Global Times বোঝাচ্ছে, চিনের আস্তিনে তাস ঢোকানো, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

কোনও দেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিচ্ছে সেই প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় !

এমন দুর্ভাগ্যজনক, অবমাননাকর নজির এর আগে ঠিক কোন দেশে তৈরি হয়েছে, তা শত ভেবেও মনে আনা কঠিন৷ সেই কাজটাই বেশ সাবলীলভাবেই হলো ভারতে৷

গত শুক্রবারের সর্বদল বৈঠকের একেবারে শেষভাগে এসে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, “না আমাদের ভূখণ্ডে কেউ ঢুকেছে, না কেউ আমাদের জমি দখল করে আছে। আমাদের কোনও সেনা-চৌকিও কোনও দেশ দখল করেনি।” লাল ফৌজের হাতে দেশের ২০ জন জওয়ানের শহিদ হওয়ার পর যখন গোটা দেশ ক্ষোভে ফুঁসছে, তখন মোদির এমন মন্তব্যে আলোড়ন পড়ে যায়। বিরোধী নেতা থেকে সামরিক বিশেষজ্ঞ, অনেকেই প্রশ্ন তোলেন৷ কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ওই বক্তব্যকে হাতিয়ার করে আরও বড় খেলা খেলতে নেমেছে চিন৷

একদিকে মোদির মন্তব্যকে লুফে নিয়ে দীর্ঘ বিবৃতিতে চিনের বিদেশ মন্ত্রক জানায়, “গলওয়ান উপত্যকা চিনেরই অংশ। ঠিকই, চিনা সেনা নিজেদের এলাকাতেই ছিল।”
আর অন্যদিকে চিনের সরকারি মুখপত্র ‘Global Times’ সাহস কয়েকগুণ বাড়িয়ে সরাসরি ভারতকে, ভারতবাসীকে হুমকি দেওয়ার কাজ শুরু করে দিয়েছে৷ এবং একইসঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সেদিনের ওই বিতর্কিত বক্তব্যকে ব্যবহার করে এবং উল্লেখ করে দুষেছে ভারতবাসীকেই ৷ মঙ্গলবার, ২২ জুন, ‘Global Times’-এর সম্পাদকীয়তে রাখঢাক না করেই বলা হয়েছে, “After the June 15 clash, the Indian government showed rationality to prevent the situation from escalating. Indian Prime Minister Narendra Modi said,”Nobody has intruded into our border, neither is anybody there now, nor have our posts been captured.” But India’s extreme nationalists continue to put pressure on their government, risking an escalation of tensions at the border.” এর অর্থ, “১৫ জুনের সংঘর্ষের পর, ভারত সরকার পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা থেকে বিরত রাখার যৌক্তিকতা দেখায়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, “না আমাদের ভূখণ্ডে কেউ ঢুকেছে, না কেউ আমাদের জমি দখল করে আছে। আমাদের কোনও সেনা-চৌকিও কোনও দেশ দখল করেনি।”কিন্তু ভারতের চরমপন্থী জাতীয়তাবাদীরা সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি করার ঝুঁকি নিয়ে তাদের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে।”
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সেদিন এতখানি বিতর্কিত না হলে, চিন সরকারের মুখপত্র এভাবে মোদিজির কথা নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারতো কি ?

আরও একাধিক হুমকি আছে ওই সম্পাদকীয়তে৷ কিছু কথা তো এমনও আছে, যা দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক বিনষ্ট করার পক্ষে যথেষ্ট৷ একদিকে সীমান্তে শান্তির আবহ ফেরাতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা, ভারতীয় সেনা অফিসারদের সঙ্গে আলোচনা, আর অন্যদিকে চিন সরকারের মুখপত্র ‘Global Times’ সরাসরি লালফৌজকে উসকানি দিচ্ছে, “We also urge the People’s Liberation Army, PLA to prepare for the worst-case scenario. If the Indian army launches a border war, it must be taught a good lesson. We believe the PLA has sufficient capability to do so.” আমরা পিএলএ-কে অনুরোধ করছি, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকতে। যদি ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত যুদ্ধ শুরু করে, তাহলে তাদের অবশ্যই ভালো শিক্ষা দিতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি পিএলএ-র যথেষ্ট ক্ষমতা আছে।
দেখা যাক চিনের সরকারি মুখপত্র ঠিক কিভাবে দু’দেশের সম্পর্ক ধ্বংস করার প্ররোচনা দিয়ে চলেছে৷ চিনের সরকারি সংবাদমাধ্যমের এই উসকানি, ওদেশের কমিউনিস্ট সরকারের সবুজ সংকেত ছাড়াই হচ্ছে, কোনও উন্মাদও তা বিশ্বাস করবে না৷

২২ জুনের Global Times বলছে,

১) চিন চায় না ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হোক৷ কিন্তু কিছু চরমপন্থী ভারতীয় যৌক্তিকতা হারিয়েছে। চিনা সেনাবাহিনী দেখাবে পাল্টা লড়াই করতে তারা কতখানি তৈরি৷

২) ভারতের তরফে গুলি চালানো হলে, সীমান্তে থাকা ভারতীয় অফিসারদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে, যে প্রথম গুলি চালাবে তাঁকে PLA মুছে দেবে।

৩) ইতিহাস বলছে, অতীতে ভারত বেশ কয়েকবার চিনের ক্ষমতা বিচার করতে ভুল করেছে৷ উভয় পক্ষের শক্তির ফারাক স্বীকার না করার খেসারত দিয়েছে৷ এই হঠকারিতার মূল্য দিতে হয়েছে। ১৫ জুনের সংঘর্ষের ক্ষেত্রেও কি একই কথা সত্যি হয়নি?

