অমিত কুমার দাস: শুক্লপক্ষের দ্বাদশীতে অরণ্য আজ নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে মোহময়ী রুপে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে গোটা বনানী। শ্রাবণের অবিরাম ধারা বুকে নিয়ে অরণ্যের বুক চিরে ছুটে চলেছে বেনামী জলস্রোত। হয়তো কোনও এক নদীর ডাকে ধাবমান এ জলধারা। তার কোল ঘেঁষে সৃষ্টি হয়েছে ধ্যানস্ত সাধুর মত এক দিঘি। রাত্রির অরণ্য কখনো স্তব্ধ থাকে না। তবে এ পৃথিবী আজ বড় নিস্তব্ধ। দমবন্ধ করে এক বীভৎস কিছুর প্রমাদ গুনছে সে। চন্দ্রালোকিত রাত্রির এ অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য কোনও এক আনকোরা কবির কলমও শানিয়ে তুলতে পারে চকচকে তলোয়ারে। কিন্তু পৃথিবীর এ সৌন্দর্যে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই ওর। কী হবে এই সৌন্দর্যে। মোহ, মায়া, ঐশ্বর্যে নিজেকে তিল তিল করে সাজিয়ে তোলা শরীরের অন্তিম পরিণতি যে মৃত্যু। আগে হোক বা পরে, চূড়ান্ত বাস্তবটাকে মেনে নেওয়ার সময় এসেছে। ধাবমান ওই জলস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিলে কেমন হয? মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত তারপর পার্থিব শরীর থেকে ধীরে ধীরে ছিঁড়ে পড়বে প্রাণ নামক ঐশ্বর্য। লক্ষের ভিড়ে অরণ্য তার হিসেবের খাতায় তুলে রাখবে না কয়েক মুহূর্ত আগে এইখানে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল তার আস্ত শরীরটাকে নিয়ে।
সমস্ত চিন্তাভাবনাকে পেছনে ফেলে অতি ধীর পায়ে ছোট্ট পতঙ্গটা এগিয়ে গেল দিঘির আরও কাছাকাছি। টলটলে জলধারায় প্রতিবিম্বিত গোটা মহাকাশ। চন্দ্র, নক্ষত্র, ছায়াপথ, হাজার গ্রহের ভিড় এই জলাধারে। সকলে যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এ অরণ্য, এ নিস্তব্ধ পৃথিবী সকলে মিলে তাকে পাঠ করাচ্ছে জীবনের আদি সত্য। আর বিলম্ব নয়, দিঘির স্তব্ধ গহীন জলে মৃদু কেঁপে উঠল মহাশূন্যের আলোক পিণ্ডটা। তবে কাঙ্খিত মৃত্যু এত সহজ নয়। এরপর প্রকৃতির আদিম ভয়াল নিয়মের অংক কষে শুরু হলো নিশংস মৃত্যুর দ্বিতীয় পর্ব। তখনও জীবন্ত ছোট্ট ঘাসফড়িঙটার(Grasshopper) শরীর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে থাকল দীর্ঘ সুতোর মতো অদ্ভুত আর এক জীবন। একটি-দুটি নয় অনেকগুলি।
আপাতদৃষ্টিতে বিষয়টি আত্মহত্যা(Suicide) মনে হলেও মোটেও তা নয়, এ এক নৃশংস খুন(Murder)। প্রকৃতির এক নিষ্ঠুর খেলার শিকার ওই ঘাসফড়িঙ। পতঙ্গটার গোটা শরীর ছেড়ে সরু সুতোর মতো যে প্রাণ বের হয়ে আসছে সেগুলি আর কিছু নয় হর্স হেয়ার ওর্ম(Horsehair Worm) নামের এক ফিতা কৃমি। দীর্ঘদিন ধরে ঘাসফড়িঙের শরীরের অভ্যন্তরে বাসা বেঁধেছিল সে। তবে শুধু বাসা বাঁধা নয়, শরীরের ভেতর থেকে তার রক্তমাংস নাড়িভুঁড়ি সমস্ত কিছু কুরে কুরে খেয়ে গেছে। প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ার পর ঘাসফড়িঙটিকে বাধ্য করা হয়েছে আত্মহত্যায়। কী উপায়ে এবং কোথায় হবে এই আত্মহত্যা সেটাও বাতলে দিয়েছে ওই সুতা কৃমি গুলি।
