বিনা বিচারেই কার্যত মৃত্যুদণ্ডে ভারাভারা রাও, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

তিন দশক আগের কথা৷ ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদ “বন্দিদের চিকিৎসার জন্য মৌলিক নীতি” নামে এক প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলো। ওই প্রস্তাবে “নিরপেক্ষভাবে” ১০টি নীতি প্রয়োগ করতে বলা হয়েছে৷ এই ১০ নীতির অন্যতম, “বন্দিরা কোনও বৈষম্য ছাড়াই দেশে চালু থাকা স্বাস্থ্য সেবা পেতে বাধ্য।”

আর মহারাষ্ট্রে গত কয়েক মাস ধরে, এই মূল নীতিকেই টুকরো টুকরো করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে৷ সব থেকে বিস্ময়ের এবং দুর্ভাগ্যের, দেশের এক ৮১ বছর বয়সী নাগরিক যখন তাঁর চিকিৎসার মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করার জন্য একজন ‘সুরক্ষা রক্ষী’ খুঁজছেন, তখনই কার্যত দূরে সরে গিয়েছে দেশের বিচার ব্যবস্থাও৷

প্রসঙ্গ, বিশিষ্ট তেলেগু কবি ও এক সময়ের অধ্যাপক ও সাংবাদিক পি ভারভারা রাও৷ রাও যে মত ও পথের পথিক, আমি ব্যক্তিগতভাবে সে পথের বিরোধী, তাঁর আদর্শেরও বিরোধী৷ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে৷ কিন্তু মত বা আদর্শের ভিন্নতা থাকা, আর মানবিক একটি বিষয়ে আলোচনা করা এক বিষয় নয়৷

২০১৮ থেকে ২০২০-র জুলাই, এই দীর্ঘ সময় কালে কারাগারের মধ্যে বারবার অসুস্থ হন ভারভারা রাও। সম্প্রতি তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও অবনতি হওয়ার পর তাঁকে মুম্বইয়ের জেজে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। তাঁর পরিবারের বক্তব্য অনুযায়ী, চিকিৎসাহীন অবস্থায় দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে তিনি এখন কার্যত অনুভূতিহীন৷ তাঁর বক্তব্যে অসামঞ্জস্য তৈরি হয়েছে। তিনি নিজের যত্ন নিতেও সক্ষম নন৷ এবং এত কিছুর পরে দু’দিন আগে প্রশাসনিকস্তরেই জানানো হয়েছে, ৮১ বছর বয়সের এই তেলেগু কবির “কোমর্বিডিটি” রয়েছে এবং তিনি করোনা- পজিটিভ৷

ভারাভারা রাও গুরুতর অভিযোগে বন্দি৷ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে৷ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র মারাত্মক অপরাধ৷ প্রমাণ হলে নিশ্চিতভাবেই ওই কবি গুরুতর অপরাধ করার জন্য কঠোর দণ্ডে দণ্ডিত হবেন৷ দেশের আইন সে বিচার অবশ্যই করবে৷ এতে কারোর আপত্তি থাকলে তা আইনি মোড়কে বলতে হবে আদালতে, কারন মামলা বিচারাধীন৷ রাষ্ট্রদ্রোহী প্রমানিত হলে ওনার শাস্তি অবধারিত৷ রাওয়ের এখন ৮১ বছর বয়স এবং দীর্ঘদিন ধরেই শরীরে রয়েছে একাধিক দুরারোগ্য রোগ৷ সেক্ষেত্রে আইনের উর্ধ্বে উঠে কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের তরফে যৎসামান্য মানবিকতা এবং বাস্তববোধটুকু দেখা যাবে বলে ভাবা গিয়েছিলো৷ কিন্তু তা দেখা যায়নি৷ ভীমা কোরেগাঁও মামলায় নাভি মুম্বইয়ের তালোজা কারাগারে অসুস্থ অবস্থায় বন্দি কবি’র স্ত্রী পি হেমালতা
ও তিন কন্যা দিন তিনেক আগেও কারাগারে রাওয়ের চিকিৎসা না
হওয়ার অভিযোগ এনে দ্রুত চিকিৎসা শুরুর আবেদন জানিয়েছিলেন৷ রাওয়ের স্ত্রী সেদিন বলেছিলেন, “দয়া করে ওনাকে বন্দি অবস্থায় মরতে দেবেন না, ওর চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন৷”

