প্রণববাবু ভারতীয় রাজনীতির ট্র‍্যাজিক নায়ক! গৌতম লাহিড়ীর কলম

Pranab Babu

সাল ২০০৫। সেপ্টেম্বর। নিউইয়র্কের বিলাসবহুল ওয়ালড্রফ হোটেলের আঠেরোতলার স্যুইটে প্রণব মুখার্জি । জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করছেন । সফরসঙ্গী আমি সংবাদ প্রতিদিনের প্রতিনিধি । সন্ধ্যায় কূটনৈতিক বৈঠক সেরে নিছক আড্ডা। হঠাৎ টেলিফোন নৈনিতাল থেকে সাংবাদিক বন্ধুর। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধি প্রণববাবুকে উপপ্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব খারিজ করেছেন । নৈনিতালে কংগ্রেসের শীর্ষ নেতাদের চিন্তন বৈঠক । সন্দেহ ছিল তাঁর। চায়ের কাপ নামিয়ে বললেন- আমার প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকা হবে না । ২০০৪ সালে মন্ত্রিসভা গঠনের সময়ে তিনি সোনিয়া গান্ধিকেই বলেছিলেন- প্রতিরক্ষা এবং অর্থমন্ত্রক বাদে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকই পছন্দ । শেষ পর্যন্ত হননি । বুঝেই গিয়েছিলেন বিদেশ মন্ত্রী হতে হবে। সেই সফরেই আমরা গিয়েছিলাম হার্ভার্ড বিশ্ববিদ‌্যালয়ে। নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ডঃ অমর্ত‌্য সেনের সঙ্গে লাঞ্চ বৈঠক। প্রণবের প্রস্তাব ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ‌্যালয় তিনি পুনরুজ্জীবন করতে চান। সেই দায়িত্ব নিন ডঃ সেন। তাই হয়েছিল। প্রণববাবু অতীতে শিক্ষক জীবন তাঁর সরকারি কর্মকান্ডে প্রতিফলিত হয়েছে । তিনি ভরতের অতীতের আন্তর্জাতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান – বিশেষ করে নালন্দা – তক্ষশীলা -বিক্রমশীলার কথা বারবার বলতেন। বিদেশমন্ত্রী হওয়ার পর ইসলামাবাদ সফর। পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট পারভেজ মুশারফকে শর্ত দিয়েছিলেন তাঁকে তক্ষশীলা যাওয়ার অনুমতি দিলেই তিনি পাকিস্তান যাবেন। তাই হয়েছিল। তাঁর সঙ্গে তক্ষশীলা যাওয়ার সুযোগ হয়েছিল। তক্ষশীলায় গিয়ে আবেগ প্রবণ হয়ে গিয়েছিলেন। ভারতে কবে আবার এই ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে ? ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই, যাহা পাই তাহা চাই না ।’

কীর্ণাহারের অখ্যাত গ্রামের প্রণব মুখার্জির বাংলা কংগ্রেসের কর্মী থেকে রাইসিনা হিলসে দেশের প্রথম নাগরিক পদে আসীন হওয়ার রাজনৈতিক যাত্রার মুল্যায়ণ এই ভাবেই করা যায়। হতে চেয়েছিলেন শিক্ষক। হলেন কংগ্রেস বিরোধী রাজনৈতিক কর্মী । প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ্রহ। হলেন রাষ্ট্রপতি। এমনকী তার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মায় উপপ্রধানমন্ত্রী । তাও হননি। কোনও বাঙালি এই পদে আসীন হননি । প্রণববাবুর রাজনৈতিক উত্থান কোনও বংশ উত্তরাধিকারী সূত্রে বা অধুনা বহুল চর্চিত – নেপোটিজম নয়। নিজ যোগ‌্যতায়-মেধায় দেশের ক্ষমতার অলিন্দে নাম্বার টু। রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে জীবন শুরু করে এসব আকাঙ্ক্ষা করা কি অপরাধ? না । জননেতা নন। তিনি জননেতাদের রণনীতিকার । শেষ জীবনে এসে অঘোষিত উপাধিতে ভুষিত হলেন – ভারতীয় রাজনীতির চাণক্য বাংলার কংগ্রেসের তখন তাবড় তাবড় নেতা পুঁচকে প্রণবকে জায়গা দেবে কেন? দেয়নি। বাংলা কংগ্রেসের অজয় মুখার্জিকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কংগ্রেসকে হারাতে বামপন্থীদের সঙ্গে জোট বাঁধতে। জ্যোতি বসুর সঙ্গে পরিচয়। সেই থেকে জোট রাজনীতির হাতে খড়ি। স্বপ্ন ছিল বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হবেন। একই স্বপ্ন জ্যোতি বসু অজয় মুখার্জিকে রাজি করিয়ে প্রণবকে পাঠিয়েদিলেন রাজ্যসভায় । বাংলার রাজনীতি থেকে দূরে রাখতেই কি?

