পঞ্চাশ বছরের একাকিত্ব: কেমন আছেন শহিদ-পত্নী অনিতা?

জয়িতা মৌলিক

পুতির হাত ধরে কখনও জাহাজ ঘাটে গেলে এখনও সাইরেনের আওয়াজটায় মন কেমন করে ওঠে ৮৬ বছরের অনিতা সেনের। ৯ ডিসেম্বর, ৪৯ বছর পেরিয়ে ৫০ বছরে পড়ল। ১৯৭১-এর এই দিনে ডুবো জাহাজের টর্পেডো হানায় ডুবে গিয়েছিল আইএনএস কুকরি। তার সাথে ডুবে গিয়েছিল একজন ৩৬ বছরের বধূর স্বপ্ন। ৫ দিন আগের কথা, ৪ ডিসেম্বর করাচি বন্দর ধ্বংস করে ফিরে আসছিল আইএনএস কুকরি, ক্যাপ্টেন মহেন্দ্রনাথ মৌলা। আর সেই বাহিনীরই লেফটেন্যান্ট কমান্ডার ছিলেন তরুণ বাঙালি যুবক রজতকুমার সেন। হঠাৎই ৯ তারিখ পাকিস্তানি ডুবোজাহাজ থেকে টর্পেডো হানা। সেই হামলাতেই শহিদ হন রজতকুমার সেন। একা হয়ে যান নিঃসন্তান অনিতা।

তবে, জীবন থেকে হারিয়ে যাননি তিনি। সংসারের আর পাঁচজনকে নিয়ে এগিয়ে চলেছেন। শহিদের স্ত্রী হিসেবে কেন্দ্র এবং সরকারি সাহায্য তিনি পেয়েছেন। তাতেই প্রথমে ব্যাঙ্কের চাকরি নেন প্রায় চার বছর চাকরি করার পর সুযোগ আসে ব্যবসা করার। সেই সুযোগও আসে শহিদের স্ত্রী হিসেবে। সরকারের তরফ থেকে পেট্রোল পাম্পের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। প্রায় ৪২ বছর সেই ব্যবসা চালান অনিতা। আর সেই ব্যবসার টাকা তিনি ব্যয় করেন সমাজসেবামূলক কাজে। কখনও স্কুলে দিয়েছেন, কখনও দিয়েছেন ছোট বাচ্চাদের।

তবে সুচিত্রা মিত্রের কাছে গান শেখা, রবীন্দ্রভারতী থেকে স্নাতকোত্তর অনিতার ব্যবসা ঠিক পছন্দ নয়। আজও অশীতিপর চোখে পিছন ফিরে দেখলেও ওই সময়টাকে ভালো লাগে না। মনে হয়, ব্যবসা না করে ওই সময় আরও সমাজসেবা করলে ভালো হত।

এখন আর গান গাইতে পারেন না খুব একটা। তবে গান শোনার অভ্যাস আছে পুরোদস্তুর। কিছুদিন আগেই পেরিয়ে গেল সুচিত্রা মিত্রের জন্মদিন। সেই দিনে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের করা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তিনি। গান গাইতে পারেননি কিন্তু শুনেছেন। আর ভালবাসেন রান্না করতে। ছোটদের সঙ্গে সময় কাটাতে।

আর সেই জন্যেই এখন তাঁর দিনের অনেকটা সময় কেটে যায় নাতির কন্যা অর্থাৎ পুতির সঙ্গে কাটিয়ে। চার বছরের আদ্রিতা জানাল, যেকোনো রকম খেলাতেই সে তার ‘তিতি’র সঙ্গী।

কিন্তু প্রায় ৫০ বছরের একাকীত্ব। সে তো বড় কম নয়। কষ্ট হয় না? প্রশ্নের উত্তরে স্মিত হেসে অনিতা জানান, “সব কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে শিখেছি সবাইকে নিয়ে চলি। আমার নিজের সন্তান না থাকলেও ভাইপো-ভাইঝিরা আছে, নাতি-নাতনিরা আছে। আছে নাতির ঘরের পুতিরাও। এদেরকে নিয়ে আমি এগিয়ে চলি। এরাই আমাকে আগলে রাখে”।

তবুও আজ দেওয়ালে টাঙানো সেই স্মৃতিগুলি দেখলে চোখের কোণ ভিজে ওঠে। মনে পড়ে যায়, ১৯৭৩ সালে তৎকালীন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরির থেকে স্বামীর মরণোত্তর বীর চক্র নেওয়ার স্মৃতি। মনে পড়ে, সেই মুক্তিযুদ্ধের কথা।

সংক্রমণের আশঙ্কায় এখন আর খুব একটা বাইরে বেরোন না। তবে সব দিকেই তাঁর প্রখর দৃষ্টি। খবর রাখেন নতুন সমাজের, বদলে যাওয়া দিনের। আট থেকে আশি সবাই তাঁর বন্ধু। সেই কারণেই অনেকের কাছেই উদাহরণ অনিতা সেন।

আরও পড়ুন- পিকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ এবার ময়নাগুড়ির বিধায়কের

Previous articleপিকের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ক্ষোভ এবার ময়নাগুড়ির বিধায়কের
Next articleশাসক দলের ১০ বছরের রিপোর্ট কার্ড বৃহস্পতিবার প্রকাশ্যে