জেলের সেল ওয়ার্ডের সেই স্বাধীনতা দিবস, কুণাল ঘোষের কলম

কুণাল ঘোষ

স্বাধীনতা দিবস। ১৫ অগাস্ট, ২০১৪, প্রেসিডেন্সি জেলের অভিজ্ঞতা। রেডিওতে প্রধানমন্ত্রী; সামনে মাওবাদীরা।

প্রতিবছর স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করে এসেছি। নানা অনুষ্ঠান। কিন্তু ২০১৪ সাল এক বিচিত্র অনুভূতি দিয়ে গেল।
আমি তখন সেল ওয়ার্ডে।
তার বাইরে জেলে পতাকা উত্তোলন ইত্যাদি কর্মসূচি পালিত হচ্ছে।

আর সেলে এক অদ্ভুত বৈপরীত্যের উপস্থিতি।
একদিকে রেডিও চলছে। লালকেল্লা থেকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ।
সেটা দিব্যি চলছে।

আর সামনে মাওবাদী অভিযোগে ধৃত রাজনৈতিক বন্দিদের সভা। বক্তৃতা চলছে। বাইরে এই দল নিষিদ্ধ হলেও জেলের সেল ওয়ার্ডের উঠোনে সংঘবদ্ধ কর্মসূচি। অনুপ রায়, পতিতপাবন হালদার, অজয় ঘোষ, মধুসূদন মন্ডল, প্রদীপ চট্টোপাধ্যায়, অর্ণব দাম, বাপি মুদি, দীপককুমার, প্রশান্তদা, দীনেশ সহ আরও কয়েকজন।

প্রধানমন্ত্রী বলছেন,” স্বাধীন ভারত এগিয়ে চলেছে। বিশ্বে মাথা তুলেছে।”

মাওবাদী বক্তৃতা: ” এই স্বাধীনতা মিথ্যে। শাসকের রং বদলেছে। শ্রমজীবীর উপর শোষণ কমেনি।”

প্রধানমন্ত্রী তথ্যপরিসংখ্যান দিয়ে উন্নয়ন বোঝাচ্ছেন।
মাওবাদীরা বলছেন,” জঙ্গলবাসী, খনিশ্রমিক, দরিদ্রতমরা জানেনই না স্বাধীনতা কাকে বলে। ক্ষমতায় কে বা কারা। তাদের কাছে বেঁচে থাকাটাই লড়াই।”

প্রধানমন্ত্রী বলছেন,” দেশের বিভিন্ন সঙ্কট কমছে। মাওবাদী বা অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসও কমছে। মানুষ শান্তি চাইছেন।”

মাওবাদীরা বলছেন,” সরকারের উন্নয়নের টাকা প্রত্যন্ত এলাকার গরীব পর্যন্ত পৌঁছায় না। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান, কর্মসংস্থানে বঞ্চিত তারা। এই অধিকারের লড়াইটা তীব্র হলেই রাষ্ট্র সন্ত্রাসের তকমা লাগিয়ে দিচ্ছে। তখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই ছাড়া উপায় থাকছে না। যতদিন সমস্যা থাকবে, লড়াই থামবে না।”

এমন চূড়ান্ত বৈপরীত্যের টাটকা অভিজ্ঞতা আগে কখনও ছিল না।
মাওবাদীদের হত্যার রাজনীতির আমি বিরুদ্ধে।
কিন্তু তাদের যুক্তির সঙ্গে একমত খানিকটা হতেই হয়।

এই ধরুন জামলো মাকদাম।
লকডাউনের পর খাদ্যহারা, কর্মহারা পরিযায়ী কিশোরী, যে তেলেঙ্গানার খেত থেকে হেঁটে ছত্তিশগড়ের বাড়িতে ফিরতে গিয়ে মাঝরাস্তায় অসুস্থ হয়ে প্রাণ হারালো।
কিংবা স্টেশন প্ল্যাটফর্মের সেই ছবি, যেখানে মায়ের মৃতদেহের পাশে খেলা করছে অবুঝ শিশু।

এরা জানে না সিংহাসনে বৃটিশ না ভারতবাসী।
এরা জানে না স্বাধীনতা শব্দটার মানে কী।
এরা শুধু জানে জীবন মানে কঠিনতম সংগ্রাম অথবা নিশ্চিত মৃত্যু।

প্রেসিডেন্সি জেলের সেল ওয়ার্ডের সেই স্বাধীনতা দিবসের সকাল আমাকে ভাবতে শিখিয়েছে, বহু পথের সঙ্গে একমত হই বা না হই, মূল যুক্তির আধার নিয়ে ভাবতেই হবে। ভাবা দরকার।

হ্যাঁ, গর্বের সঙ্গে পালন করব স্বাধীনতা দিবস।
কিন্তু প্রতিটি দেশবাসী যেন সেই স্বাধীনতা, সেই গর্ব অনুভব করতে পারেন।

জয় হিন্দ।
বন্দেমাতরম্।

Previous articleLIVE : ৭৪ তম স্বাধীনতা দিবসে কলকাতায় রেড রোডে মুখ্যমন্ত্রী
Next articleআত্মনির্ভর ভারত: লালকেল্লায় ভাষণে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’র সঙ্গে ‘মেক ফর ওয়ার্ল্ড’ জুড়লেন মোদি