পরিস্থিতি নিঃসন্দেহে করুণ৷ বন্দি হোন বা মুক্ত পুরুষ, অসুস্থ হয়ে দেশের এক নাগরিক চিকিৎসা পাবেন না কেন ? চিকিৎসার জন্য দফায় দফায় আবেদনই বা জানাতে হবে কেন ? অভিযুক্ত হয়ে জেলবন্দি হলে, চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার খর্ব হয়, এমন কথা দেশের কোন আইনে বলা আছে ?

দিন দুয়েক আগে রাওয়ের পরিবার জেজে হাসপাতালে গিয়ে দেখা এক মর্মান্তিক দৃশ্যের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে বলেছেন, রাও জেলে ছিলেন এবং সেখানে নিজে দাঁত ব্রাশ করার মতো অবস্থায় পর্যন্ত ছিলেন না। তেলেগু এই কবির স্ত্রী গত বুধবার যখন তাঁকে দেখতে হাসপাতালে যান, তখন নাকি দেখেন ভারভারা রাও বিছানায় নিজের প্রস্রাবের উপরই শুয়ে আছেন৷ চাদর পরিবর্তনের ব্যাপারেও হাসপাতালের কেউই গা করেনি৷ আর
এরই মাঝে খবর আসে, ভারভারা রাও করোনা- আক্রান্ত৷ সংক্রমণ পরীক্ষার রিপোর্ট ইতিবাচক এসেছে৷ সুতরাং আশঙ্কা করতেই হয়, ভারভারা রাওয়ের সুস্থ হয়ে ওঠার সম্ভাবনা অনেকটাই ক্ষীণ হয়ে গিয়েছে৷

দেশে মহামারির প্রকোপ শুরুর সময় থেকেই রাওয়ের পরিবার দফায় দফায় প্রশাসনের কাছে আর্জি জানায়, হয় কবিকে প্যারোলে ছাড়া হোক, বাড়ির তরফেই তাঁর চিকিৎসা করানো হবে, অথবা প্রশাসন দ্রুত তাঁকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করুক৷ ভারভারা রাওয়ের বয়স এবং একাধিক অসুস্থতার উল্লেখ করে বলা হয়, সংশোধনাগারে মহামারি সংক্রমণের আশঙ্কাও প্রবল৷ সেদিকটাও বিবেচনা করুক প্রশাসন৷
বন্দিদের উপচে পড়া ভিড়ে জেলগুলিতে শোচনীয় পরিস্থিতি৷ মৌলিক সুযোগ-সুবিধারও অভাব রয়েছে৷ গত ২২ মাসে ৫ বার রাওয়ের জামিনের আর্জি খারিজ হয়েছে। শেষবার, ২৬ জুন, জামিনের আবেদন খারিজ হয়৷ সেই সময় মহামারি চূড়ান্ত পর্যায়ে৷ ভারতের কারাগারে উপচে পড়া ভিড়ের কারণে আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়ে। গত মার্চ মাসে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্য সরকারকে বলে কারাগারে ভিড় কমাতে বিচারাধীন বন্দিদের প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হোক৷ সেই নির্দেশ অনুসারে হাজার হাজার বিচারাধীন বন্দি প্যারোলে মুক্তি পেলেও রাওয়ের মত রাজনৈতিক বন্দিদের এই সুযোগ মেলেনি৷ বয়সের কারনও বিবেচিত হয়নি৷
ফলে বিনা চিকিৎসায় ভারভারার স্বাস্থ্যের অবস্থার অবনতি ঘটে। এই তেলেগু কবির “কোমর্বিডিটি” রয়েছে এবং দীর্ঘদিন ধরে তিনি ওষুধের ওপরে নির্ভরশীল। সুপ্রিম কোর্ট বহুবার বলেছে, ‘Bail is the Norm and Jail should be the Exception.’ জামিন-ই হলো আদর্শ ব্যবস্থা, কারাগার তো ব্যতিক্রম৷ কিন্তু ভারভারা রাওকে গ্রেফতারের ঘটনায় এবং UAPA আইনে অভিযুক্ত হওয়ার পর জামিন নয়, জেল-ই যেন আদর্শ হয়ে উঠেছে৷

