গান্ধী-পরিবারই প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি প্রণববাবুকে, কণাদ দাশগুপ্তর কলম

কণাদ দাশগুপ্ত

” Pranabda had been such an integral and prominent part of National life, the Congress party and the Central government for over five decades. It is hard to imagine how we can do without his wisdom, experience, sage advice and deep understanding of so
many subjects.”

পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে প্রণবদা জাতীয় জীবন, কংগ্রেস দল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের অবিচ্ছেদ্য এবং উল্লেখযোগ্য অঙ্গ ছিলেন। তাঁর প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞানগর্ভ পরামর্শ এবং বিবিধ বিষয়ে গভীর বোধের অনুপস্থিতিতে আমরা কী ভাবে পথ চলব, সে কথা চিন্তা করাও কঠিন।

প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কন্যাকে এই ভাষাতেই চিঠি লিখে শোকপ্রকাশ করেছেন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী৷

সোনিয়াজি আরও লিখেছেন, “যে পদেই থাকুন, তাকে অন্য মাত্রা এনে দিতেন প্রণবদা। দলমতনির্বিশেষে সকল সহকর্মীর সঙ্গে তাঁর হৃদ্যতা ছিল। অপার নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি দেশের সেবা করে গিয়েছেন। গত ৫০ বছরে তাঁর জীবন দেশের গত ৫০ বছরের ইতিহাস।”

শোকবার্তা হিসাবে উৎকৃষ্ট হলেও, বার্তায় সোনিয়া গান্ধী যা বলেছেন, বাস্তবে গান্ধী-পরিবার কখনই প্রণববাবুকে এতখানি উচ্চাসনে বসায়নি৷ অথচ দলের কাছে কম সুযোগ তো আসেনি৷ একবার নয়, দু-দুবার। প্রথমবার ১৯৮৪ ও দ্বিতীয়বার ২০০৪ সালে৷ দু’বারই গান্ধী-পরিবারের হাতযশে ছিটকে যান প্রণব মুখোপাধ্যায় ৷
প্রণববাবুকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করার বিষয়টিতে পরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা জল ঢালে তো গান্ধী- পরিবারই৷ একথা অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে, আজ সোনিয়াজি যাই বলুন, ১৯৮৪ সালে বিপুল ভোটে জয়লাভের পর রাজীব গান্ধী যখন তাঁর নতুন ক্যাবিনেট ঘোষণা করেছিলেন, তখন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নামটাই তো বাদ দিয়েছিলেন৷ এই ঘটনায় প্রণববাবু মানসিক আঘাত পাননি? অবশ্যই পেয়েছিলেন৷ সে কারনেই The Turbulent Years: 1980- 96 বইয়ে তিনি লিখেছিলেন, “আমি যখন মন্ত্রিসভা থেকে আমার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার কথা জানলাম, তখন আমি বিধ্বস্ত এবং হতবাক হয়ে পড়েছিলাম। আমি এটা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।” ১৯৮৪-র ৩১ ডিসেম্বর, রাজীব গান্ধী সকাল ১১ টায় CPP-র নেতা নির্বাচিত হবেন। সেদিনের মিটিং-এ নেতৃত্বে প্রণববাবুই। রাজীবের পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। সেখানেই রাজীব ঘোষণা করেন, বিকেল ৩ টেয় শপথ নেবেন তিনি। এরপর থেকে রাজীবের ডাকের অপেক্ষা করতে থাকেন প্রণববাবু। তাঁকে যে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে, তা কল্পনাও করেননি প্রণববাবু। এমনকি দলের কোনও সদস্যও তাঁকে এমন কোনও ইঙ্গিত দেননি। রাজীব গান্ধীর কিছু বন্ধু কীভাবে রাজীবকে তাঁর বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেছিল, তা জানতেন প্রণববাবু৷ নিজেকে শান্ত রাখলেও প্রণববাবু ধীরে ধীরে বুঝতে পারছিলেন, তাঁকে কোনঠাসা করে দেওয়া হচ্ছে।

এখানেই শেষ নয়৷ ১৯৮৬-র জানুয়ারিতে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি থেকে তাঁকে বাদ দেয় গান্ধী-পরিবার৷ ১৯৭৮ থেকে টানা কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটিতে স্থায়ী জায়গা ছিল তাঁর।সেটাও কেড়ে নেওয়া হয়৷ সেদিন গান্ধী- পরিবারের মদত ছাড়া কংগ্রেসের কোনও নেতার একাজ করার সাহস ছিলো ?

