বাংলার শব্দভাণ্ডার: কৃত্তিবাস ওঝার ‘রামপাঁচালী’

ডঃ সিদ্ধেশ্বর সাঁই

আদিকবি বাল্মীকির রামায়ণ মহাকাব‍্যের কাহিনী অবলম্বনে বাঙলাভাষায় অনুবাদমূলক কাহিনী- কাব‍্য”শ্রীরামপাঁচালী” রচনায় যিনি ব্রতী হলেন,যাঁর কাব‍্যখানি সমগ্র বাঙলায় দীনদরিদ্রের পর্ণকুটির থেকে উচ্চবিত্তসম্পন্নের আলয়ে, এমন কি রাজপ্রাসাদেও সমানভাবে সমাদৃত হলো, তিনি হলেন বাঙলার ও বাঙালীর প্রাণের মরমিয়া কবি কৃত্তিবাস— ” কৃত্তিবাস কীর্তিবাস কবি এ বঙ্গের অলঙ্কার।” “চর্যাপদ” ও “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন”কাব্য আবিষ্কারের পূর্বে কৃত্তিবাসকেই “বাঙলাভাষার আদিকবি” বলা হতো। কবির বংশতালিকা গ্রন্থে অর্থাৎ “মহাবংশাবলী”গ্রন্থে ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে ধ্রুবানন্দ মিশ্র লিখেছেন,”কৃত্তিবাসঃ কবির্ধীমান্ সৌমঃ শান্তো জনপ্রিয়ঃ”। কৃত্তিবাসের কুলজীগ্রন্থে কৃত্তিবাসকে সুপণ্ডিত ও ধীমান্ বলা হয়েছে। তবে একটা কথা ভুললে চলবে না যে বাল্মীকি মহাকাব‍্য রচনা করেছেন আর কৃত্তিবাস ওঝা পাঁচালীকাব‍্য রচনা করেছেন। “পাঁচালী”ও “মহাকাব‍্য” কখনই তুলনীয় হতে পারে না। তা সত্ত্বেও বলা যায় কৃত্তিবাসের “শ্রীরামপাঁচালী” বাঙলার আমজনতার খুবই প্রশংসা পেয়েছে। শ্রীচৈতন‍্যদেবের অন‍্যতম জীবনীকার “জয়ানন্দ”তাঁর “চৈতন‍্যমঙ্গল”কাব‍্যে লিখেছেন, “রামায়ণ করিল বাল্মীকি মহাকবি। পাঁচালী করিল কৃত্তিবাস অনুভবি।।” কৃত্তিবাসের শ্রীরামপাঁচালীর আত্মবিবরণীতে বর্ণিত আছে- “পূর্বেতে আছিল বেদানুজ মহারাজা। তার পাত্র আছিল নরসিংহ ওঝা।। বঙ্গদেশে প্রমাদ পড়িল হৈল অস্থির। বঙ্গদেশ ছাড়ি ওঝা আইল গঙ্গাতীর।।” কৃত্তিবাস তাঁর আত্মবিবরণীতে আরো আছে,”আদিত‍্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ‍্য(মতান্তরে পূর্ণ)মাঘ মাস। তথিমধ‍্যে জন্মিলেন পণ্ডিত কৃত্তিবাস।।” এ বিষয়ে ডঃ অসিত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় বলেছেন,’যোগেশচন্দ্র রায় বিদ‍্যানিধি মহাশয় নানারূপ জ‍্যোতিষ গণনার দ্বারা মনে করেন ১৩৮৬ থেকে ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে কৃত্তিবাস মাঘ মাসের সংক্রান্তিতে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে রবিবারে সরস্বতীপুজোর দিন জন্মগ্রহণ করেন।তিনি যদি তরুণ-যৌবনে গৌড়েশ্বরের সভায় যান,তা’হলে সময়টা ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি হবে। তখন গৌড়ের সিংহাসনে “হিন্দুরাজা গণেশ” অধিষ্ঠিত ছিলেন’। এ থেকেই ডঃ অসিত বন্দ‍্যোপাধ‍্যায় সিদ্ধান্ত করেন কৃত্তিবাস প্রাক্ চৈতন‍্যযুগের কবি। কৃত্তিবাস তাঁর “শ্রীরামপাঁচালী”র আত্ম-বিবরণীতে লিখেছেন,”বাবামায়ের আশীর্বাদ গুরুর