গালওয়ান : Servant Of Sahibs, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

গালওয়ান৷

একটি উপনদীর নাম৷ চিনের জিন জিয়াং ও ভারতের জম্মু- কাশ্মীর রাজ্যের ওপর দিয়ে প্রবাহিত শিয়ক (Shyok) নদীর ৪টি উপনদীর একটি এই গালওয়ান৷ বাকি ৩টি হলো, চাং চেন মো, সালতোরো এবং নুব্রা৷ মরুভূমি বললেই একটা ছবি ভেসে ওঠে৷ লাদাখের সঙ্গে সেই ছবির একেবারেই মিল নেই৷ এই মরুভূমির অন্য রূপ। হিমালয়ের মরুভূমি। ধূসর, রুক্ষ আর তুষারমোড়া শৃঙ্গ দিয়ে ঘেরা লাদাখের পাথুরে পটভূমিতে বয়ে চলেছে গালওয়ান৷ ১৫ জুন ভারতীয় সেনার রক্তে লাল হওয়ার পর পূর্ব লাদাখের গালওয়ান নদী বা উপনদী এবং উপত্যকা এখন প্রায় সবার কাছেই খুব পরিচিত৷

কাশ্মীরের নিজস্ব ভাষায় ‘গালওয়ান’ শব্দের অর্থ হল ডাকাত। একটা নদীর নাম ‘ডাকাত’ ? কেন হলো এমন বিচিত্র নাম ? ওই ‘ডাকাতিয়া’ নদী আর উপত্যকা নিয়ে ইতিহাস’ই বা কী বলছে ?

ঠিকই, গালওয়ানের একটা ইতিহাস আছে৷ আছে নামকরণের ইতিহাসও৷ দারুণ গল্প৷

লাদাখের রাজধানী লেহ-তে, সম্ভবত ১৮৭৮ সাল নাগাদ জন্ম নেওয়া গুলাম রসুল-কে খুব কষ্ট করে বড় করে তুলছিলেন তাঁর বিধবা মা৷ কিন্তু চরম দারিদ্রের সঙ্গে বেশিদিন লড়াই চালাতে পারছিলেন না রসুলের মা৷ ফলে বাধ্য হয়ে মাত্র ১২-১৩ বছর বয়সেই কাজের খোঁজে বেরিয়ে পড়েন গুলাম৷ পাহাড়ে বড় হওয়া গুলাম ওই বয়সেই হাতের তালুর মতো চিনতেন মধ্য এশিয়ার পাহাড়, বিশেষ করে কারাকোরাম রেঞ্জের পাহাড়ি পথের গলি-ঘুঁজি৷ জুড়ে যান তিব্বতে আসা ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় অভিযাত্রীদের সঙ্গে৷
গাইড হিসেবে নানা অভিযানে সামিল হতে শুরু করেন গুলাম৷
মাত্র ১২ বছর বয়সে স্যার ফ্রান্সিস ইয়ংহাসব্যান্ডের নেতৃত্বে পাহাড়ে আসা অভিযাত্রী দলের পোর্টার বা মালবাহক হিসেবে গোলামের অভিযানের শুরু হয়।

এবার একটু পিছনের দিকে যাওয়া যাক৷ আগেই বলা হয়েছে, কাশ্মীরি ভাষায় ‘গালওয়ান’ শব্দের অর্থ হল ডাকাত। গুলাম রসুলের পিতামহ ছিলেন উনিশ শতকের কাশ্মীরের হাড় কাঁপানো দুর্ধর্ষ এক দস্যু৷ নাম ছিলো কারা গালওয়ান৷ গল্প আছে, চতুর্দশ শতকের শেষ থেকে পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত নটিংহ্যামশায়ারের শেরউড জঙ্গল শাসন করতেন গরীবদের ‘ঈশ্বর’, রবিনহুড। কথিত আছে, ধনীদের সম্পত্তি লুঠ করে এনে তিনি নাকি বিলিয়ে দিতেন গরীবদের মধ্যে।
ঠিক সেভাবেই কাশ্মীরের বৈভবশালীদের সম্পদ লুঠ করে গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়ার জন্য কারা গালওয়ানের খ্যাতি ছিল রবিনহুডের মতোই। পাহাড়ের বাসিন্দাদের মুখে আজও ঘোরে এক জনশ্রুতি, কারা গালওয়ান একবার নাকি
কাশ্মীরের মহারাজার শোওয়ার ঘরে পর্যন্ত ঢুকে পড়ে মহারাজার গলায় ছুরি ধরে প্রচুর ধনসম্পত্তি লুঠ করেছিলেন৷কিন্তু পরে রাজার সৈন্যদের পাতা ফাঁদে ধরা পড়ে যান কারা গালওয়ান, ফাঁসি হয় তাঁর৷ আর রাজার আদেশে তাঁর পরিবারের সদস্যরা লাদাখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন৷ কিন্তু ততদিনে কারা-র নামের সঙ্গে স্থায়ীভাবে যুক্ত হয়ে যায় ‘গালওয়ান’ বা ডাকাত শব্দটি। তাঁর পরিবারের নামের সঙ্গেও পাকাপাকিভাবে সেঁটে যায় ওই ‘গালওয়ান’৷

