বিধানসভা ভোটের আগে ফালাকাটা-হেমতাবাদ উপনির্বাচন তৃণমূল-বিজেপির অ্যাসিড টেস্ট

করোনা মহামারি আবহের মধ্যেই বড় ঘোষণা করেছে জাতীয় নির্বাচন কমিশন। মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই অর্থাৎ আগামী ২৯ নভেম্বরের আগেই হবে বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। ভোটের নির্ঘণ্ট যথা সময়ে প্রকাশিত হবে বলেও জানিয়েছেন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার সুনীল অরোরা। আর বিহারের ভোটের পরই বেজে যাবে পশ্চিমবঙ্গে ভোটের দামামা।

তবে তার আগে বিধানসভা উপনির্বাচন বাংলার রাজনীতির জন্য খুব তাৎপর্যপূর্ণ হতে চলেছে। কমিশন জানিয়েছে, বিহারের ভোটের সঙ্গেই দেশের বিভিন্ন রাজ্যে লোকসভা ও বিধানসভার উপ-নির্বাচনগুলি হবে। দেশজুড়ে একটি লোকসভা ও ৬৪টি বিধানসভা আসনে এই উপ-নির্বাচন হওয়ার কথা। যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ২টি আসনেও ভোট হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই দুটি আসনই উত্তরবঙ্গের। একটি আলিপুরদুয়ারের ফালাকাটা এবং অপরটি উত্তর দিনাজপুরের হেমতাবাদ। তবে বিধায়কদের আকস্মিক মৃত্যুতে দক্ষিণবঙ্গেরও ২টি আসনও শূন্য হয়েছে। সেগুলি হলো দক্ষিণ ২৪ পরগণার ফলতা ও পূর্ব মেদিনীপুরের এগরা। তবে এই দুই কেন্দ্রে এখনই উপনির্বাচন হচ্ছে না বলেই জানা গিয়েছে।

আরও পড়ুন : বিধানসভার বর্ষাকালীন অধিবেশনে থাকছে না কোনও প্রশ্ন-উত্তর পর্ব

ফালাকাটার তৃণমূল বিধায়ক অনিল অধিকারী গতবছর ৩১ অক্টোবর প্রয়াত হলে এই আসনটি শূন্য হয়। সেই হিসেবে ভোটপর্ব মিটে যাওয়ার কথা ছিল ৩১ এপ্রিলের মধ্যে। অন্যদিকে, হেমতাবাদ কেন্দ্রের বামত্যাগী বিজেপি বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়ের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছিল এ বছরের ১৩ জুলাই। যার ফলে এই আসনটিও শূন্য হয়।

যেহেতু আগামী বছর রাজ্যে হাইভোল্টেজ বিধানসভা ভোট। তাই করোনা আবহের মধ্যেই ফালাকাটা ও হেমতাবাদ বিধানসভা কেন্দ্রে ভোটের প্রস্তুতি একপ্রকার শুরু করে দিয়েছে শাসক-বিরোধী সবপক্ষই। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এই দুই কেন্দ্রেই তৃণমূলকে পিছনে ফেলেছিল বিজেপি। তাই এই দুই কেন্দ্রেই জমজমাট লড়াই হবে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।

আরও পড়ুন : একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলের শক্তি বাড়িয়ে ঘরে ফিরলেন দাপুটে নেত্রী

উপনির্বাচনের আগে একনজরে ফালাকাটা কেন্দ্র:

ফালাকাটা উপনির্বাচনকে পাখির চোখ করে অনেক আগেই ময়দানে নেমে পড়েছে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। গত ৩১ অক্টোবর বিধায়ক অনিল অধিকারি মারা যাওয়ায় ফালাকাটায় উপনির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। এই উপনির্বাচনকে যথেষ্ট মর্যাদার লড়াই হিসেবে দেখছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই আসন ধরে রাখতে তৃণমূলের ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্য করা গিয়েছে। ফালাকাটা বিধানসভা কেন্দ্রকে বিশেষভাবে দেখার জন্য তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় দায়িত্ব দিয়েছেন রাজীব বন্দোপাধ্যায়কে।

