‘কিছু স্মৃতি ভোলা যায় না, শুধু দুঃখ বাড়ায়’

মৃণাল সেনের স্মৃতিচারণায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

“কোনও ধরনের স্মরণ সভাতেই আমার যেতে আমার ভালো লাগে না। যিনি চলে গিয়েছেন, তাঁর কথা বড্ড মনে পড়ে। মৃণালদা ভীষণই কাছের মানুষ ছিলেন। তিনি নেই এই ভাবনাটাই আমার কাছে শোকের।

গত এক বছর মৃণালদার সঙ্গে দেখা করতে যাইনি। ওঁকে অসুস্থ – জরাগ্রস্ত দেখতে হবে, এটা ভেবেই যেতাম না। নিয়মিত খোঁজ নিতাম বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে। আমার চোখে মৃণাল দার কর্মচঞ্চল রূপটাই জেগে আছে… ওটাই থাক না।

কর্মজীবনের প্রথমদিকেই ওঁর সঙ্গে ‘পুনশ্চ’, ‘প্রতিনিধি’ এবং ‘আকাশ কুসুম’- এ কাজ করেছিলাম। মজার ব্যাপার হল, এই তিনটি ছবিতেই আমার কোনও মেকআপ ছিল না! সে সময় কথায়-কথায় জানিয়েছিলেন ‘অপুর সংসার’ – এ আমার অভিনয় ভাল লেগেছে বলেই ‘পুনশ্চ’ তে আমাকে নিয়েছেন। তখন আমি অবশ্য সেভাবে উপলব্ধি করতে পারি নি ওঁর কাজের গুরুত্ব। তারপর ধীরে ধীরে বুঝেছি।

অসাধারণ সুন্দর চিত্রনাট্য সাজাতেন। যাঁরা বলেন, ওঁর ছবিতে বিশেষ এক রাজনৈতিক চিন্তার প্রতিফলন পাওয়া যায়, আমার মনে হয় সেটা ঠিক নয়। প্রতিটি ছবিই তো আলাদা। তবে ওঁর বলার নিজস্ব ধরন ছিল। খুব স্পষ্টভাবে নিজের চিন্তা ভাবনার কথা বলতে পারতেন। তা আজকাল কেউ পারে কি? আমি তো কোনও পরিচালকের কাজে সেটা খুঁজে পাই না।

মৃণাল সেনের চলে যাওয়ার পর হয়তো ওই প্রজন্মটাই শেষ হলে গেল। মৃণালদার জীবন নিয়ে একটা বক্তব্য ছিল, সেটাই ছবিতে ফুটে উঠত। আমার মনে হয়, সেই জীবনবোধ বা দৃষ্টিভঙ্গি খুবই গুরত্বপূর্ণ। নিজের একটা পদ্ধতিতে কাজ করতেন মৃনালদা। প্রতিটি দৃশ্য সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিতেন। কিন্তু সেই দৃশ্যটিই চূড়ান্ত হবে, এমন নয় কিন্তু! প্রতি মুহূর্তে ইমপ্রোভাইজ করতেন। এমনও হয়েছে, সেটে গিয়ে সংলাপ বা দৃশ্য পরিবর্তন করেছেন। মাঝে অনেকটা সময় মৃণালদার সঙ্গে কাজ করা হয়নি। এরপর ‘ মহাপৃথিবী ‘ তে কাজ করেছি। সে সময় আবার মুগ্ধ হয়ে ওঁর সংলাপ রচনা আর চিত্রনাট্যের কাজ দেখেছি।

আমি যেহেতু সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেন, দুজনের সঙ্গেই কাজ করেছি, তাই বারবার তুলনামূলক আলোচনায় আমাকে টেনে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এটা কি উচিৎ? দুজনে-দুজনের মতো কাজ করতেন। ভাবনা চিন্তার পার্থক্য ছিল। এভাবে দুই বিশ্ববরেণ্য পরিচালককে এক নিক্তিতে বিচার করাটা সম্ভব নয়। আমার মনে হয় এ এক ধরনের অসম্মানও। ব্যক্তিগত জীবনে মানুষটা ভীষণ মাই – ডিয়ার ছিলেন। নানা বিষয়ে মন খুলে কথা বলা যেত ওঁর সঙ্গে। বিষয় বাছবিচার না করেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়েছি। আজকে ওই দিনগুলোর কথা বড্ড মনে পড়ছে। কিছু কিছু স্মৃতি ভোলা যায় না, শুধু দুঃখ বাড়ায় । … ”

সৌজন্য : আনন্দলোক

 

Previous article|| সৌমিত্র-কথন ||
Next articleভ্যাকসিন ট্রায়ালের পর কেমন শারীরিক অবস্থা? জানালেন স্বেচ্ছাসেবকরা