দিল্লি জীবনের বেশিরভাগ সময় ‘১৩’ নম্বরেই কাটিয়ে দিলেন! সুব্রত সেনের কলম

সুব্রত সেন

প্রণব মুখোপাধ্যায়কে রাষ্ট্রপতি পদে আমার দেখা হয়নি।কারণ, ২০০৬ সালের পর দিল্লি যাওয়া হয়নি, সাংবাদিকতার সঙ্গে যোগসূত্রও তখন আমার ক্ষীণ হয়ে এসেছে। আর প্রণববাবু আদতে বাংলার হলে কী হবে, তিনি আসলে রাজধানীরই নেতা। একমাত্র বাঙালি, যিনি আজীবন দিল্লিতে থেকে কেন্দ্রীয় স্তরে রাজনীতি করেছেন বরাবর। বাংলার সত্যিকারের “হেভিওয়েট” তিনিই। এবং তার থেকেও বড় কথা, রাজনীতিতে তিনি সত্যিকারের “স্টেটসম্যান”।

এবং এই স্টেটসম্যান হওয়া মুখের কথা নয়। মনে আছে আজ তখন একটা একটা করে নিউজ চ্যানেলগুলো চালু হচ্ছে। সেই সময়ে রজত শর্মার “আপ কী আদালত” খুব জনপ্রিয়। প্রতি সপ্তাহে একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে স্টুডিওতে ডেকে জেরা করা হয়। এবং তারপর জনতার রায়ে ঠিক হয় তিনি দোষী না নির্দোষ। টেলিভিশনে আত্মপ্রচারের এত বড় সুযোগ রাজনীতিবিদেরা ছাড়তে চান না। কিন্তু রজত শর্মার অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও প্রণববাবু কিছুতেই “আপ কী আদালত” অনুষ্ঠানে যেতে রাজি নন। কিছুতেই রাজি করাতে না পেরে রজত শর্মা আমাদের মতো বাঙালি সাংবাদিকদের ধরলেন। মানে আমরা যাঁরা প্রণববাবু ব্যস্ত না থাকলে দিনের শেষে একবার তালকাটোরা রোডে তাঁর বাড়ি যাই, অনেক সময়ে তাঁর সঙ্গে বসে মুড়ি খাই। আমরা রজত শর্মার হয়ে প্রণববাবুর কাছে প্রস্তাবটা পাড়লাম। তিনি বললেন, “আমি হঠাৎ ওই অনুষ্ঠানে যাব কেন? গিয়ে আসামির কাঠগড়ায় উঠব কেন? আমি কি কোনও অন্যায় করেছি নাকি যে রজত শর্মা আমায় জেরা করবে। একজন জজ রায় দেবে?”
“কিন্তু ওটা তো মক আদালত সবাই জানে। সবাই তো যাচ্ছে সেখানে, প্রচার হয় ভালো।“
“যে যাচ্ছে যাক। আমার প্রচারের দরকার নেই।“

এই ছিলেন প্রণববাবু। প্রচার পেতে হবে বলে কোনও কাজ করবেন এমনটা তাঁর ধাতে নেই। যেটা ঠিক মনে করেন, করবেন। যেটা মনে করেন ঠিক নয়, কিছুতেই করবেন না। এই ঠিক-ভুলের কথায় আর একটা কথা মনে পড়ল। রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর পরে কংগ্রেস যখন কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসে তখন প্রধানমন্ত্রী হন পি ভি নরসিমহা রাও। রাজনীতিতে তিনি প্রণববাবুর সমসাময়িক। নরসিমহা রাওয়ের মন্ত্রিসভায় প্রথমে প্রণব মুখোপাধ্যায় স্থান পাননি। বেশ কিছুদিন পরে তাঁকে যোজনা কমিশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই পদটি ক্যাবিনেট পর্যায়ের, কিন্তু মন্ত্রিসভা তো নয়। নরসিমহা রাওয়ের মন্ত্রিসভার শেষ কয়েক বছর প্রণববাবু অবশ্য তাঁর গুরুত্ব পেতে শুরু করেন। তিনি মন্ত্রিসভায় আসেন। কিন্তু বাজারে একটা কথা শোনা যেত, প্রণববাবু মন্ত্রিসভার সদস্য হলেও প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বৃত্তে পড়তেন না।

