লাভপুরে ৩ খুনে নাটকীয় মোড়, প্রকাশ্যে বিস্ফোরক তথ্য আনছে পুলিশ

পুলিশি তৎপরতা, প্রশাসনিক উদ্যোগ। তাতেই ১০ বছর পরে হাইপ্রোফাইল কেসে জড়াচ্ছে তাবড় নেতাদের নাম। লাভপুরে তিন ভাইয়ের খুনে প্রকাশ্যে বিস্ফোরক তথ্য আনছেন তদন্তকারী অফিসাররা।

০৩-০৬-১০, লাভপুর:
সেই সময়কার ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মনিরুল ইসলাম নিজের বাড়ির উঠোনে রীতিমতো সালিশি সভা বসিয়েছেন। কারণ গ্রাম্য বিবাদের মীমাংসা করা। কিন্তু সূত্র বলছে মীমাংসা নয়, যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁদের একেবারে নিকেশ করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েই সেদিন সালিশি সভা ডেকে ছিলেন তৎকালীন ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মণিরুল ইসলাম। সঙ্গে ছিলেন তাঁর ভাই আনারুল-সহ কিছু সাঙ্গোপাঙ্গ। যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ সেই সানোয়ার শেখ ও তাঁর চারভাই যথাসময়ে উপস্থিত হন সেখানে। সামান্য কথা কাটাকাটির পরেই তাঁদের ওপর আক্রমণ নেমে আসে। লাঠি, লোহার রড, ধারাল অস্ত্র দিয়ে বেধড়ক মারধর করা হয় পাঁচভাইকে। ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় দুই ভাইয়ের। সানোয়ার শেখ সহ তিন ভাইকে বোলপুর জেলা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে মৃত্যু হয় বড় ভাইয়ের। প্রাণে বেঁচে যান সানোয়ার ও তাঁর ছোট ভাই।

পরের দিন অর্থাৎ ০৪-০৬-১০ বোলপুর থানায় অভিযোগ দায়ের হয়। ঘটনার তদন্তে নামেন সর্বজিৎ বসু। তদন্ত করে ৫৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেন তিনি। ইতিমধ্যে তাঁর বদলি হয়। থানার নতুন ওসি যিনি যান তিনিই তখন এই মামলার তদন্তকারী অফিসার অর্থাৎ আইও। ঘটনার তদন্তে নেমে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং আরও ১৭ জন থানায় আত্মসমর্পণ করেন।

প্রথম যে চার্জশিট জমা পড়ে, তাতে ৫৪ জনের তালিকায় নাম ছিল মণিরুল ইসলাম, আনারুল ইসলামের। কিন্তু যখন তদন্তে নেমে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে, তখন ধৃত ৩৪ জনের কেউই মণিরুল ও তাঁর ভাইয়ের উপস্থিতির কথা পুলিশকে জানাননি। উল্টে অন্য ১০ জনের নাম এই জিজ্ঞাসাবাদ থেকে উঠে আসে। চার্জশিটে মণিরুলদের নাম বাদ দিয়ে, যুক্ত হয় ওই ১০ জনের নাম।

২০১৪:
তৎকালীন তদন্তকারী অফিসার মণিরুলদের নাম বাদ দিয়ে নতুন ১০ জনের নাম যুক্ত করে চার্জশিট জমা দেন। কিন্তু সেই দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েন সানোয়ার শেখ। আইনের দরজায় কড়া নাড়ে তরতাজা তিন যুবক ছেলেকে হারানো পরিবারটি। ততদিনে অবশ্য রাজনীতির চাকা অন্যদিকে ঘুরে গিয়েছে। প্রথম চার্জশিটে নাম থাকা ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা মণিরুল ইসলাম ততদিনে তৃণমূল নেতা। তবে পিছিয়ে যাননি সন্তানহারা মা। কলকাতা হাইকোর্টে ভাইদের খুনের প্রকৃত তদন্তের আর্জি জানিয়ে আবেদন করে সানোয়ার শেখ। শুনানি চলতে থাকে।

২০১৯:
কলকাতা হাইকোর্ট তিনমাসের মধ্যে এই মামলার চার্জশিট জমা দিতে বলে এবং সেটা বলে প্রথম তদন্তকারী অফিসার সর্বজিৎ বসুকে। এখানেই নাটকীয় মোড়। প্রথম যাঁরা পড়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয় মণিরুল ইসলাম, আনারুল ইসলাম এবং মুকুল রায়ের নাম। মণিরুল অবশ্য ততদিনে রং বদলে গেরুয়া শিবিরে যোগ দিয়েছেন। বিজেপি নেতা মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে লাভপুরে তিনভাইকে খুনের ষড়যন্ত্র এবং প্রত্যক্ষ মদত দেওয়ার অভিযোগ উঠে আসে। বোলপুর আদালতে মুকুল, মণিরুল, আনারুলসহ মোট ৫৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দেয় পুলিশ। আদালত এটিকে ধর্তব্য অপরাধ বলে গণ্য করে।

যখন এদিকে এই পরিস্থিতি চলছে, তখন আনারুল ইসলাম তাঁদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলা দায়ের করেন। শুনানিতেই সুপ্রিম কোর্টে মামলা খারিজ করে দেয়। শুধু তাই নয়, দুই সপ্তাহের মধ্যে আনারুল ইসলামকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দেয় শীর্ষ আদালত।

তবে মামলা বোলপুর আদালতে বেশিদিন থাকছে না মামলাটি। বারাসাত কোর্টে সেটাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কারণ সেখানে বিধায়ক, সাংসদদের মামলা চলার জন্য বিশেষ আদালত রয়েছে। যেহেতু মণিরুল ইসলাম এখন লাভপুরের বিধায়ক, সেই কারণেই এই মামলা বারাসত আদালতে স্থানান্তরিত হচ্ছে। ঘটনায় ইতিমধ্যেই ধরা পড়েছেন আনারুল ইসলাম। সূত্রের খবর, পুলিশি জেরায় প্রচুর তথ্য বলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন তিনি।

আর চার্জশিটে জ্বলজ্বল করছে বিজেপি নেতা মুকুল রায় এবং বিধায়ক মণিরুল ইসলামের নাম। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পুলিশ-প্রশাসন এই মামলার শেষ পর্যন্ত পৌঁছতে চাইছে। দক্ষ হাতে ১০ বছরের আগে ঘটে যাওয়া এই অপরাধের এই তথ্য-প্রমাণ-সাক্ষ্য জোগাড় করছে পুলিশ। তদন্তকারী আধিকারিকদের আশা যে কোনো দিনই আসল অপরাধীদের জালে জড়াতে পারবেন তাঁরা- তা তিনি যত বড়ই রাঘববোয়ালই হোন না কেন।

আরও পড়ুন : বিধানসভা ভোটের আগে ফালাকাটা-হেমতাবাদ উপনির্বাচন তৃণমূল-বিজেপির অ্যাসিড টেস্ট

Previous article‘গাঁজা বৃষ্টি’! আকাশ থেকে পড়ছে একের পর এক প্যাকেট
Next articleসুশান্ত গেলেন, বিকাশ এলেন, সিপিএমের দুই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত