কিংবদন্তির ৯১তম জন্মদিন: শ্রদ্ধায়-সম্মানে ফিরে দেখা অজানা কিশোরকে

তিনি কিংবদন্তি। তিনি সেরার সেরা। তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। আট থেকে আশি, এখন সকলের মুখে মুখে তিনি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাঁর কণ্ঠে ছিল কৈশোরের ছোঁয়া। গানে গানে নিজের গায়কীতে মনের আবেগকে সুরের মায়ায় বেঁধে দেওয়ার পাশাপাশি অভিনয়েও তিনি সবার মন ভরিয়ে দিয়েছেন রসিকতায়।

তিনি এক ও অদ্বিতীয় কিশোর কিশোর কুমার। বাঙালির গর্ব কিশোর ছিলেন চিরদিনের রসিক। তিনি একাধারে গায়ক ও অভিনেতা। কী ছিলেন না তিনি? গীতিকার, সংগীত পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক এবং চিত্রপরিচালক হিসেবেও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছেন।

এখনও তিনি সংগীত পিপাসুদের সুরের জাদুতে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন! ব্যক্তিজীবনে তিনি যেমন ছিলেন প্রচন্ড খামখেয়ালী, তেমনি রসিক। রেকর্ডিংয়ে, আড্ডায়- সবখানে মেতে থাকতেন হৈ-হুল্লোড়ে।

১৯৮৭ সালের ১৩ অক্টোবর ৫৮ বছর বয়সে হৃদরোগের কাছে হেরে সবাইকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে অজানার দেশে পাড়ি জমান ভারতীয় উপমহাদেশের এই অমর সংগীতশিল্পী-অভিনেতা। তার চিরকিশোর কণ্ঠে গাওয়া “জিন্দেগি এক সফর হ্যায় সুহানা” কিংবা “আশা ছিল ভালোবাসা ছিল”র মতো অমর গানগুলো আজও শ্রোতাকে এক মায়াবী ঘোরে টেনে নিয়ে যায় ভালোবাসার অসীম পথে। এখনও কিশোর কুমারকে শুধু ভারত নয়, উপমহাদেশের সেরা কণ্ঠশিল্পী হিসেবে স্মরণ করা হয়। আজ, ৪ অগস্ট তাঁর ৯১তম জন্মবার্ষিকী।

১৯২৯ সালে আজকের দিনেই অধুনা মধ্যপ্রদেশে বাঙালি গাঙ্গুলি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন কিশোর কুমার। তাঁর বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি পেশায় আইনজীবী ছিলেন।

যখন থেকে কিশোর কুমারের সঙ্গীত চর্চা শুরু করেন, কেএল সায়গলকে নিজের গুরু হিসাবে বেছে নেন। বিমল রায়ের ছবিতে “ছোটা সা ঘর হোগা” দিয়ে তাঁর সঙ্গীত জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর তাঁকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

বাংলা, হিন্দি, মারাঠী ছাড়াও অন্য অনেক ভাষাতে গান গেয়েছেন তিনি। গানের পাশাপাশি তিনি একজন সফল অভিনেতাও ছিলেন। আন্দাজ, কাটি পতঙ্গ, অমর প্রেম, দোস্ত, অনুরোধ প্রভৃ্তি ছবিতে গান করে সফলতার পৌঁছেছিলেন কিশোর।

 

১৯৭১ সালে আরাধনা, ১৯৭২ সালে আন্দাজ, ১৯৭৩ সালে হরে রামা হরে কৃষ্ণা, ১৯৭৫ তে কোরা কাগজ সিনেমায় গানের জন্য “সেরা নেপথ্য গায়ক” পুরস্কারে ভূষিত হন।

ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই তারকার কিছু অজানা গল্প তুলে ধরা হলো “এখন বিশ্ববাংলা সংবাদ”-এর পাঠকেদের কাছে।