তবে সুতা কৃমি ও ঘাসফড়িঙের এই বীভৎস জীবনচক্রের গল্পের শুরুটা ছিল অনেক আগে থেকেই। যখন এমনই এক ঘটনার পর জলে ডিম ছেড়েছিল সুতা কৃমিটি। জলে থাকা বেশ কিছু পোকামাকড়ের লার্ভার সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ডিম ফুটে বের হয় সুতা কৃমির লার্ভা। এরপর তারা স্থান নেয় পোকামাকড়ের লার্ভাগুলির পেটের অন্দরে। জীবনের নিয়মে পোকার লার্ভা বড় হওয়ার পর জল ছেড়ে আকাশে উড়ে যায় সেগুলি। ওই পোকা এবার উড়ে বসবে কোনও গাছের পাতা ও ডালে। কোনও পোকাকে খেয়ে নেবে বড় পাখি। এই সমস্ত পোকা ও পাখির মলের সঙ্গে মিশে থাকবে ওই কৃমিরা। ঘাসফড়িঙ বা ঝিঁ ঝিঁ পোকার মতো পতঙ্গরা অবশ্য এসবের কিছুই জানে না। নিজের অজান্তেই সেই সমস্ত পাতা, ডাল বা মলের সংস্পর্শে আসে ঘাসফড়িঙ। শেষের শুরুটা হয় সেখান থেকেই। মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই ঘাসফড়িঙের পেটের ভেতর তার রক্ত মাংস খেয়ে বড় হয়ে ওঠে কৃমির দল। পূর্ণবয়স্ক হওয়ার পর এবার প্রয়োজন বংশবিস্তারের।
তখনই ঘটে প্রাকৃতিক নৃশংসতার পরের ধাপ। ঘাসফড়িংয়ের শরীরের ভেতর থেকেই পূর্ণবয়স্ক কৃমিরা ছেড়ে দেয় দুটি বিশেষ ধরনের প্রোটিন(Protein)। এই প্রোটিন হানা দেয় ঘাসফড়িঙের মস্তিষ্কে। এতক্ষণে ঘাসফড়িঙ আর নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন নেই। ওই প্রোটিনের দৌলতে তার সমস্ত শরীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছে কৃমি। কোনও হলিউড সিনেমার মতো জম্বিতে(zombie) পরিণত হওয়া ঘাসফড়িঙের সমস্ত কাজকর্ম চলতে থাকে সুতা কৃমির নির্দেশ মত।
আরও পড়ুন:বইমেলা breaking: সরকারি মদতের মোড়কে কণ্ঠরোধ, ফুঁসছে বইপাড়া
শুরুতেই ঘাসফড়িঙকে নির্দেশ দেওয়া হয় পুকুর ডোবার মতো কোনও জলাধারের কাছাকাছি যেতে। শরীরের অভ্যন্তরে থাকা বীভৎস রাক্ষসের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে এগিয়ে চলে সে। নিস্তব্ধ রাত্রির অন্ধকারে জলাশয়ের কাছাকাছি পৌঁছানোর পর নির্দেশ আসে লাফিয়ে পড়ার। নিশির ডাক এড়ানোর ক্ষমতা নেই ঘাসফড়িঙের। এরপরই দেখা যায় সেই নিষ্ঠুর দৃশ্য। পতঙ্গটির পেট ফেটে বেরিয়ে আসছে লম্বা সুতোর মতো কৃমিরা। দীর্ঘদিন পর খোলা পৃথিবীতে আলো বাতাস পেয়ে জলের মধ্যে কিলবিলিয়ে ওঠে সেগুলি। তাদের ঠিক পাশে তখন ভেসে রয়েছে প্রকৃতির নিষ্ঠুর পরিহাসের শিকার হওয়া অসহায় ঘাসফড়িঙের মৃতদেহ।