মাটির গর্ভে চাপা পড়ে বাংলার ইতিহাস, ‘কর্ণগড় বাঁচাও, মাটি খোঁড়ো’

কর্ণগড় সৌন্দর্য্যায়ন, মন্দির সংস্কার, বৃক্ষরোপণ, উদ্যান, শৌচালয় তৈরির জন্য মুখ্যমন্ত্রী কর্ণগড়-এর জন্য বরাদ্দ করেছেন ১ কোটি। নিঃসন্দেহে ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু মেদিনীপুর-রাজ্য-দেশের চাপা পড়ে যাওয়া গৌরবের ইতিহাস পুনরুদ্ধারের জন্য সবার আগে প্রয়োজন খাতায়-কলমে ‘হেরিটেজ’ মান্যতা, খননকার্য। যেটুকু আছে তাও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। মন্দির সংস্কার হবে ঠিকই, কিন্তু হারানো ইতিহাসকেও মাটির তলা থেকে তুলে আনতে হবে। তারপর গড়ে সৌন্দর্যায়নের পাশাপাশি ‘ওয়াটার’, ‘লাইট’, ‘স্টোরি’ শো হলে রাজ্য সরকারের ড্রিম প্রোজেক্ট মর্যাদা পাবে আরও।

সম্ভবত ভারতবর্ষের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী। অথচ দীর্ঘ বছরের অবহেলায় বিধ্বস্ত রূপে পড়ে রয়েছে তাঁর গড়। এই গড়ের সীমানা ছিল প্রায় ১২০ বিঘা। কর্ণগড় মন্দির থেকে মাত্র এক কিলোমিটার দূরে ইতিহাসের সাক্ষী বহন করছে প্রাচীন মন্দির, গড়, হাওয়া মহল (জলহরি)। জোটেনি হেরিটেজ তকমা। স্থানীয়দের দাবি, গর্বের ইতিহাস থাকা সত্ত্বেও তা উদাসীনতার শিকার।

বিদ্রোহী রানি বললেই কার কথা মনে পড়ে? শুধু ঝাঁসির লক্ষ্মীবাই? সেটাই স্বাভাবিক কারণ, ভুলিয়ে দেওয়া হয় বাংলার কথা। এই মাটির বিপ্লবের কথা। নারীর কথা। ইতিহাস বারবার বিকৃত হয়। চেষ্টা করা হয় আসল ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে। তেমনই চেষ্টা করা হয়েছে মেদিনীপুরের এই ইতিহাসকে আস্তে আস্তে মুছে ফেলার। রানি লক্ষীবাইয়ের জন্ম ১৮২৮ সালে। তাঁর জন্মের ১০ বছর আগে মৃত্যুবরণ করেন বিদ্রোহী রাণি শিরোমনি। অথচ উপেক্ষিত, হারানো ইতিহাসে কান পাতলে শোনা যায় শিরোমনি মানে ‘মেদিনীপুরের লক্ষ্মীবাই’। যা কোনওভাবেই সঠিক নয়।

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, কেশরী বংশের রাজা ইন্দ্রকেতু রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর উত্তরসূরী নরেন্দ্রকেতু রাজ্যের দায়ভার তুলে দেন লোধা সর্দার রণবীর সিংহের হাতে। অপুত্রক রাজা ভবিষ্যতের শাসক হিসেবে দত্তক নেন জনৈক মাঝি অভয়ার পুত্রকে। তারপর পারাং নদী দিয়ে বয়ে গেছে রাজ্যপাটের স্মৃতিমোড়া কত জল। উত্তরসূরী রাজা অজিত সিংহের মৃত্যুর পরে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্বভার তুলে নেন দ্বিতীয় রানি শিরোমনি।

