কামাতে ব্যস্ত কিছু নেতা-ঠিকাদার, বন্যা যেন উত্তরবঙ্গের ভবিতব্য

কিশোর সাহা

কোথায় কলকাতা! আর কোথায় উত্তরবঙ্গ!!
ফি বছর বন্যা হবেই। উত্তরবঙ্গের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে অতীতে মহাকরণ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হতো, এখন নবান্ন থেকে করা হয়। ত্রিপল বিলি, ফ্লাড শেল্টারে খিচুড়ির যাতে অভাব না হয়, পেটের রোগ না ছড়ায় সে দিকে কড়া নজরও রাখা হবে। মালদহে ভাঙন কেন বছর-বছর হবে তা নিয়ে আলোচনা হবে। আত্রেয়ী, কুলিকের বন্যা নিয়েও খবরাখবর হবে। তিস্তা, তোর্সা, কালজানি, করলা, জলঢাকা সহ শতাধিক উত্তরবঙ্গের নদীর খাত কেন ভরে যাচ্ছে তা নিয়েও কত চিন্তা-দুশ্চিন্তা ব্যক্ত হবে।

এতসবের পরেও ফি বছর ভারী বৃষ্টি হলে উত্তরবঙ্গে বন্যা হবেই। তাতে কার ক্ষতি আর কার লাভ! লাভ এক ধরনের রাজনীতিকদের। লাভ এক প্রকার ঠিকাদারদের। লাভ এক প্রজাতির ইঞ্জিনিয়রদের। সেই লাভের চিনিগুড়ের স্বাদ পান যাঁরা সেই কিছু গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও তার উপরে থাকা কতিপয় জনপ্রতিনিধিদের ফি বছর বন্যায় লাভের অঙ্ক কম নয়। প্রায় তিন দশক ধরে সংবাদ দুনিয়ায় থাকার সুবাদে আমার সঙ্গে অনেক নেতা-কর্তা-আমলার ব্যক্তিগত আলাপচারিতা হয়ে থাকে। সে সময়েই শোনা যায়, তিস্তার বাঁধ সারানোর টাকায় কোন নেতা ধনী হয়েছেন, তোর্সার বাঁধ ঠিক করার কাজ করাতে গিয়ে কোন নেতা কলকাতায় কটি ফ্ল্যাট, নিউ টাউনে কত জমি কিনেছেন। কম যান না আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ির কিছু ঠিকাদারও।

এই তো কদিন আগে কয়েকজন জনপ্রতিনিধি বলছিলেন, এবার যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে উত্তরবঙ্গে তাতে গুটি লাল হয়ে যাবে কিছু নেতা-ঠিকাদারের। (বস্তুত, নেতা-ঠিকাদার আর আলাদা করা মুশকিল অনেক ক্ষেত্রেই। কারণ, শিলিগুড়ির কাছাকাছি জলপাইগুড়ি এলাকার এক বড় মাপের ঠিকাদার এখন অতি বড় নেতা হয়ে পুলিশ-প্রশাসনের উপরে ছড়ি ঘোরান, তার কাজকর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলে তৃণমূলের এক মন্ত্রীও বিপাকে পড়েন। সে কথা পরে হবে।) শিলিগুড়ির বাসিন্দা সেচ দফতরের এক টিকাদার তো এত টাকা করেছেন যে বাড়ির উপরে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের উপরে থাকা পরীর মূর্তির আদলে স্থাপত্য করার জন্য দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞদের ডেকে এনেছিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি জেলেও গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য এক নেতা-মন্ত্রীর সঙ্গে বিমানে তাঁকেও সহযাত্রী হিসেবে দেখা গিয়েছিল।

এই যেখানে ঠিকাদারদের রমরমা, সেখানে বন্যা আটকাবে কে! মনে রাখতে হবে উত্তরবঙ্গের আট জেলায় নদীর সংখ্যা প্রায় দেড়শোটি। তার মধ্যে সবচেয়ে বন্যাপ্রবণ হল আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি। ভাঙন প্রবণ এলাকা হল মালদহ। সেই তুলনায় কম ভাঙন হলেও বন্যা কিন্তু দক্ষিণ দিনাজপুর ও উত্তর দিনাজপুরেও কম হয় না। ফলে, ওই সব জেলায় বন্যা রোধের কাজের জন্য একটি শ্রেণির অতি মাত্রায় তৎপরতা চোখে পড়ে অনেকেরই। সেই তৎপরদের সহ্গে সহ্গে নানা দলের নেতাদের ঘনিষ্ঠতাও নজরে পড়ে অনেকেরই। তথ্য-প্রমাণাদি জোগাড় করে ধরাধরি করলে এতদিনে বন্যা প্রতিরোধের কাজে অনেক গতি আসতেই পারত। কিন্তু ধরবে কে! রাজ্য না কেন্দ্র! উভয়েরই স্বার্থ আছে।