আভাস কুমার গাঙ্গুলি

ভারতের মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়াতে এক বাঙালি পরিবারে ১৯২৯ সালের ৪ আগস্ট কিশোর কুমারের জন্ম। তার প্রকৃত নাম আভাস কুমার গাঙ্গুলি। বাবা কুঞ্জলাল গাঙ্গুলি পেশায় উকিল ছিলেন। আর মা গৌরীদেবী ছিলেন ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে প্রখ্যাত বলিউড তারকা অশোক কুমার তাঁর বড় ভাই। চার ভাইবোনের মধ্যে কিশোর ছিলেন সবার ছোট। শৈশব থেকেই গান ও অভিনয়ের প্রতি অদ্ভুত টান ছিল কিশোরের। বড় ভাই অশোকের সাফল্য তাঁকে বেশ প্রভাবিত করেছিল। ভাইয়ের অনুপ্রেরণাই কিশোরকে এগিয়ে দিয়েছে অনেকদূর। ছোটবেলা থেকেই তিনি প্রখ্যাত গায়ক কুন্দন লাল সায়গলের ভক্ত ছিলেন। এমনকী তিনি তাকে নকল করে গানও গাইতেন।

লতা হাসছেন

রেকর্ডিং মানেই এক অন্যরকম কিশোর কুমার। রসিকতা, হই-হুল্লোড়। সবচেয়ে মজা হতো, ডুয়েট গানের সময়। রেকর্ডিংয়ের সময় সবাইকে হেডফোন পরতে হয়। এমনই একদিন কানে হেডফোন লাগিয়ে সবাই বসে আছেন স্টুডিওতে। কিশোর কুমারের সঙ্গে লতা মঙ্গেশকরের দ্বৈত গান। কিশোর কুমারের অংশ গাওয়া হয়ে গেছে। এবার লতা মঙ্গেশকরের পালা। কিন্তু কিশোর কুমার নাচের এমন সব ভঙ্গি করছেন যে, লতা মঙ্গেশকর গান গাইবেন কী, কিছুতেই হাসি চেপে রাখতে পারছেন না। হঠাৎ কিশোর কুমারের মজা করা থেমে গেলো। লতা মঙ্গেশকরকে গাইতে দিতে হবে তো! রেকর্ডিংয়ে এসে লতা মঙ্গেশকর খুব মনোযোগী থাকতেন। কিন্তু কিশোর কুমারের সামনে পড়লে কী আর সে উপায় আছে? লতা মঙ্গেশকর গান তুলছেন, কিশোর কুমার তাঁকে নিয়ে রসিকতা শুরু করে দিলেন। নানান রকম হাসির কথা বলে লতা মঙ্গেশকরকে একটানা হাসিয়েই যাচ্ছেন। লতা মঙ্গেশকরকে কিশোর কুমার বোনের মতো ভালোবাসতেন।

টেনশন আক্রান্ত

মজার মজার গান গাইতেন বলে অনেকের মনে হতে পারে যে, কিশোর কুমার হয়তো কখনো চিন্তায় থাকতেন না। এমন ভাবাটা ভুল। আগে যতই মজা করেন না কেন, রেকর্ডিং শুরুর কিছুক্ষণ আগে হঠাৎ বদলে যেতেন কিশোর কুমার। শুধু তাই নয়। বাড়িতে নিজে গানটা তুলেই ফোন করতেন শচীন দেব বর্মন অথবা পঞ্চমকে। বারবার শোনাতেন। গানের ব্যাপারে যতক্ষণ সাড়া না পেতেন, ততক্ষণ টেনশনে থাকতেন তিনি। বারবার জিজ্ঞাসা করতেন, ঠিক হচ্ছে তো? কিশোর কুমার যদিও বুঝতে দিতে চাইতেন না, তিনি গান নিয়ে কতটা টেনশনে ভুগছেন। তাই রেকর্ডিং শেষ করেই দ্রুত বাড়ি চলে যেতেন। শুনতেনও না। বলতেন, ‘গানটা এখন আর শুনবো না। আপনারাই বলবেন কেমন হয়েছে। ’