রানির তখন ৩ টি গড়, কর্ণগড়, আবাস গড়, জামদার গড়। সমগ্র কর্ণগড় জনপদ ছিল পরিখা ঘেরা। টিলার উপর রাজপ্রাসাদ।রাজ্য পরিচালনা করতেন অপুত্রক রানি শিরোমণি। সন্তানহীন কি? বোধহয় ভুল। তিনি গর্ভধারিনী নন। সমস্ত প্রজাই তাঁর সন্তান। পরম যত্নে আগলে রাখেন রাজ্যবাসীকে।

কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি থেকে হিংস্র শাসকের চোখ ঠিকরে পড়ল শান্ত জঙ্গলের গর্ভে। স্থানীয় জমিদারদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হল চড়া ভূমি রাজস্ব। যা আদায় করতে গেলে শেষ হয়ে যাবে ভূমিপুত্রদের জঙ্গল, নিষ্কর জমির অধিকার। সরব হয়ে উঠল পাইক-বরকন্দাজরা। জঙ্গলের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল প্রতিবাদ। প্রতিবাদকে শুরুতেই শেষ করে দিতে লোপ করা হলো পাইকান পেশা, বাতিল করা হয় জমির অধিকার। আরো তীব্র হলো প্রতিবাদ। টিলার ওপরে মাকড়া পাথর ও পোড়া ইঁটের রাজপ্রাসাদ হয়ে উঠল বিপ্লবের আঁতুড়ঘর। কুলদেবী মহামায়ার রাজ্য রক্ষা করতে রানি দেবী আখ্যান প্রচার করতে শুরু করেন গোপনে। বিপ্লবের জন্য ব্যয় করতে থাকেন দু’হাত উজাড় করে। হয়ে ওঠেন নেত্রী। মূলত এই কৃষক বিদ্রোহকে ইংরেজরা হেঁয় করার জন্য নাম দিল ‘চুয়াড় বিদ্রোহ’। চুয়াড় মানে গোঁয়ার।

এর আগেও জগন্নাথ সিংহের নেতৃত্বে হয়েছে বিপ্লব। এবার তা আরও তীব্র। সম্মুখে এসে বিদ্রোহ করলেন রাইপুরের দুর্জন সিং-ও। নিজেকে ঘোষণা করলেন স্বাধীন তালুকদার হিসেবে। বিপ্লবের জন্য অর্থ ব্যয় করতে করতে রানির বাকি পড়েছে খাজনা। ‘নানাকর’ আদায়ে চাপ দিতে শুরু করে শোষক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।

রাজ্যের লোভে বিশ্বাসঘাতকতা করলো রানীর দেওয়ান যুগলচরণ। গোপনে খবর পৌঁছে যেতে থাকল সাদা চামড়ার শাসকদের কাছে। তা অবশ্য চোখ এড়ায়নি প্রজাপালিতার। জমিদারি থেকে নয়াবসত পরগনার কুড়মি রানী বিতাড়িত করলেন তাকে। নিযুক্ত করলেন এককালের বরখাস্ত চুনীলালকেই।

দাউ দাউ করে জ্বলছে বিপ্লবের আগুন। ১৭৯৮ সালে গোবর্ধন দিকপতির নেতৃত্বে প্রায় ৪০০ ‘চুয়াড়’ তির-ধনুক, বল্লম, লাঠি, আগুন নিয়ে লুঠ করতে শুরু করল সরকারি অফিস, গুদামঘর। বিদ্রোহ দমন করতে এসে বিনা খাদ্য, জলে বন্দি ইংরেজবাহিনী।

এদিকে কালেক্টরেট থেকে খবর গিয়েছে কোম্পানিতে। মেদিনীপুরে আসতে শুরু করেছে ইংরেজ সেনাবাহিনী। রানীর কাছে পৌঁছাল সেই খবর। শেষ আঘাত হানতে ব্লুপ্রিন্ট কষলেন রানি। কালেক্টরেটে খবর পাঠালেন, চুয়াড়দের দমানো যাচ্ছে না। তিনি কোম্পানির সঙ্গে সন্ধি করতে প্রস্তুত। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রানির কথা বিশ্বাস করার সাহস দেখালো না সাদা চামড়ার বেনিয়ারা।

ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে বন্দি করা হলো চুনীলালকে। তিনিই সেনাপতি। গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলো বনসুরাম বক্সীর বিরুদ্ধে।গোলা, বারুদ, বন্দুক নিয়ে ইংরেজ সৈন্য ঘিরে ফেলেছে দুর্গ। সুড়ঙ্গ দিয়ে কর্ণগড় থেকে আবাস গড়ে যাওয়ার পথে বন্দি করা হল রাণিকে। সেই প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনী। মেদিনীপুরের বাণিজ্যকেন্দ্র লালকুঠি থেকে হেসে উঠল সাদা চামড়ার বেনিয়ারা । জঙ্গলের গাছে গাছে ঝুলছে বিদ্রোহীদের দেহ। রক্ত আর অশ্রু মেখে হাহাকার করছে পারাং। এদিকে গোলার আঘাতে আগেই প্রাণ হারিয়েছেন রাজা দুর্জন সিং। সময়টা ১৭৯৯ সালের ছয় এপ্রিল।

শোনা যায়, রানিকে ভালোবাসতেন স্থানীয় যুবক জনার্দন। অবশ্য সেই ভালোবাসা ছিল একতরফা। রানীর বিয়ে হয়ে গেলে জনার্দন সাধু হয়ে যান। তিনিই পরবর্তীকালে প্রতিশোধ নিতে ইংরেজদের চর হয়েছিলেন। ছল করে রানির সঙ্গে দেখা করে সুড়ঙ্গের গোপন রাস্তা দেখে নেন। এই সুড়ঙ্গ দিয়ে আত্মগোপন করার সময়ই ধরা পড়ে যান রাণি।

পরদিন সেখান থেকে কলকাতা। ফোর্ট উইলিয়াম। প্রিভি কাউন্সিল থেকে রায় এল যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের। নাড়াজল রাজা আনন্দলাল খানের মধ্যস্থতায় ঠিক হলো, তিনি গৃহবন্দি থাকবেন আবাসগড়ে। চাইলে ‌কর্ণগড় দেখে আসতে পারতেন। তবু কখনও যাননি তিনি। সব লুঠ হয়ে গিয়েছে। সাজানো রাজ্য, সাধের রাজধানী, প্রাসাদ সব শেষ। এ শ্মশান দেখতে চাননি ভারতের প্রথম রাজনৈতিক বন্দি। থেকে ছিলেন সেই আবাসগড়ে। যেখানে স্বামীর সঙ্গে মুহূর্ত কাটাতে আসতেন।

১৮১২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন জনগণের দেবী। গৃহবন্দি থাকা অবস্থাতে স্বাভাবিকভাবেই না কি গুপ্তহত্যা? সেই প্রশ্ন আজও তোলে জঙ্গলের প্রতিটি গাছ, গড়ের ধ্বংসস্তূপ। ইতিহাস চাপা পড়ে গেছে।

হারানো এই ইতিহাস তুলে ধরতেই কাজ শুরু করেছে ‘কর্ণগড় বাঁচাও, মাটি খোঁড়ো’ সংগঠন। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল সাইটে নিজেদের পেজ ও গ্রুপ খোলা হয়েছে। ট্যাগলাইন, ‘ইতিহাস মাটিতে চাপা পড়ে গিয়েছে’। কর্ণগড়ে খননকার্যের জন্য গড়ে তোলা হচ্ছে জনমত। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-আস্তিক-নাস্তিক- বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের এগিয়ে আসার কথা বলা হচ্ছে। সমস্ত রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক সংগঠন, ব্যক্তিকে আহ্বান জানানো হয়েছে। ইতিমধ্যেই পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে কুড়মি সেনা, বাংলা পক্ষ সংগঠন।