তারপরেও আঘাত এলো ১৯৮৬-র ২৬ এপ্রিল৷ সংবাদমাধ্যম মারফত প্রণববাবু জানলেন, তাঁকে ৬ বছরের জন্য কংগ্রেস দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। দলের কেউ তাঁকে একথা জানানোর সৌজন্য দেখাননি৷ অনেক পরে এক সাক্ষাৎকারে প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন, তিনি সবসময় সমর্থন করেছেন রাজীব গান্ধীকে। রাজীবের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল।পরে রাজীব গান্ধীও স্বীকার করেছিলেন যে, মা ইন্দিরার সব থেকে বিশ্বস্ত লোক প্রণব মুখোপাধ্যায়ের ব্যাপারে তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছিল।

বস্তুত, কোনও বিরোধী দলও প্রণববাবুকে এভাবে humiliate কখনও করেনি, যা তাঁর নিজের দল কংগ্রেস বারবার করেছিলো৷ কেন তাঁকে কখনই প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হয়নি, কংগ্রেস আজ পর্যন্ত তার যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে পারেনি৷ “প্রণববাবুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেওয়া যাবে না”, এই ইভেন্টের মেন্টর তো গান্ধী-পরিবারই৷ রাজীব গান্ধী, সোনিয়া গান্ধী দু’জনই প্রণব মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে সর্বদা সতর্ক ছিলেন। প্রণববাবুর অভূতপূর্ব স্মৃতি এবং ক্ষুরধার বিশ্লেষন ক্ষমতাকে ভয় পেতেন গান্ধীরা৷ অথচ, প্রণববাবুই কিন্তু কংগ্রেসের সভাপতি হিসাবে সোনিয়া গান্ধীকে নিয়ে আসেন। কংগ্রেসের সঠিক ইতিহাস লেখা হলে একথা লিখতেই হবে, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসকে বার বার আসতে হয়েছে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পক্ষপুটে এবং প্রতিবারই রক্ষা পেয়েছে৷
ইন্দিরাজির মৃত্যুর পর রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রী হওয়া তর্কের খাতিরে মানা গেলেও রাজীব গান্ধী-পরবর্তী সময়েও দল কিন্তু প্রণববাবুর নাম বিবেচনাতেই আনেনি৷ সঙ্গত দাবিদার প্রণববাবুকে আটকাতে অনেক ছক কষে পদপ্রার্থী হিসাবে ভাসানো হয়েছিলো সোনিয়া গান্ধীর নাম। পরে দেখা গেলো ওই সোনিয়া গান্ধীকেই হাতে ধরে রাজনীতি শিখিয়েছিলেন প্রণববাবু। অথচ প্রধানমন্ত্রী হতে পারলেন না তিনি!

