়াস, ল্যাটিসিমাস আর গ্যাস্ট্রোকনিমিয়াস বলে বলে ঢাকের তালে নাচিয়ে দেখাচ্ছেন, এটাই তো ওঁর ‘গীতাঞ্জলি’।

আজ বিশ্বশ্রী মনোহর আইচের ১০৮ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রণাম জানাই !

Previous articleমন্দিরে করোনা-বিধি কেন্দ্রের: বন্ধ প্রসাদ, চরণামৃত বিলি, হবে না প্রার্থনাসঙ্গীতও
Next articleBREAKING: সাতসকালে কলেজ স্ট্রিটে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল দোতলা বাড়ি, জখম বেশ কয়েকজন