৪) আশা করা হচ্ছে, ভারত ঐতিহাসিক ভুলের পুনরাবৃত্তি করবে না৷ চিনের সঙ্গে সীমান্ত বিতর্কে ভারত আক্রমণাত্মক অবস্থান এড়িয়ে চলবে। দু’পক্ষের মধ্যে শান্তি বজায় রাখতে চিন যে পথে হাঁটছে, ভারতেরও উচিত সেই একই দিকে যাওয়া৷

৫) আসলে, সেনাবাহিনীকে ‘সম্পূর্ণ কাজের স্বাধীনতা’ দেওয়ার যে ঘোষণা মোদি সরকার করেছে, তা আসলে ভারতীয় সেনা এবং ভারতের নাগরিকদের তুষ্ট করতে চাওয়ার লক্ষ্যেই৷ এ ধরনের বক্তব্য দায়িত্বজ্ঞানহীন। ভারত এ সব বলে প্রমান করতে চাইছে, তারা দু’দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চুক্তি আর মানতে চাইছে না৷ এর ফলে দু দেশের সেনাদের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে এবং অবাঞ্ছিত সামরিক সংঘাতের সম্ভাবনা আরও বাড়িয়ে তুলবে।

৬) জাতীয়তাবাদী জ্বরে আক্রান্ত ভারতীয়দের সতর্ক করতে চাই নয়াদিল্লিকে ভুল পথে না নিয়ে গিয়ে ভারতকে অতীতের ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে দেবেন না।

৭) তাদের অবশ্যই জানতে হবে যে ১৯৬২ সালে দুই দেশ প্রায় সমান শক্তির ছিল৷ কিন্তু আজ চিনের জিডিপি ভারতের তুলনায় ৫ গুণ বেশি এবং দুনিয়ার হিসেব অনুযায়ী চিনের প্রতিরক্ষা ব্যয় ভারতের তুলনায় তিনগুণ বেশি।

৮) আমরা চিন-ভারত সীমান্তে মোতায়েন PLA সেনাদের বলতে চাই, কর্তব্য পালনের সময় তাদের অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে হবে৷ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। যদি ভারতীয় সেনা গুলি চালায়, PLA সেনাদের নিশ্চিত করতে হবে যে তাদেরও পাল্টা যুদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট অস্ত্র আছে।

৯) চিন এবং ভারত ১৯৯৬ এবং ২০০৫ সালে দুটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷ সেখানে দু’পক্ষই বলেছে, উভয়পক্ষ অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে তার সামরিক শক্তি ব্যবহার করবে না। এ ধরনের চুক্তির উদ্দেশ্য, সীমান্ত এলাকায় সংঘর্ষের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা৷ আর সে কারনেই গত ১৫ জুনের সংঘর্ষে ওই চুক্তি মেনে গুলি চলেনি৷

১০) রবিবার ভারত সরকার চিন-ভারত নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর মোতায়েন ভারতীয় সৈন্যদের “সম্পূর্ণ কাজের স্বাধীনতা” দিয়েছে৷ এর অর্থ, ভারতীয় সেনাদের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে আর নিয়ন্ত্রণ রাখা হবে না। যদি ভারতের নতুন এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হয় এবং ভবিষ্যতে
ভারতীয় সৈন্যরা মুখোমুখি হয়ে চিনা সৈন্যদের গুলি করে, তাহলে চিন-ভারত সীমান্ত বিবাদ একটি সামরিক সংঘাতে পরিণত হবে। চিন এবং ভারতের বেশিরভাগ মানুষ এমন চায় না।

১১) আমরা PLA-কে অনুরোধ করছি, সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে। যদি ভারতীয় সেনাবাহিনী সীমান্ত যুদ্ধ শুরু করে, তাহলে তাকে অবশ্যই ভালো শিক্ষা দিতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি পিএলএ-র যথেষ্ট ক্ষমতা আছে।

চিনের সরকারি মুখপত্রের এই ভাষা আসলে চিন সরকারের মনোভাবেরই প্রতিফলন৷ ফলে বোঝাই যাচ্ছে, মুখে চিন যাই বলুক, সীমান্ত ইস্যুতে চিন এখনও আস্তিনেই লুকিয়ে রেখেছে তাস৷

Previous articleহঠাৎ হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বাড়ি, ছুটে গেলেন মন্ত্রী! তারপর?
Next articleএটিএম থেকে টাকা তোলার সীমা হোক ৫০০০ টাকা, প্রস্তাব রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কমিটির