মহাকাশচারী নীল আমস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা রাখলেন ১০ জুলাই ১৯৬৯। সেইদিন ৩৫ বছরের প্রণব রাজ্যসভার সাংসদ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রণবের রক্তে বাঙালিওয়ানা টগবগ করে উঠল। ১৬ জুন। রাজ্যসভায় নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির দাবিতে জোরালো ভাষণ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর মন জয় করে নিলেন । তারপর ফিরে তাকাতে হয়নি । দোর্দন্ড প্রতাপশালী ইন্দিবা গান্ধীর হয়ে উঠলেন ‘মানসপুত্র’। ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয়ের পরে প্রণব-সঙ্গ ত্যাগ করেননি। দুঃসময়ে পাশে থাকার জন্য তিনি ইন্দিরার আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন। প্রণববাবুর মুখেই শুনেছি, পরাজয়ের পরে ইন্দিরা যখন সফর করতেন, তখন বহু জায়গায় বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়েছে। এমনকী জনতা পাথর ছুঁড়ত ইন্দিরাকে দেখলে । প্রণববাবু গাড়িতে একটা বিশাল বালিশ নিয়ে উঠতেন। বালিশ দিয়ে পাথর আটকাতেন । রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে মণিপুরে গিয়ে ইন্দিরার গাড়ির সেই চালককে খুঁজে বের করেছিলেন। ১৯৮০। ইন্দিরা গান্ধি ফের প্রধানমন্ত্রী। তিনিই প্রণববাবুকেই মন্ত্রিসভার তালিকা তৈরি করতে দিয়েছিলেন ভোটের ফল প্রকাশের আগেই। ১৯৮২ সালে ইন্দিরার অর্থমন্ত্রী । আক্ষরিক অর্থে নাম্বার – টু । আচমকা ইন্দিরা গান্ধী নিরাপত্তা কর্মীর হাতে নিহত হলেন । শুরু হল প্রণবের রাজনৈতিক পতনের সূচক।

রাজীব গান্ধী পশ্চিমবঙ্গ সফর করছিলেন । সেই সফরে আমিও সফর সঙ্গী । বিমানে ফেরার সময়ে ফ্লাইটের মধ্যে লোকসভার স্পিকার বলরাম জাখড় প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। নিয়মমতো প্রণব বলেছিলেন- প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু হলে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। এবং নাম্বার টু প্রধান হন। সেই নিয়ে জলঘোলা শুরু। যদিও পরে ক্যাবিনেট সচিব পিসি আলেকজান্ডার তাঁর বইতে লিখেছিলেন- প্রণব আদৌ প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। তা সত্ত্বেও পরে রাজীব গান্ধী প্রণবকে দল থেকে বহিষ্কার করেন। পরে তিনি ফের কংগ্রেসে ফেরৎ আসেন এবং রাজীব গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। যখন তিনি রাজীব গান্ধীরও দু নম্বর হয়ে উঠছেন, তখন তাঁরও মৃত্যু ঘটে তামিল জঙ্গিদের বোমা বিস্ফোরণে । প্রণবের জীবনে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সুযোগ আসে ২০০৪ সালে। তাঁকে বঞ্চিত করে সোনিয়া গান্ধী মনমোহন সিংকে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনীত করেন । প্রথম ইউপিএ সরকারের কার্যত চালিকাশক্তি হয়ে ওঠেন তিনি। তখন তিনি বুঝেই গিয়েছেন, মনমোহন সিং যতদিন আছেন তাঁর পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব নয়। তখন তিনি প্রথম ভাবনা চিন্তা শুরূ করেন রাষ্ট্রপতি হওয়ার। যখন চেষ্টা করছেন তখন সোনিয়া গান্ধী সরকারে তাঁর অপরিহার্যতার যুক্তি দিয়ে প্রস্তাব খারিজ করেন । অনেকের ধারণা ২০১২ সালে সোনিয়া গান্ধী তাঁকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত করেন। এটা অনেকেই জানেন না, সোনিয়া গান্ধী সেই প্রথম মনমোহন সিংকে রাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ করে প্রণববাবুকে প্রধানমন্ত্রী করতে রাজি ছিলেন । কিন্তু বিজেপি বিরোধী দলগুলির আপত্তি ছিল মনমোহন সিংকে নিয়ে। তাঁরা সাবেক রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামকে প্রার্থী করতে চান। প্রণবই তখন সোনিয়া গান্ধীকে হিসাব কষে দেখিয়েছিলেন ইউপিএ এক লক্ষ ভোটে পিছিয়ে। মনমোহন প্রার্থী হলে ইউপিএ পরাজিত হবে। তাই রাষ্ট্রপতি হতে না চেয়েও প্রণবকেই রাষ্ট্রপতি হতে হল। ইউপিএ সরকার বাঁচাতে। শুরুতেই বলছিলাম ভারতের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রণববাবু এক ট্র্যাজিক নায়ক । তিনি যখনি যা চেয়েছেন সেটা হতে পারেননি, কিন্ত যা চাননি তাই হয়েছেন ।

Previous articleকাল ছুটি, রাজ্যে পুলিশ দিবসের উদযাপন 8 সেপ্টেম্বর
Next articleদিল্লি জীবনের বেশিরভাগ সময় ‘১৩’ নম্বরেই কাটিয়ে দিলেন! সুব্রত সেনের কলম