কল‍্যাণ। বাল্মীকিপ্রসাদে রচে রামায়ণ গান।।” কৃত্তিবাসের আত্মবিবরণী থেকেই অনুমান করা যায় যে চন্দ্রদ্বীপের রাজা দনুজ রায়ের পাত্র নরসিংহ ওঝা রাজনৈতিক সংকট ও গোলমালে ভীত হয়ে বঙ্গদেশ ছেড়ে গঙ্গাতীরে”ফুলিয়া”গ্রামে (ফুলমালঞ্চ গ্রামে)এসে বসতি স্থাপন করেন। দনুজ রায় ত্রয়োদশ শতকের ঐতিহাসিক ব‍্যক্তিত্ব; সুতরাং, অনুমান করা যায় নরসিংহের পুত্র গর্ভেশ্বর, তাঁর পুত্র মুরারি এবং মুরারির পুত্র বনমালী ওঝা(কবির পিতা)র পুত্র কৃত্তিবাস চতুর্দশ শতকের শেষে বা পঞ্চদশ শতকের প্রথমে জন্মগ্রহণ করেন। কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন যে কৃত্তিবাসের সময় গৌড়েশ্বর ছিলেন “রুকনুদ্দিন বারবক শাহ”। কিন্তু তিনি সিংহাসনে বসেন ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে। তা’হলে কৃত্তিবাস তো চৈত‍ন‍্যপরবর্তিযুগের কবি হয়ে পড়েন। ঘটকদের কুলজিগ্রন্থে ক‍ৃত্তিবাসের যে বংশপরিচয় আছে তা থেকেই তাই সঙ্গত কারণে অনুমান করা হয়েছে হিন্দু রাজা গণেশেরই রাজত্বকালে অর্থাৎ পঞ্চদশ শতকের প্রারম্ভেই কৃত্তিবাস তাঁর “শ্রীরামপাঁচালী” কাব‍্য রচনা করেন। তৎকালে রীতি ছিল,”গৌড়েশ্বর পূজা কৈলে গুণের হয় পূজা”। কৃত্তিবাস তা জেনে রজপ্রশস্তিমূলক সাতটি শ্লোক রচনা করে,তার অনুলিপি নিয়ে গৌড়ে গিয়ে গৌড়েশ্বরের দ্বারীর হাতে দিয়ে গৌড়েশ্বরের কাছে পাঠালেন। গৌড়েশ্বর সেই অনুলিপি পেয়ে ও তা পাঠ করে কিছুক্ষণের মধ‍্যে রাজদূতকে পাঠালেন আগত ব‍্যক্তিকে আহ্বান জানাতে। রাজসভার দূত এসে জিজ্ঞাসা করলেন,”কাহার নাম ফুলিয়ার পণ্ডিত কৃত্তিবাস। /রাজার আদেশ হৈল করহ সম্ভাষ।।”

তখন কৃত্তিবাস রাজদূতের সঙ্গে গৌড়েশ্বরের নিকট উপনীত হয়ে রাজার কাছ থেকে চার হাত দূরে দাঁড়ালেন ; তারপর স্বরচিত রাজপ্রশস্তিমূলক শ্লোক সাতটি আবৃত্তি করলেন। নানা ছন্দে রচিত সরস শ্লোককয়টির আবৃত্তি শুনে গৌড়েশ্বর খুবই সন্তুষ্ট হলেন এবং ক‍ৃত্তিবাসের গলায় পুষ্পমাল‍্য পড়িয়ে দিলেন ; জনৈক রাজসভাসদ তাঁর মাথায় চন্দন ছিটিয়ে দিলেন। তারপর,রাজা তাঁকে পট্টবস্ত্র প্রদান করে সম্বর্ধনা দিয়ে কবিবর কি দানগ্রহণ করতে চান জিজ্ঞাসা করলে, কৃত্তিবাস সবিনয়ে জানালেন গৌড়েশ্বরদত্ত সম্মানই তাঁর শ্রেষ্ঠ দান ; তিনি আর কিছু দান চান না। গৌড়েশ্বর কৃত্তিবাসের কথায় খুবই সন্তুষ্ট হলেনএবং তাঁকে বাঙলাভাষায় “রামায়ণ” রচনা করতে অনুরোধ করলেন। কৃত্তিবাস অতঃপর দেশের কল‍্যাণ ও রাজার কল‍্যাণ প্রার্থনা করে বাঙলা ভাষায় তাঁর “শ্রীরামপাঁচালী”কাব‍্যটি রচনা শুরু করেন। আমরা কবির আত্মবিবরণী থেকে এই বিষয়গুলি জানতে পারি। কৃত্তিবাস বাল্মীকি রামায়ণকে অনুসরণ করেই সাতকাণ্ডে তাঁর “শ্রীরামপাঁচালী” কাব‍্যটি রচনা করেন। এ বিষয়ে কৃত্তিবাস