সুদীর্ঘ ৫ দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের রাজনৈতিক আঙ্গিনায় প্রণববাবুর উপস্থিতি বারে বারে নানা নজির গড়েছে, অসংখ্য ইতিহাস তৈরি করেছে। প্রণববাবু সারাজীবনে জীবনে অজস্র চাঞ্চল্যকর ঘটনার হয় স্রষ্টা অথবা সাক্ষী৷ অন্য যে কেউ হলে সেসব প্রকাশ করে বাহবা কুড়োতেন৷ আর প্রণববাবু হাজারো গোপনীয়তা সঙ্গে নিয়েই স্বর্গারোহণ করলেন৷ এই কারনেই তো ইন্দিরা গান্ধী একবার বলেছিলেন, ” কিছু জানার চেষ্টায় প্রণবের মাথায় হাতুড়ির ঘা মারলে, ওর মুখ থেকে পাইপের ধোঁয়া বের হবে, একটা শব্দও বাইরে আসবে না৷”
ইন্দিরা-পরবর্তী গান্ধী পরিবার রাজনীতিতে প্রণববাবুর এই বিরল গুণের সুযোগটা নিয়েই বারে বারে তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান দিতে অস্বীকার করেছে৷ গান্ধী-পরিবার জানতো, কেন এবং কীভাবে তাঁকে ঠেকিয়ে রাখা হচ্ছে, তা কখনই বাইরে বলবেন না প্রণব মুখোপাধ্যায় ৷ বলেনওনি তিনি, আমৃত্যু সে সব নিজের মধ্যেই রেখে গেলেন৷

… এবারের দু’লাইন আমার ব্যক্তিগত অভিমত৷ ২০০৯ সালে প্রণববাবু প্রধানমন্ত্রী হলে ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদি কিছুতেই প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন না। উল্টে কংগ্রেসের শ্রীবৃদ্ধি হতো৷ কংগ্রেস নিজের পায়ে সেদিন এমনভাবে কুড়ুল চালিয়েছিলো, যে আজও দাঁড়ানোর শক্তি ফিরে আসেনি৷

ইতিহাসের চাকা ঘোরে৷ এই মুহুর্তে কংগ্রেস দলে গান্ধী-পরিবারের অথরিটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে৷ খোদ সোনিয়া গান্ধী এমন চিঠি পেয়েছেন, যার মোদ্দা কথা, “ঢের হয়েছে, চেয়ারপার্সনের পদটা এবার ছাড়ুন”৷ CWC-র সর্বশেষ বৈঠকে গান্ধী-পরিবারকে যা ‘ফেস’ করতে হয়েছে, তা ওই পরিবার কল্পনাও করতে পারেনি৷ এখন আর শাক দিয়ে মাছ ঢেকে রাখা যাচ্ছেনা৷ আজ বা কাল, কংগ্রেসের স্টিয়ারিং গান্ধী- পরিবারের হাত থেকে ছিটকে যাবেই৷ আর একবার ব্যাটন ফসকালে, তা ফিরে পেতে যে ধরনের ‘এবিলিটি’ থাকা দরকার, ওই পরিবারের কারোরই তা নেই৷

বনসাই দেখতে ভালো, শো-পিস হিসাবেও অতুলনীয়৷ কিন্তু বনসাই কখনই মহীরুহ হয়না৷ কংগ্রেস রাজনীতির শেষ মহীরুহ প্রণব মুখোপাধ্যায় কালের নিয়মেই বিদায় নিলেন৷

সোনিয়া গান্ধীর শোকবার্তায় একটা লাইন দু’শো শতাংশ ঠিক,
“It is hard to imagine how we can do without his wisdom, experience, sage advice and deep understanding”৷
“তাঁর প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, জ্ঞানগর্ভ পরামর্শ এবং বিবিধ বিষয়ে গভীর বোধের অনুপস্থিতিতে আমরা কী ভাবে পথ চলব, সে কথা চিন্তা করাও কঠিন।”

সঠিক সময়ে এই উপলব্ধি ওনার হলে, দলের শীর্ষ স্তরের ২৩ নেতা আজ সোনিয়া গান্ধীকে বলার সাহসই পেতেন না, ‘এবার পদ ছাড়ুন’৷

আরও পড়ুন- সুশান্তকাণ্ডে মাদক যোগের তদন্ত তত্ত্বাবধানে এবার মুম্বই যাচ্ছেন রাকেশ আস্থানা

Previous articleসুশান্তকাণ্ডে মাদক যোগের তদন্ত তত্ত্বাবধানে এবার মুম্বই যাচ্ছেন রাকেশ আস্থানা
Next articleসাফল্যের স্বীকৃতি, জঙ্গিদমনের নেতৃত্বে প্রথম মহিলা আইজি চারু সিনহা