শ্যামলদা এক আশ্চর্য বেঁচে থাকার নাম, অর্ক রাজপণ্ডিতের স্মৃতিচারণ

( অর্ক গণশক্তির তরুণ সাংবাদিক। নিজের পোস্টের জন্য প্রয়াত শ্যামল চক্রবর্তীর স্মৃতিচারণ করেছেন।)

বছর তিনেক আগে দশমীর দুপুর। শ্যামলদার বাড়িতে বসে আমি আর বিপুলদা। শ্যামলদা আমাদের মাটন খাওয়াবেন। আড্ডা চলছে, বেলা গড়ায়।

খাওয়ার ডাক পড়ছে না কেন? শ্যামলদা একবার ঘর থেকে উঠে যাচ্ছেন আবার ফিরে আসছেন। খানিক পরে নিজেই বললেন, ‘আসলে বুঝলি বিরিয়ানিটা এই আবাসনের কমিটি রাতে দেবে, আমি ভেবেছিলাম সকালে। তাহলে ডাল আর বেগুন ভাজা দিয়েই শুরু হোক’।

এই হলেন শ্যামলদা। নির্মল হৃদয়, শিশুর সারল্য, নিষ্পাপ আকাশের মত মন। আমাদের মত আমাদের প্রজন্মের কম বয়সীদের সঙ্গেও মিশে যেতেন অনায়াসে।

তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে লেখার ক্ষমতা, স্পর্ধা আমার নেই। আমি যে আমার ‘শ্যামলদা’কে চিনি, যে শ্যামলদা আমার বা আমার মত অনেক কমরেডকে আক্ষরিক অর্থে পুত্রবৎ স্নেহ করতেন, তাঁর কথাই সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে যখন চোখ শুষ্ক রাখা কঠিন।

শ্যামলদাকে আমি কোনদিন দু:খ পেতে দেখিনি অন্তত প্রকাশ করতে দেখেনি। শ্যামলদাকে আমি কখনো বিমর্ষ দেখিনি, যতবারই দেখা মনে হয় আমার থেকেও মনের বয়স ওঁর কম। সব সময় একগাল হাসি।

আমাদের গণশক্তি অফিস থেকে ঠিক এক দুই তিন করে দশ অবধি গুনলেই সিআইটিইউ অফিস। সপ্তাহে অন্তত একদিন বিকেল হলেই শ্যামলদার ফোন আসতো, ‘কোথায় রে তুই? সুদীপ্তকে নিয়ে চলে আয়, আড্ডা হচ্ছে না অনেকদিন’।

আমি আর সুদীপ্ত হাঁটতে শুরু করতাম। শেষ যেবার সিআইটিইউ অফিসে কয়েক ঘন্টা আমি আর সুদীপ্ত ওঁর সঙ্গে আড্ডা দিয়েছি চিকেন রোল না খাইয়ে ছাড়েননি। শ্যামলদা যেরকম ভালোবাসতেন খেতে সেরকম ভালোবাসতেন খাওয়াতে।

সুদীপ্ত আর আমি শ্যামলদার ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকতেই শ্যামলদার বই বা খবরের কাগজ বা কোন পত্রিকা নামিয়ে রেখে সেই হাসি। শ্যামলদাকে যেখানেই দেখেছি কখনো চুপচাপ অলস বসে থাকতে দেখিনি, কিছু না কিছু পড়ছেন সব সময়। একদিনও ব্যতিক্রম দেখিনি।

আমার মত একজন সাধারণ পার্টিকর্মীর কোনদিন মনে হয়নি উনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা, প্রাক্তন সাংসদ, প্রাক্তন মন্ত্রী। মনে হয়েছে বারে বারেই উনি ঠিক আমার বাবার মতই, যাঁকে সত্যিই প্রাণ খুলে সব বলা যায়, যাঁর সাথে যেকোন বিষয়ে প্রাণ খুলে আড্ডা মারা যায়, যাঁর পরামর্শ পাওয়া যায় সব সময়। এমনই শ্যামলদা আপন করে নিতেন এক লহমায়।

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় প্রচারে শ্যামলদা এসেছেন মালদহে, আমিও তখন বিধানসভা কেন্দ্র ধরে কভার করার জন্য মালদহে। শ্যামলদা জানতেন, মালদহ স্টেশনে ভোর বেলায় নেমেই ফোন, ‘তুই চলে আয় আমার এখানে, তুই তো বেরিয়ে যাবি আয় সকালে চা টা একসাথে খাই’।