মনে রাখা দরকার, উত্তরবঙ্গে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে। সে সময়ে গোটা দুনিয়া সেই বন্যার ভয়াবহতায় দুলে উঠেছিল। এর পরে রাজ্য ও কেন্দ্র সরকার মিলে উত্তরবঙ্গ বন্যা নিয়ন্ত্রণ কমিশন গঠন করেছিল। গোড়ায় সেই কমিশনের কাজকর্ম ভালই হচ্ছিল। কিন্তু, কলকাতা কেন্দ্রিকতার কারণে সেই কমিশন ক্রমশ খেই হারিয়ে ফেলল। বাম আমলে সেই কমিশন তাও রিপোর্ট পাঠাত, সতর্ক করত, সংরক্ষিত ও অসংরক্ষিত নদীতট থেকে বাসিন্দাদের নিরাপদে সরানোর পরামর্শ দিত। তৃণমূল জমানায় সেই কমিশন তুলেই দেওয়া হয়েছে। কাজেই এখন যদি উত্তরবঙ্গে প্রবল বর্ষণ হয়, এলাকার পর এলাকা তলিয়ে য়ায় তাহলে কলকাতায় বসেই কী করণীয় সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আর সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার আগেই কতজনের ঘরদোর তলিয়ে যাবে, কত চা বাগান ভেসে যাবে, কতজনের মৃত্যু হতে পারে তার হিসেব করার উপায় কি!

কেন্দ্রীয় আবহাওয়া দফতরের তথ্য অনুযায়ী, এবার স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিরপাত হয়েছে উত্তরবঙ্গে। ফলে, আলিপুরদুয়ারে বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কোচবিহারেও। জলপাইগুড়ি তো বটেই, শিলিগুড়ির মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকা ইতিমধ্যেই জলমগ্ন হয়ে পড়েছে। মালদহে ভাঙনের সমস্যা প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ভাঙন রোধের কাজে যা হয় তা শুনলে শিউরে উঠতে হয়। পরিণতিতে ভাঙনে ফি বছর মালদহের জমি, ঘরদোর, স্কুল-মন্দির-মসজিদও তলিয়ে যায়। তা নিয়ে হা হুতাশ হয়। নেতা-মন্ত্রীরা আক্ষেপ করেন। ঠিকাদারদের একাংশের চোখ চকচক করে ওঠে। আর বন্যা, ভাঙন হতেই থাকে।

উত্তরবঙ্গের গা ঘেঁষেই রয়েছে অসম। ফি বছর অসমেও বন্যা হয়। সেখানে ব্রহ্মপুত্র বোর্ডের আওতায় কাজকর্ম হয়ে থাকে। ঘটনাচক্রে, ওই ব্রহ্মপুত্র বোর্জের আওতায় রয়েছে উত্তরবঙ্গের তিস্তা অধ্যুষিত এলাকাও। কিন্তু, ব্রহ্মপুত্র বোর্ড তিস্তা ও তার অববাহিকায় কাজকর্মের ব্যাপারে এখনও তেমন উদ্যোগী নয় বলে প্রশাসনিক সূত্রেই জানা গিয়েছে।
অর্থাৎ, শুধু রাজ্য নয়, কেন্দ্রের হাতে থাকা ব্রহ্মপুত্র বোর্ডের কাছেও উত্তরবঙ্গের কোনও অগ্রাধিকার আজও মেলেনি। তাই তৃণমূলকে অকাতরে বিধায়ক দিয়ে কিংবা বিজেপিকে ঢেলে সাংসদ দিয়ে আখেরে উত্তরবঙ্গের লাভ লাভ কতটা কি তা নিয়ে অনেকে একান্তে প্রশ্ন তোলেন।

তাই মহাকরণ থেকে নবান্ন, সরকার পাল্টালেও উত্তরবঙ্গের বন্যা-ভাঙন জনিত পরিস্থিতি পাল্টায়নি। এবারও বানভাসি হওয়ার জন্য অপেক্ষায় আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, বালুরঘাট, রায়গঞ্জের বাসিন্দার। ভাঙনের কবলে সর্বস্ব তলিয়ে যাওয়ার আতঙ্কও একই রকম দেখা যাচ্ছে মালদহের বিস্তীর্ণ এলাকায়। কারণ, এখনও অবধি উত্তরবঙ্গের সব জেলায় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছে।

কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে যদি বাড়তি বরাদ্দ, উদ্যোগ দেখা যায় তবেই পরিস্থিতি পাল্টাবে। না হলে, যে হারে বৃষ্টি হচ্ছে তা চললে হাহাকার, কান্নার রোলের প্রস্তুতি নেওয়া ছাড়া আপাতত উত্তরবঙ্গের আট জেলার নদী লাগোয়া বাসিন্দাদের আপাতত কিছুই করার নেই।

Previous articleদেশের ইতিহাসে প্রথমবার, সোনার দাম পেরোল ৫০ হাজার
Next articleসচেতনতা বাড়াতে সংবাদপত্রের সঙ্গে বিনামূল্যে মাস্ক দিচ্ছে এই প্রকাশক!