এই দাবিকে ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন জানিয়েছেন মন্দিরময় পাথরার প্রাণপুরুষ ইয়াসিন পাঠান, প্রখ্যাত সাহিত্যিক নলিনী বেরা, প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি সুমন মহান্তি, লোক সাহিত্য গবেষক চিণ্ময় দাশ। প্রাক্তন সাংসদ, সাংবাদিক, লেখক কুনাল ঘোষ। একসঙ্গে লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন কুতুরিয়া জুনিয়র হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক অরুণাংশু দে। তিনি দীর্ঘ বছর ধরে কর্ণগড় ও রাণি শিরোমনি নিয়ে গবেষণা করেছেন। গড়ে তুলছেন আর্কাইভ। তৈরি হচ্ছে রাণি’র কাল্পনিক মূর্তি।

এ প্রসঙ্গে প্রাক্তন সাংসদ, সাংবাদিক এবং লেখক কুণাল ঘোষ বলেন, ‘কর্ণগড়কে হেরিটেজ ঘোষণা করার দাবি দীর্ঘদিনের। শুধু তাই নয় বাংলার ইতিহাসের গৌরব গাথা স্থান পাক পাঠক্রমে। প্রচলিত ঘরানার ইতিহাস রচনার সময় এই মূল্যবান অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে। এই ভুল সংশোধনের সময় এসেছে। সংগঠনের সকলকে আন্তরিক শুভেচ্ছা। সমস্ত রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব বিমান বসু, অনিল বিশ্বাস, তপন শিকদার, মানস ভূঁইয়া, সোমেন মিত্র বিভিন্ন সময়ে এই বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছিলেন। বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন, ভিন্ন সময়ের দুই মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রানির স্মরণে চালু করা হয়েছে ট্রেন, গড়ে উঠেছে লজ, মহিলা আবাসিক। তারপর আস্তে আস্তে সেই কাজ কোনও কারণে আটকে গিয়েছে। গড়কে হেরিটেজ ঘোষণার জন্য নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করছে এই সংগঠন। সকলকে আন্তরিক অভিনন্দন’।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ব্যক্তিগত সমর্থন জানিয়েছেন এই দাবিকে। পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন বিধায়ক শ্রীকান্ত মাহাত, প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সাধারণ সম্পাদক সমীর রায়, ডিওয়াইএফআই- এর প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তাপস সিনহা, ঝাড়খণ্ড পার্টি (নরেণ)- এর নেত্রী বীরবাহা হাঁসদা, এবিভিপি নেতা সৌরিণ গোস্বামী।

সংগঠনের পক্ষ থেকে নিসর্গ নির্যাস বলেন, ‘ইতিহাসে সম্পূর্ণ সত্যি থাকা উচিত। তা নিয়ে গবেষণা করা উচিত। কিন্তু দুর্ভাগ্য, ইতিহাস বিভিন্ন সময়ে সংকুচিত-প্রসারিত-বিক্রিত হয়। ভারতবর্ষের প্রথম রাজনৈতিক বন্দিনীর গড় খাতায়-কলমে হেরিটেজ মর্যাদা পাক। এলাকাজুড়ে চালানো হোক খননকার্য। রাজ্য-দেশবাসীর কাছে তুলে ধরা হোক প্রকৃত ইতিহাস। জেলাজুড়ে কাজ করার জন্যই আমাদের ‘হেরিটেজ জার্নি’ সংগঠন তৎপর।’

বি: দ্র:

১. কর্ণগড় মন্দির থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে এই গড়।

২. রানি শিরোমণি ছিলেন কুড়মি সম্প্রদায়ের (ড: রাজীব কুমার মাহাত ও শৈলেশ কুমার অকেলা’র মতে)।

৩. কর্ণগড় মন্দির চত্বরেই ‘শিবায়ন’ লিখেছেন কবি রামেশ্বর ভট্টাচার্য।

 

Previous articleআজ থেকে মেনে চলতে হচ্ছে নয়া কোভিড বিধি
Next articleডার্বি অতীত, ওড়িশা এফসির বিরুদ্ধে তিন পয়েন্ট লক্ষ্য হাবাসের