ওদিকে, কখনও গাইড, কখনও পোর্টার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছিলেন গোলাম রসুল৷ পিতামহের সূত্রে গোলামের নামের সঙ্গেও তখন জুড়ে ছিলো ‘গালওয়ান’ শব্দটি৷ বিদেশিরা তাঁকে চিনতো গোলাম রসুল গালওয়ান নামেই৷

 

এভাবেই কেটে গেলো ২ বছর৷ গোলামের বয়স তখন ১৪ বছর৷
ব্রিটিশ এবং ইউরোপীয় অভিযাত্রীরা তখন হামেশাই তিব্বত, ইয়ারকান্ড (এখন নাম বদলে হয়েছে চিনের শিনজিয়াং- এর উইঘুর স্বশাসিত এলাকা), কারাকোরাম, পামির মালভূমি, মধ্য এশিয়ায় অভিযান করছে৷ কিশোর গুলাম রসুলও থাকতেন তাদের সঙ্গে।

আমাদের এই গোলাম রসুল গালওয়ান-এর জীবনের মোড় ঘুরে যায় ১৮৯২ সালে৷

সে সময় তিব্বতের দিকে রাশিয়ার সম্প্রসারণ নিয়ে ব্রিটিশরা খুবই
চিন্তিত ছিলো৷ দফায় দফায়
ব্রিটিশ কোনও সেনাকর্তা সেনাবাহিনী নিয়ে এই এলাকা পর্যবেক্ষণ করতে আসতেন৷ সে বছর চার্লস মারে বা সপ্তম আর্ল অব ডানমোর দলবল নিয়ে এলেন
রাশিয়ান অনুপ্রবেশ সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করতে৷ আর এই চার্লস মারে বা সপ্তম আর্ল অব ডানমোর-এর সঙ্গে পামির ও কাসগর পর্বতের দিকে ওই অভিযানে গিয়েই ইতিহাস তৈরি করেন গোলাম রসুল৷
ঐতিহাসিক আবদুল গণি শেখ এ প্রসঙ্গে লিখেছেন, “ওই দলটি লাদাখের এক দুর্গম অঞ্চলের সুউচ্চ পর্বতমালা আর খাড়াই গিরিখাতের মাঝখানে আটকে যায়৷ সেখান থেকে বেরিয়ে আসার কোনও পথই খুঁজে পাচ্ছিলেন না আর্ল অব ডানমোর৷ ওদিকে আবহাওয়া খারাপ হয়ে যাচ্ছে, ব্রিটিশ ওই দলের বেঁচে থাকাই ক্রমশ কঠিন হয়ে উঠছিলো৷ মৃত্যু তাদের চোখের সামনে যেন দাঁড়িয়ে৷
মাত্র ১৪ বছরের গুলাম রসুল অভিযাত্রীদের আশ্বাস দিয়ে একা বেরিয়ে পড়েন সেই গোলকধাঁধা থেকে বাইরে আসার পথ খুঁজতে৷
খাদের ভেতর দিয়ে সে একটা বেশ সহজ রাস্তা ঠিক খুঁজেও বের করে ফেলে৷ ফিরে গিয়ে সেই পথেই লর্ড ডানমোরের দলকে বার করে আনেন৷ গুলাম রসুলের
অসামান্য সাহস আর বুদ্ধির জোরে শেষপর্যন্ত কোনও ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই অভিযাত্রীরা ফিরে আসতে পেরেছিল।”

