Monday, August 25, 2025

শ্যামল কাকু

কত চাঁদা লাগবে তোদের?

সরকারি ফ্ল্যাটবাড়ির বাইরের ঘর। সাদামাটা। লোকবলে গমগমে। দেওয়ালে নানা দাড়ি গোঁফের সমাহারে মার্ক্স, লেনিন, এঙ্গেলস। চওড়া কাঠের টেবিলের ওপার থেকে মোটা চশমা আর সিগারেটের ধোঁয়ার ফাঁক থেকে রাজ্যের পরিবহণ মন্ত্রী শ্যমল চক্রবর্তী আমাদের দেখছেন।

আমরা মানে, মানিকতলা হাউজিং এস্টেটের পাড়ার ছেলেরা। গড় বয়স পনেরো কি ষোলো। বাইরের পার্কে পুজোর বাঁশস্থাপত্য শুরু হয়ে গেছে। বাতাসে ক্যাপ পিস্তল আর তুবড়ির আমেজ। কালী পুজো এলো বলে।

এইদিকে, বাজেট কম। শেষ বেলায় তাই আমরা শ্যামলকাকুর দ্বারস্থ। বা, অন্যভাবে দেখলে, ঘোর কমিউনিস্ট নেতার কাছে এসেছি পুজো আয়োজনে সাহায্য চাইতে!

বয়স কম ছিল বলেই হয়ত অতশত ভাবিনি। এমন নয় যে পাড়ায় অন্য নেতা-মন্ত্রী ছিলেন না। ছিলেন। কিন্তু এতদিন পরেও বলতে পারি, তাঁদের কাছে যাওয়ার কথা একবারও কেউ ভাবিনি।

রসিদের খাতা রেখে যা। পরশু নিয়ে যাস। কেমন? এতটুকু বিরক্ত না হয়ে, সামান্য হেসে আমাদের বিদায় জানালেন শ্যামল কাকু।

শুনেছি, আমাদের ‘পাড়া’ থেকে সিপিএম কখনও জিততো না। মানে কংগ্রেসের তুলনায় কম ভোট পেত। কিন্তু আবার মানিকতলা গভর্নমেন্ট হাউজিং এস্টেট মানে বাম সরকারের ডাকসাইটে মন্ত্রী, নেতাদের বসবাস।

প্রথমদিকে বিনয় চৌধুরী, জ্যোতিবাবুর ডানহাত। সন্তোষ কুশারী (যাঁর ছেলেদের আমরা বন্ধুরা মশারী বলে ডেকে যারপরনাই আনন্দ পেতাম)। পরে এলেন, গৌতম দেব, মৃদুল দের মত নেতারা।

কিন্তু সবার থেকে শ্যামল কাকু আলাদা। আমি অবশ্য ওনার মেয়ে বুয়ার বন্ধু। জেনারেশন গ্যাপ পেরিয়ে আলটপকা আলাপ করার অবকাশ সে জামানায় চেষ্টা করেও মিলত না। চেষ্টাও করিনি। কিন্তু বড়রা ভারী প্রশংসা করতেন।

পাড়ায় পদ্য লেখার কম্পিটিশন। পাড়ারই এক বামপন্থী বাংলার দিকপাল অধ্যাপক জাজ। প্রায় তিরিশ চল্লিশজন কুচোকাঁচার মধ্যে জাজের কেবল বুয়া আর তার বোনের লেখাই পছন্দ। কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না যে এক পাড়ায় দুটো প্রাইজ এক বাড়িতে গেলে, লোকে নিন্দা করবে।

বুয়াকে বললাম। দু দিন পরে বিকেলে ফুটবল খেলতে যাচ্ছি, বুয়ার সঙ্গে দেখা। “শোন, বাবা বলেছে, দুটো প্রাইজ যেন আমাদের বাড়ি একদম না আসে। বাবা আরও বলেছে, এটা পাড়ার বাচ্চারা আনন্দ করে লিখেছে। সবার জন্য যেন কিছু প্রাইজ থাকে।”

আমরা এক একজন বিদ্যাসাগরের গোপাল অতি সুবোধ বালক– এমন মিথ্যাচার বিজেপির আই টি সেলও করবে না। ফের এক পুজো এলো। আমাদের কিছু বন্ধু চড়াও হলো পাড়ার ঠিক উল্টোদিকে, উত্তরাপন বস্ত্রবাণিজ্য কমপ্লেক্সে। ম্যানেজারকে ধমকি চমকি– ব্যবসা করতে গেলে চাঁদা দিতে হবে। টেবিল চাপড়ে, পরশু ফের আসবো, বলে এলো। এক বন্ধু আবার এই ঝামেলার মধ্যে ম্যানেজারের ল্যান্ডলাইন থেকে ফোন করে বর্ধমানে মাসীর খোঁজ খবরও নিয়েছিল।