নিজেই বলেছেন– “সাতকাণ্ড রামায়ণ দেবের সৃজিত। /লোক বুঝাইতে কৈল কৃত্তিবাস পণ্ডিত।।” কৃত্তিবাস সরল পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দে সহজ-সরল ভাষায় তাঁর শ্রীরামপাঁচালী কাব‍্যটি রচনা করেন। কৃত্তিবাসের “শ্রীরামপাঁচালী”র সর্বপ্রথম মূদ্রিত সংস্করণ প্রকাশিত হয় “শ্রীরামপুরের খ্রিস্টান মিশনারী প্রেস” থেকে ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে। উইলিয়ম কেরী জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সাহায্যে কৃত্তিবাসের প্রাচীন পুঁথি সংশোধন করে প্রথম স্থাপিত মূদ্রণযন্ত্রে কাঠের টাইপে “শ্রীরামপাঁচালী” কাব‍্যটি মূদ্রিত ও প্রকাশ করেন। পরবর্তিকালে মোহনচাঁদ শীল কৃত্তিবাসী রামায়ণের”বটতলা সংস্করণ” প্রকাশ করেন। তারপর সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কৃত্তিবাসী রামায়ণের ভাষাকেও বিভিন্ন লিপিকারেরা ক্রমিক মূদ্রণের সঙ্গে সঙ্গে যুগোপযোগী ক্রমিক পরিবর্তন ঘটিয়ে থাকেন।
ফলে বর্তমানে যে কৃত্তিবাসী রামায়ণ পাওয়া যায়, তাতে কৃত্তিবাসের মূল ভাষা কতটুকু সংরক্ষিত আছে,সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কৃত্তিবাস মহর্ষি বাল্মীকির রামায়ণের কাহিনী-কাঠামো
অপরিবর্তিত রেখে মৌলিক কল্পনার সাহায্যে বাঙালীজাতির উপযোগী করে কাহিনী ও চরিত্রের নবরূপায়ণ করেছেন। তিনি বাল্মীকি রামায়ণের আদর্শ থেকে কিছুটা সরে এসে বাঙালী-জীবনের স্নিগ্ধতা ও কোমলতার পরিবেশ রচনায় বেশি মনোযোগী হয়েছেন। তাই তাঁর শ্রীরামপাঁচালীতে দশরথ কর্তৃক সিন্ধুবধ কাহিনীতে পিতৃস্নেহের ব‍্যাকুলতা ও হাহাকার, ভরতমিলন কাহিনীতে ভ্রাতৃস্নেহের আবেগের প্রাচুর্য, রাবণ কর্তৃক সীতাহরণ কাহিনীতে রামচন্দ্রের বিলাপে দাম্প‍ত‍্য প্রেমের মহিমা প্রকাশের ঘটনাবিবরণে মহাকাব‍্যোচিত বস্তুনিষ্ঠতাকেও অতিক্রম করে “গীতিকাব‍্যের সুরমূর্চ্ছনা” সৃষ্টি করেছে। চরিত্র রূপায়ণেও কৃত্তিবাস বাল্মীকিকে পুরোপুরি অনুসরণ করেন নি। বাল্মীকির রামচন্দ্র শৌর্য-বীর্য- সম্পন্ন যথার্থ বীরপুরুষ, তিনি নরচন্দ্রমা। রাবণ দুর্ধর্ষ রাক্ষস, ক্ষমতামদমত্ত ও নৃশংস। পক্ষান্তরে, কৃত্তিবাসের রাম নবদূর্বাদলশ‍্যাম,বড়ই কোমল, বড়ই করুণ। তিনি সেখানে ঈশ্বরের প্রেমময় অবতার ; তিনি সেখানে যেন আদর্শ বাঙালী গৃহস্থ। অর্থাৎ কৃত্তিবাসী রামায়ণ বাল্মীকিরামায়ণের মতো বীরত্ব-ব‍্যঞ্জক মহাকাব‍্য হয় নি। বরং,গৃহস্থাশ্রমের ভক্তিমূলক কাব‍‍্য হয়ে উঠেছে। বাল্মীকিসৃষ্ট অহিরাবণ,মহীরাবণ, বীরবাহু,তরণীসেন প্রমুখ রাক্ষসদের যুদ্ধকাহিনী ভয়ঙ্কর হিংস্র রাক্ষদের যুদ্ধকাহিনী হয়ে উঠেছে ;পক্ষান্তরে, “শ্রীরাম- পাঁচালী”র রাক্ষসদের যুদ্ধ ভক্তিমূলক অলৌকিক যুদ্ধকাহিনী হয়ে