শ্যামলদার ফোন রেখে গেলাম ওখানে। শ্যামলদা বললেন ব্রেকফাস্ট দিতে, হোটেল কর্মী আমাকে লুচি সবজি দিয়ে গেলেন আর শ্যামলদাকে টোস্ট আর ডিম সেদ্ধ। শ্যামলদার হাসতে হাসতে ছদ্ম অভিমান, ‘দেখলি অর্ক ইনজাস্টিসটা, ও আমাকে দেখেই ভাবছে লুচি সবজি আমার সহ্য হবে না’! শ্যামলদা, হোটেলের কর্মী আর আমি এবার তিনজন মিলেই হাসি।

পার্টির পুরুলিয়া জেলা সম্মেলন। বিমানদা আর শ্যামলদা যাবেন সম্মেলনে, অফিস থেকে জেনেছিলাম আমারও যাওয়ার কথা ওখানে সম্মেলন কভার করতে। যাওয়ার সময় একসঙ্গে যাওয়া হয়নি, আমি আর আমাদের ফোটোগ্রাফার কমরেড দিলীপ সেন গিয়েছিলাম ট্রেনে, বিমানদার গাড়িতে বিমানদা আর শ্যামলদা।

সকালে পুরুলিয়ার পুঞ্চা কলেজ, সম্মেলনের ভেনু ওখানে পৌঁছেই দেখি বিমানদা শ্যামলদাও পৌঁছেছেন। চলন্ত গাড়ি থেকে শ্যামলদার চিৎকার ‘এই তো অর্ক আর দিলীপ, উঠে পড় উঠে পড়’। পুঞ্চা শহরের কাছেই ছিল থাকার ব্যবস্থা, আমি আর শ্যামলদা এক ঘরে থাকবো এই ঠিক হল।

সম্মেলন শেষের পর সন্ধ্যাগুলিতে আমার কপি লেখা শেষ হলেই চলতো অনন্ত আড্ডা। মুহুর্তে শ্যামলদা চলে যেতেন তাঁর সময়ের পুরুলিয়াতে, তাঁর সময়ের ছাত্র আন্দেলনে, তাঁর সময়ের বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের কাজে। গল্পের মত রূপকথার মত শ্যামলদাদের সময়ের দিনলিপি শোনার সেই সব দুর্লভ অভিজ্ঞতা।

সম্মেলনের পরের দিন সকালে উঠেই শ্যামলদা বললেন, ‘আজ তো রাতে সম্মেলন শেষ, তোদের ট্রেনে ফিরতে হবে না। বিমানদাতো রাতেই কলকাতা ফিরবেন, আমরা চল তোদের গণশক্তির দুর্গাপুর অফিসে আজ থাকি, কাল দুপুরে ওখানে বিপিএমও’র একটা মিটিং আছে, কাল সন্ধ্যে বেলা ওখান থেকে ফিরবো’। তরপরেই হেসে, ‘কি রে হাঁসের মাংস খাবি না কি? কমরেডরা খাওয়াবে বললো দুপুরে’!

শ্যামলদা ছিলেন জীবনকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়ে থাকা একজন মানুষ। শ্যামলদা ছিলেন ভয় ডরকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়া একটা বিশাল মনের মানুষ।

শ্যামলদা ছিলেন সেই মানুষ যিনি হাসপাতালের বেড থেকে বলতে পারতেন ছুটি পেলেই বেশি করে লঙ্কা দিয়ে তেল কই খাওয়ার কথা।

শ্যামলদা ছিলেন সেই মানুষ নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পরের মুহুর্তেই বলতে পারতেন, এত সহজ নয়। এটা পশ্চিমবাংলা, শেষ অবধি ওদের হারতে হবে। বিজেপি তৃণমূল কেউই বাংলাকে বোঝে না। আবার ভাবতে হবে রে, গোটা রাজ্যে বুথে বুথে মানুষকে আবার নামতে হবে।

শ্যামলদা এক আশ্চর্য বেঁচে থাকা। শ্যামলদা এক আশ্চর্য জীবন যিনি শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত কোনদিন ভেঙে পড়া মানুষ ছিলেন না, হাসি মিলিয়ে যাওয়া মানুষ ছিলেন না, বিমর্ষ মানুষ ছিলেন না।

শ্যামলদা মানেই এক অর্থে ভীষন টাটকা বাতাস।

সেই শ্যামলদা আমাদের ছেড়ে কোথাও যাননি। আছেন, ছিলেন, থাকবেন।

কমরেড শ্যামল চক্রবর্তী লাল সেলাম।

 

Previous articleব্রেকফাস্ট নিউজ
Next articleকরোনার বলি “স্টোনম্যান” তদন্তের ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক রবিন বসু