এর কয়েক বছর পরের কথা। কংগ্রেসে নরসিমহা রাওয়ের কর্তৃত্বের অবসান হয়েছে, সীতারাম কেশরীও পদত্যাগ করে কংগ্রেস আবার ফিরে গেছে গান্ধী পরিবারের হাতে। সেই সময়ে সিবিআই আদালতে জেএমএম মামলা উঠল। হুইপ এড়িয়ে জেএমএম-এর কিছু সদস্য টাকার বিনিময়ে নরসমহা রাও সরকারের পক্ষে ভোট দিয়েছিল কি না সেটাই ছিল মামলার বিষয়বস্তু। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী আটক, তিনি তিহারে জেল হেফাজতে। কংগ্রেস নেতাদের মধ্যে কেউ, এমন কী নরসিমহা রাওয়ের ঘনিষ্ঠ বলে যাঁরা পরিচিত ছিলেন তাঁরা কেউ নরসিমহা রাওয়ের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন না। সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেস সভাপতি, পাশার দান উল্টেছে, সুতরাং না যাওয়াই ভালো। প্রণববাবু কিন্তু গিয়ে নরসিমহা রাওয়ের সঙ্গে দেখা করে এলেন। জিজ্ঞেস করাতে বললেন, “কেন যাব না? এতদিনের সহকর্মী। দেখা করতে যাওয়া তো কর্তব্য। অন্যরা কেন যায়নি তা আমি বলতে পারব না। আমার মনে হয় যাওয়া উচিত, তাই গেছি।“ কিন্তু ওঁর বিরুদ্ধে তো মামলা চলছে। এর উত্তর, “আইন আইনের পথে চলবে। তার সঙ্গে এর সম্পর্ক কী?”

এখানেই প্রণব মুখোপাধ্যায় অন্য অনেকের থেকে আলাদা। এবং তিনি শুধু রাজনীতিবিদ নন, তিনি স্টেটসম্যান। তার পাশাপাশি তিনি আদ্যোপান্ত বাঙালি। ১৯৭২ সাল থেকে দিল্লিতে রয়েছেন, কিন্তু তাঁর হিন্দি এবং ইংরেজি বলার ধরন কখনও তিনি পাল্টাননি। তাঁর উচ্চারণ শুনলে বোঝা যেত তিনি বাঙালি। তাঁকে এ নিয়ে কোনও প্রশ্ন করলেই বলতেন, “আরে আমি পাল্টাতে যাব কেন? আমি তো বাঙালিই, সেটা অস্বীকার করি কী করে? আর করবই বা কেন?” এই বাঙালিয়ানা তিনি বজায় রেখেছেন বরাবর। তাঁর কাছ থেকে শোনা, একবার ইন্দিরা গান্ধী বিদেশে ছিলেন, সেই সময়ে ক্যাবিনেটের ভার তাঁর উপর। ওই একটিবার দিল্লিতে থাকতে হয়েছিল দুর্গাপুজোর সময়ে। নইলে দুর্গাপূজার চারটি দিন নিজের গ্রামের বাড়িতে ফিরে আসা তাঁর রীতি। নিজের হাতে পুজো করতে বসতেন, এ কথা এখন সকলে জানেন।

আর তাঁর একটা অদ্ভুত জিনিস ছিল। কুসংস্কারে বিশ্বাস করতে না। একটা সময়ে ১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডের সাংসদ বাড়ি ফাঁকাই পড়ে থাকত। বাড়ির নম্বর যেহেতু ১৩। প্রণববাবু নির্দ্বিধায় সেই বাড়িতে উঠে গেলেন যোজনা কমিশনে যাওয়ার পর থেকে। তাঁর সিনিয়রিটি অনুযায়ী তিনি আরও বড় বাংলো পেতে পারতেন, কিন্তু কোনওদিন সে সবের তোয়াক্কা করেননি। রাষ্ট্রপতি হওয়া পর্যন্ত কখনও বাড়ি বদলালেন না।
প্রখর স্মৃতিশক্তি, এবং সেই সঙ্গে ইতিহাসবোধ। সন তারিখ ধরে বলে দিতে পারেন কোন দিন কী ঘটেছিল। এবং আগামী সময়ে কী ঘটতে পারে তারও একটা ধারণা থাকত তাঁর। এটাও বলতেন, সব কিছু সব সময়ে সবার হাতে থাকে না। অনেক সময়ে ঘটনার গতি-প্রকৃতি ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে। বলতেন, “ঘটনার একটা নিজস্ব গতি আছে। ঘটনা একবার ঘটতে শুরু করলে তা থামানো যায় না।“

বাংলাদেশ যুদ্ধের সময়টা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এ কথা বলতেন, বাবরি মসজিদ ভেঙে যাওয়ার পরেও সখেদে একই কথা বলেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার যিনি হতে পারতেন, তিনি শেষ পর্যন্ত ভারতের একমাত্র বাঙালি রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। সেটাও সম্ভবত এই ঘটনার গতি-প্রকৃতি-র জন্যই।

Previous articleপ্রণববাবু ভারতীয় রাজনীতির ট্র‍্যাজিক নায়ক! গৌতম লাহিড়ীর কলম
Next articleআশঙ্কা সত্যি করে জিডিপিতে ধস, বৃদ্ধি কমল ২৩.৯ শতাংশ