উঠেছে। বাল্মীকির চিত্রিত সীতা, কৌশল‍্যা, মন্দোদরী প্রমুখ চরিত্রগুলিকে কৃত্তিবাস বাঙালীর নারীসুলভ ভক্তিভাব, স্নেহপ্রবণতা, ভীরুতা,কোমলতা দিয়ে চিত্রিত করেছেন। রামচন্দ্র পিতৃসত‍্যপালনের জন‍্য চৌদ্দবছর বনবাস গমনে উদ‍্যত হলে অনুজ লক্ষ্মণ তাঁর অনুগামী হতে উদ‍্যত হলেন। সীতাদেবীও তখন রামের সহগামিনী হতে চাইলেন। তখন রামচন্দ্র অত‍্যন্ত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে সীতাকে তাঁর সহগামিনী হওয়া থেকে বিরত থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করলে,বাল্মীকির চিত্রিতা সীতা ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছেন,’হে রাম,আমার পিতা জনক তোমাকে আকৃতিতে পুরুষ কিন্তু প্রকৃতিতে নারী জানলে, কিছুতেই তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে দিতেন না।’ কিন্তু কৃত্তিবাসের সীতা ততটা রূঢ় ভাষায় না বলে উক্তি করেছেন,——- “পণ্ডিত হৈয়া কহো নির্বোধের প্রায়। /কেন হেন জনে পিতা দিলেন আমায়।।” লক্ষণীয় বাল্মীকির সীতার উক্তি তীব্র ব‍্যজ্ঞাত্মক; কিন্তু কৃত্তিবাসের সীতার উক্তি কিছুটা ক্ষোভ ও অভিমানের পরিচায়ক। বাল্মীকি-রামায়ণের এই সব চরিত্রগুলিই কৃত্তিবাসী রামায়ণে বাঙালীসুলভ চরিত্রে পরিণত হয়েছে। অনেকে বলেন যে কৃত্তিবাস বাল্মীকি-রামায়ণ পাঠ করার মতো সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত ছিলেন না। তিনি কথকঠাকুরদের মুখে রামায়ণপাঠ শুনে তাঁর “শ্রীরামপাঁচালী” রচনা করেছেন। তাঁদের এই উক্তি সম্পূর্ণ ভুল ; কৃত্তিবাস যথেষ্ট ভালো সংস্কৃতজ্ঞ ছিলেন। আসলে তিনি বাল্মীকি-রামায়ণের আক্ষরিক অনুবাদ করতে চান নি,তিনি ভাবানুবাদ করতে চেয়েছেন। কৃত্তিবাসও বাল্মীকি রামায়ণের অনুকরণে সাতকাণ্ডে(বালকাণ্ড, অযোধ‍্যাকাণ্ড, অরণ‍্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ‍্যাকাণ্ড, সুন্দরাকাণ্ড,লঙ্কাকাণ্ড ও উত্তরাকাণ্ড)রামায়ণ রচনা করলেও তিনি কোথাও মূল রামায়ণের কিছু কাহিনী বর্জন করেছেন এবং কিছু নতুন কাহিনী সংযোজন করেছেন। যেমন বাল্মীকি রামায়ণের কার্তিকেয়ের জন্ম, অম্বরীশের যজ্ঞ, বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রের বিরোধ ইত্যাদি কাহিনীগুলি কৃত্তিবাস তাঁর “শ্রীরামপাঁচালী” -তে অন্তর্ভুক্ত করেন নি। আবার মূল রামায়ণে নেই অথচ কৃত্তিবাস তাঁর”শ্রীরামপাঁচালীতে অন্তর্ভুক্ত করেছেন,যেমন গুহকের সঙ্গে রামের বন্ধুত্ব, বীরবাহু তরণীসেনের যুদ্ধ,১০৮ নীলপদ্ম দিয়ে শ্রীরাম কর্তৃক “অকাল বোধনে”দেবী দুর্গার আরাধনা, গণকের ছদ্মবেশে হনুমান কর্তৃক মন্দোদরীকে ভুলিয়ে রাবণের “মৃত‍্যুবাণ”হরণ, রাবণের কাছে রামের ‘রাজনীতি শিক্ষা’,লবকুশের সঙ্গে রামের যুদ্ধ প্রভৃতি কাহিনীগুলি কৃত্তিবাসের নিজস্ব মৌলিক রচনা বলে মনে করা হয়। প্রকৃতপক্ষে, কৃত্তিবাসের কবিত্বের একটি প্রধান বৈশিষ্ট‍্য হলো তিনি পুরাণকাহিনীর যুগোচিত নব-রূপায়ণ ঘটিয়েছেন। কৃত্তিবাস তাঁর শ্রীরামপাঁচালীতে উপমাদি অলংকারের রসদ সংগ্রহ করেছেন গ্রামবাঙলার নিসর্গপ্রকৃতি থেকে ; যেমন– “দশমুখ মেলিয়া রাবণ রাজা হাসে।