সবাই জানেন,UAPA আইনে অভিযুক্তদের এই মহামারির সময়ও প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়নি৷ ভারভারা এই ধারাতেই অভিযুক্ত৷ ফলে তিনিও প্যারোলে মুক্তি পাননি৷ অথচ, এমন নয় যে কেন্দ্রীয় বা ওই রাজ্যের সরকার ভারভারা রাওয়ের অবস্থা সম্পর্কে অবহিত ছিলো না বা তাঁর স্বাস্থ্যেরও হঠাৎ অবনতি হয়নি। তিনি গ্রেফতারির সময়ও থেকেই অসুস্থ৷ গত ১৯ জুন বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য মহারাষ্ট্র সরকারকে চিঠি লিখে রাওকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার নড়েনি।আদালতও রাওয়ের
স্বাস্থ্যের দিকটা নজরে আনতে চায়নি৷ UAPA- তে অভিযুক্ত ৮১বছর বয়সের কোনও বন্দির শারীরিক পরিস্থিতির যে অবনতি হতে পারে এই সংক্রমণ আবহে, বিচার ব্যবস্থা তা কেন মানতেই চাইলো না, এটা একটা রহস্য ৷

কিছুদিন আগে তামিলনাড়ুর থুথুকুডিতে বন্দি বাবা ও ছেলের মৃত্যুর ঘটনায় দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়৷ এই ঘটনায় হাইকোর্ট পুলিশ কর্তাদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করার নির্দেশ দেয়৷

কিন্তু প্রশ্ন অন্যত্র, পুলিশ বা জেল হেফাজতে নির্যাতন মানে শুধুই অত্যাচার চালানো নয়৷ হেফাজতে থাকা আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিতে থাকা বন্দির চিকিৎসার ব্যবস্থা না করাও জেল হেফাজতে নির্যাতনের মধ্যেই পড়ে৷ আদালত কিন্তু এদিকে তাকিলোই না৷ ওদিকে, ভারভারা রাওকে হাসপাতালে পাঠানোর ২৪ ঘন্টার মধ্যেই জানা গেলো ৮১ বছরের ভারভারা রাও, যার শরীরে একাধিক অন্য রোগ সক্রিয়, তিনি করোনা- পজিটিভও৷ এই সংক্রমণ হাসপাতালে হয়নি, বরং বলা যায় কারাগারের চিকিৎসকরা ভারভারার শরীরে সংক্রমণ দেখার পরই তাঁকে তড়িঘড়ি হাসপাতালে পাঠানো হয়৷ এই মুহুর্তে কবি ভারভারা রাওয়ের শরীরের যা পরিস্থিতি, চিকিৎসকদের আশঙ্কা, সুস্থ হওয়া তো দূরের কথা, রাও আর ক’দিন বেঁচে থাকবেন, সেটাই দেখতে হবে৷

ভারভারা রাও বলে আলাদা কোনও সুবিধার দাবি কেউই করছে না৷ জেলবন্দি যে কোনও octogenarian- বন্দির সঙ্গে এমন আচরণ করার অর্থ একটাই, বিনা বিচারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা৷ মাথায় রাখতে হবে, বিশিষ্ট কবি ভারভারা রাওয়ের বিরুদ্ধে আনা কোনও অভিযোগই এখনও প্রমানিত হয়নি৷ তাঁর অপরাধগুলি এখনও শুধুই অভিযোগ-স্তরে৷ দেশের কোনও আদালতই রাওকে দোষী সাব্যস্ত করেনি। সন্দেহের বশে ২০১৮ সালে গ্রেফতার করে বিচার তথা তদন্ত প্রক্রিয়া শ্লথগতিতে চালিয়ে, চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করে, ভারভারা রাওকে এ ভাবে বিনা বিচারে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বোধহয় প্রয়োজন ছিলো না৷

Previous articleসুশান্তের মৃত্যু রহস্য, অভিযোগ প্রমাণ করতে না পারলে পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দেব: কঙ্গনা
Next articleটানা ৪ ঘণ্টার বেশি সময় ধরে আদিত্য চোপড়াকে জেরা মুম্বই পুলিশের