ব্রিটিশ অভিযাত্রী দলের নেতা লর্ড ডানমোর ১৪ বছরের কিশোর গুলাম রসুলের এই সাহস এবং বুদ্ধিতে এতটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি বয়ে যাওয়া জলধারা’র পাশ ঘেঁষে যে নতুন রাস্তার সন্ধান মেলে তার নামকরণ করে ফেলেন ‘গালওয়ান নালা’। সেই থেকেই গুলাম রসুল গালওয়ান লাদাখের শুধু ইতিহাস নয়, ভূগোলেরও অংশ হয়ে গেলেন।’ হিমালয়ান জার্নাল’- এর দীর্ঘদিনের সম্পাদক হরিশ কাপাদিয়ার কথায়, “ইতিহাস বলছে, সেই সময়ে ব্রিটিশ অভিযাত্রীদের নামে নামকরণ করাটাই ছিল রীতি৷ এভাবেই পাহাড়ি এলাকার অসংখ্য নামকরণ হয়েছে৷ কিন্তু
লাদাখেরই এক কিংবদন্তী পর্বতারোহী ও অভিযাত্রী গুলাম রসুল গালওয়ানের নামে ‘গালওয়ান উপত্যকা’-র নাম দেওয়া বেনজির৷ আর কোথাও কোনও নেটিভের কপালে এই সম্মান জুটেছে বলে জানা নেই।”

সামান্য এক মালবাহক, টাট্টু ঘোড়ার চালক, গাইড থেকে গুলাম রসুল গালওয়ান একদিন লেহ-তে নিযুক্ত ব্রিটিশ জয়েন্ট কমিশনারের প্রধান সহকারি-র পদও পেয়েছিলেন। যখন-তখন অভিযানে বেরিয়ে পড়া ছিল তাঁর নেশা৷ অর্থকষ্ট একদিন মিটে যাওয়ার পরও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি যে কত অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন বা পথপ্রদর্শন করেছেন তার কোনও হিসেব নেই। ফ্রস্টবাইটে তাঁর হাত ও পায়ের অনেকগুলো আঙুল পর্যন্ত খোয়াতে হয়েছিলো, কিন্তু গালওয়ান উপত্যকার নামকরণের মধ্যে দিয়ে গুলাম রসুল গালওয়ান-এর স্মৃতি আজও অটুট, অমলিন৷

গল্পটা আরও একটু আছে৷ লেখা অনেকটা বড় হয়ে গেলেও এই গল্প না বললে, একদমই অসম্পূর্ণ থাকবে গালওয়ানের কাহিনী৷

এই কাহিনী ‘সার্ভেন্ট অব সাহিবস’ এর সৃষ্টি নিয়ে৷ বেশিদিন বাঁচেননি গুলাম রসুল গালওয়ান৷ মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি মারা যান৷ তার আগেই নজির গড়লেন আরও এক ইতিহাস তৈরি করে৷

নানা অভিযানের ফাঁকে লেখার একটা অভ্যাস ছিলো গুলামের৷
একটা সময় ছিলো যখন একটা বর্ণ ইংরেজিও জানতেন না গুলাম৷ ইংরেজি না-জেনেও গুলাম রসুল গালওয়ান কিন্তু ইংরেজিতে লিখে ফেলেছিলেন নিজের আত্মজীবনী, ‘সার্ভেন্ট অব সাহিবস’ বা ‘সাহেবদের ভৃত্য’। কীভাবে তিনি ইংরেজিতে নিজের স্মৃতিকথা লিখলেন, তারও এক মজার ইতিহাস আছে।