মেহবুবা

‘শোলে’ ছবির ‘মেহবুবা ও মেহবুবা’ গানটি কিন্তু কিশোর কুমারেরই গাওয়ার কথা ছিলো। তার বাড়িতে গানটি তৈরি হচ্ছে। গানটি পঞ্চম যেভাবে গাইছিলেন তিনি সেভাবে তুলতে পারছিলেন না। বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর হঠাৎ কিশোর কুমার বলে উঠলেন, ‘পঞ্চম, যাই বলো, এই গানটা আমার থেকে তোমার গলায় অনেক ভালো লাগছে। এটা তুমিই গেয়ে দাও। ’ এমনই আর একটি গান ‘ক্যারাভান’ ছবির ‘পিয়া তু অব তো আ যা’। আশা ভোঁসলে ও পঞ্চমের দ্বৈত গান। হওয়ার কথা ছিলো কিশোর কুমার ও আশা ভোঁসলের। কিন্তু এই গানের মাঝে একটা শ্বাসের অংশ আছে। সেটি কিছুতেই আসছে না কিশোরের। এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে পঞ্চমকে বললেন, ‘বুঝলে, এটা তুমিই গেয়ে দাও’। আর একটা গান ছিলো ‘দিল সে দে’। এই গানটাও কিশোর কুমারের অনুরোধে গেয়েছিলেন পঞ্চম। এখনকার দিনে কেউ এভাবে নিজের গান ছেড়ে দেবে!

মঞ্চের মাপ

কিশোর কুমার কোনও কনসার্টে গান করার আগে মঞ্চের মাপ জেনে নিতেন। বলতেন, ‘আমার বড় স্টেজ চাই। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি গাইতে পারবো না। আমি নেচে-কুঁদে গাইবো। ’ আর মঞ্চে তিনি এমন সব কাণ্ড-কারখানা করতেন যে, বাদকরাও বাজনা থামিয়ে হাঁ হয়ে দেখতেন।

বিপাকে

কিশোর কুমার হারমোনিয়াম ভালো বাজাতে পারতেন না। বাজাতে গিয়ে ভুল হলে হাল ছেড়ে দিয়ে খালি গলায় গেয়ে দিতেন। সিঙ্কোপ্যাটেড নোটস থাকলে তো তার যেন দম আটকে আসতো!

ইয়ে জো মোহাব্বত হ্যায়

‘কটি পতঙ্গ’ ছবির ‘ইয়ে যো মহব্বত হ্যায়’ গানটি কিশোর কুমার প্রথম ফোনে শোনেন। শুণেই দারুণ খুশি। গানের দৃশ্যে নায়ক মাতাল হয়ে গানটি করবেন। সেই অভিব্যক্তি তিনি অনায়সে গানে তুলে আনলেন। অথচ জীবনে কখনও মদ ছুঁয়েও দেখেননি তিনি। শুধু চা খেতেন। কোনদিন মদ না খেয়েও এভাবে গানের মধ্যে নেশা ফুটিয়ে তোলা যায়, সেটা কিশোর কুমার ছাড়া আর আরো পক্ষে সম্ভব নয়।

নেপথ্যে

ইমোশনাল গান, দুঃখের গান, রোমান্টিক গান তো তিনি অসাধারণ গাইতেনই। আর আনন্দের গান? তাহলে আর কথাই থাকতো না। গানের মাঝে কিছু কিছু কথা কিশোর কুমার নিজে থেকেই জুড়ে দিতেন। গাওয়ার আগে কার লিপে গানটা থাকবে, ছবিতে তার চরিত্র কেমন, পরিস্থিতি কী, অথবা গানে কোন ধরণের ঘটনা দেখা যাবে- সব কিছু মাথায় রাখতেন তিনি।

দুই সেরার টক্কর

দেব আনন্দ অভিনীত মুনিমজি ছবিতে প্রথমে মহম্মদ রফির গান কথা থাকলেও তাঁর পরিবর্তে বেছে নেওয়া হয় কিশোর কুমারকে। তবে বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল তাঁদের সম্পর্ক। মুনিমজি ছবিতে গান গাওয়ার ঘটনার পর অনেক গুজব রটেছিল মহম্মদ রফি এবং কিশোর কুমারকে নিয়ে। ৭০ থেকে ৮০’র দশকে বহু জনপ্রিয় গানে একসঙ্গে কাজ করে সেই গুজবকে ভুল প্রমান করেন তাঁরা।

Previous articleসুশান্তের মৃত্যুর তদন্তে রিয়া ও তাঁর ভাইকে আজই তলব ইডির
Next articleBig Breaking: সুশান্ত কাণ্ডে কেন্দ্রের কাছে সিবিআই তদন্তের সুপারিশ বিহার সরকারের