নির্বাচনের সম্ভাবনা থাকার আন্দাজ করে সম্প্র‍তি সম্প্রতি এই কেন্দ্রে দলের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত তথা রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দোপাধ্যায় ফালাকাটায় এসে দলীয় কর্মীদের সক্রিয়তার সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেন। তারপর শাসক দলের ব্লক ও অঞ্চল কমিটিতে ব্যাপক রদবদল হয়। সব কমিটিতে নতুন মুখ নিয়ে আসা হয়। ব্লক স্তরের পর এখন অঞ্চল স্তরের বৈঠক নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে শাসক দল। গত লোকসভা নির্বাচনে এই কেন্দ্রে বিজেপির থেকে ২৭ হাজার ভোটে পিছিয়ে যায় তৃণমূল। তাই উপনির্বাচনে যেভাবেই হোক, এই কেন্দ্র ধরে রাখতে চাইছে শাসক দল। এজন্যই দলের তৎপরতা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে।

আরও পড়ুন : বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে তৃণমূল কংগ্রেসের নতুন কমিটি

এদিকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জর্জরিত বিজেপিকে এখনও সেভাবে ময়দানে নামতে দেখা না গেলেও গেরুয়া শিবির লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে এই আসনে জয়ী এগিয়ে ছিল। তারপরও উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে পদ্ম শিবিরের নীরবতা নিয়ে দলের অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে। যদিও বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি, তাঁরা তৃণমূল কংগ্রেসের মতো ঢাক ঢোল পিটিয়ে পালটা কর্মসূচি করেন না। তাঁদের সাংগঠনিক নিয়মেই জোরদার কর্মসূচি চলছে।

ফালাকাটা (তপশিলি সংরক্ষিত) বিধানসভা ২০১৬ ফলাফল

তৃণমূল কংগ্রেসের অনিল অধিকারী তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেস সমর্থিত সিপিআই(এম) -এর ক্ষিতীশ চন্দ্র রায়কে পরাজিত করেন।

অনিল অধিকারী (তৃণমূল)- ৮৬,৬৪৭ ( ৪৩.৭৭% )

ক্ষিতীশ চন্দ্র রায় (জোট প্রার্থী)-৬৯,৮০৮ (৩৫.২৬%)

নারায়ণ চন্দ্র মণ্ডল (বিজেপি)- ৩০,৬৩৯ (১৫.৬০%)

লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে ফালাকাটা কেন্দ্রে এগিয়ে ছিল বিজেপি। ফালাকাটা আলিপুরদুয়ার লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। এখানে বিজেপি প্রার্থী জন বারলা তৃণমূলের প্রার্থী দশরথ তিরককে হারিয়েছিলেন। যেখানে ফালাকাটা কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থী ২৭ হাজারের বেশি ভোটে লিড পেয়েছিলেন।

উপনির্বাচনের আগে একনজরে হেমতাবাদ কেন্দ্র:

মাত্র তিন বছরের ব্যবধান। তাতেই হাওয়া ঘুরে গিয়েছিল হেমতাবাদ বিধানসভা কেন্দ্রের। সিপিএমের জেতা আসনে এগিয়ে যায় বিজেপি। ২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের ফল বার হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে জার্সি বদলে বিজেপিতে যোগ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন স্থানীয় সিপিএম বিধায়ক দেবেন্দ্রনাথ রায়। দিনটা ছিল ২৮ মে। তার পরেই সিপিএম তাঁকে বহিষ্কার করে।