সেই ম্যানেজার আর এলো না। সন্ধ্যেবেলায় তার বদলে এলো পুলিশের জিপ। কী না, কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসের কর্মচারীকে চাঁদার হুমকি দেওয়া হয়েছে। পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট আর সেক্রেটারি কে ডাকুন।

পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যের সম্পর্ক বরাবরই ঠুনকো। তার উপর চাঁদার ঘা। টালমাটাল পরিস্থিতি যখন গভীর রাতে গড়াল, অফিস থেকে বাড়ি ফিরলেন ক্লান্ত শ্যামল কাকু। গাড়ি থেকে নামতে না নামতে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি। কাকু, বাঁচান। চাঁদার হুমকির অভিযোগে পুলিশ ধরতে এসেছে।

আজও চোখ বন্ধ করলে সে দৃশ্য দেখতে পাই। বাড়ির সামনের গলিতে গাড়ি থেকে নেমে আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন শ্যামল চক্রবর্তী, “জানিস আমি কোথা থেকে আসছি? লালাবাজার থেকে। সেখানে আমি পুলিশকে বলে এসেছি, কোথাও চাঁদার জুলুমের অভিযোগ পেলে কোনোও কিছু না দেখে সোজা গ্রেফতার করুন। আর তোরা আমাকেই বলছিস এদের বাঁচাতে?”

অনেক বছর পরে, উনি যখন রাজ্যসভার সদস্য, আমার সঙ্গে দেখা হলে পাড়ার কথা হতো। উনি চলে গেছেন সল্ট লেকে। আমিও কলকাতার পাট চুকিয়ে দিল্লিতে থাকি। কিন্তু দেখতাম ওনার সব মনে আছে। সংসদ ভবনের বাইরে রোয়াকের মত চমৎকার বসে আড্ডা মারার জায়গা আছে। সেখানে বসে কথা হতো। দেখা হলেই বলতেন, বাবা ভালো আছেন?

বুয়ার সাথে বহুদিন কথা হয়নি। দেখা হলে, অনেক কথা হবে, জানি। কিন্তু শ্যামল কাকুর মতো ওকে বলতে পারবো না, বাবা ভালো আছেন?

পুনশ্চ: বাজেট কম আর চাঁদার অভিযোগ– এই দুই সমস্যাই দ্রুত কেটে গিয়েছিল। যে বাজেট কম পড়েছিল, তার ডবল টাকা উনি তুলে দিয়েছিলেন। আর পুলিশ আসার পরের দিন আমাদের পুজো কমিটির প্রেসিডেন্ট আর সেক্রেটারি থানায় গিয়ে চা খেয়ে এসেছিলেন।

(সোশ্যাল মিডিয়ায় স্মৃতিচারণ)

Related articles

কলকাতার সর্বজনীন পুজো ডিরেক্টারি: দু-মলাটে বাংলার দুর্গোৎসবের ৪৩৪ বছরের ইতিহাস

রবিবাসরীয় সন্ধেয় গড়িয়াহাটের একটি ব্যাঙ্কয়েটে আড্ডার আবহে প্রকাশিত হল সাংবাদিক-লেখক সম্রাট চট্টোপাধ্যায়ের বই 'কলকাতার সর্বজনীন পুজো ডিরেক্টারি'। উপস্থিত...

তৃণমূল–সমাজবাদী পার্টির পথে এবার আম আদমি পার্টি! জেপিসিতে থাকছে না আপও 

সংবিধান সংশোধনী বিল খতিয়ে দেখতে গঠিত যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিল আম আদমি পার্টি।...

মোদির বিরুদ্ধে সরব! হিটলারি কোপে লাদাখের সোনম ওয়াংচু

দফা এক দাবি এক। লাদাখের জন্য একই দাবিতে আজও অনড় সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচু (Sonam Wangchuk)। লাদাখের জমি, যা...

শান্তিপুরে মহিলা স্বয়ম্ভর গোষ্ঠীর ভোটে গোহারা বিজেপি! ২৬-৪-এ জয়ী তৃণমূল 

এসআইআর ইস্যু নিয়ে রাজ্যে বিজেপির মাতামাতির মধ্যে নদিয়ার শান্তিপুরে মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর ক্লাস্টার কমিটির নির্বাচনে বড় সাফল্য পেল...
Exit mobile version