গুলাম রসুল গালওয়ান লাদাখি, উর্দু আর তুর্কি ভাষায় দক্ষ ছিলেন৷ টুকটাক কাজ চালানোর মতো তিব্বতি আর কাশ্মীরিও জানতেন। কিন্তু সাহেবদের সঙ্গে বছরের পর বছর কাটিয়েও
ইংরেজি শেখা তাঁর হয়নি৷ একবার মার্কিন অ্যাডভেঞ্চারিস্ট রবার্ট ব্যারেটের সঙ্গে অভিযানে বেরিয়েছিলেন গুলাম৷ সেই অভিযানেই তাঁর ইংরেজি চর্চার হাতেখড়ি হয়৷ রবার্ট ব্যারেটের স্ত্রী ক্যাথরিনই গুলাম রসুল গালওয়ান ওই পৃথিবীবিখ্যাত আত্মজীবনীর সম্পাদনা করেছেন টিনা ১০ বছর ধরে। ক্যাথরিন ব্যারেট পরে বলেছিলেন, “আমার স্বামীর সঙ্গে গুলাম রসুল গালওয়ানের যখন প্রথম দেখা হয়, তখন গুলাম খুব বেশি হলে ১০-১২টা ইংরেজি শব্দ জানতেন। কিন্তু তখনই লক্ষ্য করেছি, গুলামের ইংরেজি শেখা ও লেখার ইচ্ছা ছিল বিস্ময়কর”৷ ক্যাথরিন বলেছেন, “গুলামের সঙ্গে রবার্ট সব সময় ভেঙ্গে ভেঙ্গে, আস্তে আস্তে ইংরেজিতে কথা বলতেন, যাতে গুলাম শব্দগুলো বুঝতে পারে, শিখতে পারে। রবার্ট ওকে পড়ার জন্য একটা কিং জেমসের বাইবেল আর সপ্তদশ শতাব্দীর ট্র্যাভেলগ’ও দিয়েছিলো।”
এর পরেই ক্যাথরিন আসল কথা বলেন, “গুলাম রসুল টানা ১০ বছর ধরে নিজের জানা ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আত্মজীবনীর নোট লিখতেন৷ আর তারপর সেগুলো পোস্ট করে আমার কাছে আমেরিকায় পাঠিয়ে দিতেন। প্রথম প্রথম শুদ্ধ করা পান্ডুলিপি ফের লেখার জন্য গুলামের পাঠিয়ে দিতাম, যাতে ও শিখতে পারে৷ কিন্তু পরে আর পাঠানোর দরকার হতো না৷ গোটা বইয়ে গুলামের নিজের লেখার স্টাইলটাই বজায় রাখা হয়েছে৷”

অবশেষে ১৯২৩ সালে কেম্ব্রিজের বিখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা, ডব্লু হেফার অ্যান্ড সন্স থেকে প্রকাশিত হয় গুলাম রসুল গালওয়ানের ওই পৃথিবীবিখ্যাত আত্মজীবনী, ‘সার্ভেন্ট অব সাহিবস- আ বুক টু রিড অ্যালাউড’।

এই হলো লাদাখের গালওয়ান নদী, গালওয়ান উপত্যকা আর গুলাম রসুল গালওয়ানের গল্প৷

ঠিক গল্প নয়, এ সব গালওয়ানের ইতিহাস আর ভূগোলের কথা৷

আর একটা কথা, গুলাম রসুল গালওয়ানের বংশধর এখনও আছেন৷ রসুলের নাতি মোহাম্মদ আমিন গালওয়ান এখন সপরিবারে লাদাখে বাস করেন৷ তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন গালওয়ান ভারতের অংশ৷ চিন বারবার এই উপত্যকার দখল নিতে চাইছে৷ সেদিন ২০ ভারতীয় সেনার শহিদ হওয়ার ঘটনায় চোখের জলও ফেলেছেন৷

আর এক বংশধর এখন থাকেন দিল্লিতে৷ দিল্লির ‘দ্য ইকোনমিক টাইমস’-এর সাংবাদিক, নাম রসুল বাইলে৷ পারিবারিক সম্পর্কে
গুলাম রসুল গালওয়ান এই রসুল বাইলে-র প্রপিতামহ।

Previous articleপ্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় সেনাকে ব্যঙ্গ করার অভিযোগে গ্রেফতার কাউন্সিলর
Next articleট্রাফিক পরিকাঠামো উন্নত করতে ২৫৭৭ কর্মী নিয়োগের সিদ্ধান্ত রাজ্যের