কালিয়াগঞ্জ বিধানসভার একেবারে গায়ে হেমতাবাদ কেন্দ্র। কালিয়াগঞ্জের মতো এখানেও রাজবংশী ভোট (প্রায় ৩০-৩৫ শতাংশ) গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়াত বিধায়ক দেবেনবাবু ছিলেন রাজবংশী নেতা। একেবারে তৃণমূল স্তরের লোকজনের সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগ। ২০১৬ নির্বাচনে তৃণমূলের সবিতা ক্ষেত্রীকে ১০ হাজার ভোটে হারান তিনি। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জের বিজেপি প্রার্থী দেবশ্রী চৌধুরী কিন্তু এখানে সাড়ে ৬ হাজারের মতো লিড নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন : লক্ষ্য একুশের বিধানসভা, কলকাতার দুই জেলা কমিটির শীর্ষে বাঙালি মুখ আনলো বিজেপি

তবে মাটির মানুষ বলে পরিচিত দেবেন রায়ের দল পরিবর্তনের কয়েক মাসের মধ্যে আবার পটবদল দেখা যায় এলাকায়। পাশের রাজবংশী অধ্যুষিত কালিয়াগঞ্জ বিধানসভা, যেখানে ২০১৯ সালে প্রায় ৫৭ হাজার ভোটের লিড নিয়েছিল বিজেপি, সেখানে উপনির্বাচনে জয়ী হয় তৃণমূল। অসমে এনআরসি চালু হওয়ার পরে ওই এলাকার রাজবংশী ভোট বিজেপির বিরুদ্ধে চলে যায় বলে দাবি তৃণমূলের।

তার পরেও অবশ্য নিজের এলাকায় মাটি কামড়ে পড়ে থেকে জনসংযোগ বজায় রেখেই চলছিলেন দেবেনবাবু। অনেকেই মনে করেন, করোনা আবহে এনআরসি তত বড় বিষয় আর না-ও হতে পারে। ফলে আগামী বিধানসভা ভোটে দেবেনবাবু জনসংযোগের ফসল তুলতেন বলেই বিজেপি দাবি করে।

দেবেনবাবু গত তিন দশক ধরে হেমতাবাদ বিধানসভা কেন্দ্রে রাজবংশী সম্প্রদায়ের বাসিন্দাদের স্বার্থে লড়াই করে চলেছেন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে দেবেনবাবুকে হারানো সম্ভব নয়, তা বুঝতে পেরে তৃণমূল পরিকল্পিতভাবে তাঁকে খুন করেছে বলে জোরালো অভিযোগ তুলেছিল বিজেপি।

তবে সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল। এদিকে কালিয়াগঞ্জ উপনির্বাচনে তৃণমূলের জয়ের কান্ডারী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফালাকাটার পাশাপাশি হেমতাবাদের বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে দলের তরফে।

 

হেমতাবাদ (তপশিলি সংরক্ষিত) বিধানসভা ২০১৬ ফলাফল

বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী সিপিএমের দেবেন্দ্রনাথ রায় তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তৃণমূল কংগ্রেসের সবিতা ক্ষেত্রীকে পরাজিত করেন।

দেবেন্দ্রনাথ রায় (সিপিএম)– ৮০,৪১৯ (৪০.৬৪%)

সবিতা ক্ষেত্রী (তৃণমূল)– ৬৭,২৮৩ (৩৪.০৩%)

বিষ্ণুরাম বর্মন (বিজেপি) ৪০, ৭৯৫ (২০.৬৩%)

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে রায়গঞ্জের বিজেপি প্রার্থী দেবশ্রী চৌধুরী কিন্তু হেমতাবাদ কেন্দ্র থেকে সাড়ে ৬ হাজারের বেশি ভোটে লিড নিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন : লক্ষ্য বিধানসভা: দিল্লিতে বাংলার মন্ত্রী বাড়াবে বিজেপি

Previous articleফের অতি ভারী বর্ষণের সতর্কতা জারি , সোমবার থেকে দক্ষিণবঙ্গে বাড়বে বৃষ্টির পরিমাণ
Next articleBig Breaking: জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে রাষ্ট্রপতির নেতৃত্বে সোমবার সব রাজ্যের সঙ্গে বৈঠক