/কেতকী কুসুম যেন ফোটে ভাদ্রমাসে।।” রামচন্দ্রের দুর্ধর্ষ সৈন‍্যদের সঙ্গে যুদ্ধ করানোর জন‍্য অকালে কুম্ভকর্ণকে ঘুম থেকে জাগানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, কৃত্তিবাস তার উপমা দিলেন— “কুম্ভকর্ণস্কন্ধে চড়ি বীরগণ নাচে। বাদুড় দুলিছে যেন তেঁতুলের গাছে।।” কৃত্তিবাসের কবিত্বের সবচেয়ে বড়ো বৈশিষ্ট্য হলো তাঁর বাঙালীয়ানা। ভাবে, ভাষায়, কাহিনীবিন‍্যাসে ও চরিত্রসৃষ্টিতে কৃত্তিবাস ছিলেন “একজন খাঁটি বাঙালী কবি”। কৃত্তিবাসী-রামায়ণে কবিপরিকল্পিত অযোধ্যা,চিত্রকূট, ভরদ্বাজ ও অত্রিমুনির আশ্রম যেন এই বাঙলাদেশেরই এক একটি বিশিষ্ট স্থান বা আশ্রম। রামের জন্মের পঞ্চমদিনে ‘পাঁচুটি ব্রত’,ষষ্ঠদিনে ‘ষষ্টীপুজো’,অষ্টমদিনে ‘অষ্টকলাই’ প্রভৃতি অনুষ্ঠানগুলি বাঙালীরই চিরন্তন অনুষ্ঠান। সীতাদেবীর বিবাহোত্তর বৌভাতের অনুষ্ঠানে অতথিদের নিমন্ত্রণরীতি ও নিমন্ত্রিতদের ভোজ পরিবেশনের ক্রম একেবারে বাঙালীঘরেরই নিজস্ব উৎসবের পরিচায়ক! যেমন রাজা জনক অতিথিদের নিমন্ত্রণ জানাচ্ছেন —- “গলে বস্ত্র দিয়া রাজা অতি সমাদরে।/ নিমন্ত্রণ একে একে সবাকার ঘরে।।” অতঃপর কৃত্তিবাস বর্ণিত বধূৎসবের ভোজ পরিবেশনের ক্রমটা দেখা যাক– -“প্রথমেতে শাক দিয়া ভোজন আরম্ভ। তারপর সূপ আদি দিলেন সানন্দ।। ভাজা ঝোল আদি করি পঞ্চাশ ব‍্যঞ্জন। ক্রমে ক্রমে সবাকারে কৈল বিতরণ।। শেষে অম্বলান্তে হৈল ব‍্যঞ্জন সমাপ্ত। দধি পরে পরমান্ন পিষ্টকাদি যত।।” এই ভোজ পরিবেশনের ক্রম তো আমাদেরই ঘরের পরিবেশন -ক্রম,বাঙালীঘরেরই ভোজন-ক্রম। সুতরাং, সব দিক দিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করে বলা যায় যে কৃত্তিবাসের “শ্রীরামপাঁচালী”কাব‍্য বাঙালীরই জীবনের কাব‍্য। মাইকেল মধুসূদন দত্ত কৃত্তিবাসের যথার্থ প্রশস্তি করে বলেছেন,”কৃত্তিবাস কীর্তিবাস কবি এ বঙ্গের অলংকার।” রবীন্দ্রনাথ কৃত্তিবাসী রামায়ণ সম্পর্কে বলেছেন,”এই বাংলা মহাকাব‍্যে কবি বাল্মীকির সময়ের সামাজিক আদর্শ রক্ষিত হয় নাই। ইহার মধ‍্যে প্রাচীন বাঙালী সমাজই আপনাকে ব‍্যক্ত করিয়াছে।” (কৃত্তিবাসী রামায়ণ বা “শ্রীরামপাঁচালী”কাব‍্য সমাপ্ত )

Previous articlePM CARE-এর অর্থ NDRF তহবিলে জমা দেওয়ার প্রয়োজন নেই: সুপ্রিম কোর্ট
Next articleদুই নারীকে উদ্ধারে সাগরে ঝাঁপ দিলেন পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট!