মধ্যঘুমের আতঙ্ক! ‘বোবায় ধরা’ ভুতুড়ে কাণ্ড নয়, বিজ্ঞানের এক মজার খেলা

অমিত কুমার দাস: ভূত ও ভয়! সেই শৈশব থেকে এই দুই আমাদের নিত্যসঙ্গী। বিজ্ঞানের(science) ব্যাপক বিস্তারের মাঝেও মানুষের অবচেতন মনের কোনায় গোপনে লুকিয়ে থাকে এই ভয়ে আঁধার। দৈনন্দিন জীবনে কখনো কোথাও সঠিক পটভূমি পেলে আজও ঠেলে বেরিয়ে আসে চিরপরিচিত সেই আদি ভৌতিকতা(paranormal activity)। পাশাপাশি ঘটনাবহুল জীবনে কোনও অভিজ্ঞতার যদি বিজ্ঞানসম্মত সঠিক কারণ না পাওয়া যায় সেখানে ‘এক্স ইকুয়াল টু ভূত’ ধরে নিয়েই অংক কষে মানুষের প্রাগৈতিহাসিক মস্তিষ্ক। তেমনই এক বিষয় হলো ‘বোবায় ধরা'(sleeping paralysis)। পাড়াগাঁয়ে এর নাম ‘বোবা ভূত’। আর এই ভুতের সাক্ষাৎ হয়নি এমন মানুষ রীতিমতো বিরল।

রাতবিরেতে ঘুমের মধ্যে শরীরে চেপে বসে এই ভূত। পরিস্থিতি এমন হয় যে হাত-পা নাড়ার শক্তিটুকু থাকে না মানুষের। বন্ধ হয়ে আসে গলার স্বর। ফলে চিৎকার করে কারো সাহায্য নেওয়ার মতো উপায় থাকে না বোবা ভূতের কবলে পড়া ব্যক্তির। ঘুমের মধ্যে চলতে থাকা এই ধরনের উপসর্গ সাধারণত বোবা ভূতের কাণ্ডকারখানা বলে প্রচলিত রয়েছে লোকমুখে। ফলে ভূতের হাত থেকে নিস্তার পেতে তান্ত্রিক, ওঝা সহ নানান ধরনের তাবিজ-কবচেরও আশ্রয় নেয় মানুষ। ‘এক্স ইকুয়াল টু ভূত’ ধরে নিয়ে এই অংকের সমাধান সহজ হলেও আদতে এর পিছনে রয়েছে মানব শরীরের এক মজার বিজ্ঞান। আসুন জেনে নেওয়া যাক কে এই বোবা ভূত? আর কেন রাতবিরেতে মানুষের শরীরের উপর হানা দেয় সে?

বিজ্ঞানের ভাষায় এই ঘটনাটির নাম হল স্লিপিং প্যারালাইসিস। মানুষ যখন ঘুমোয় তখনই মানুষের ঘুম REM ও NREM এই দুটি চক্রে সম্পন্ন হতে থাকে। মানুষ নিদ্রাচ্ছন্ন হওয়ার পরপরই শুরু হয়ে যায় NREM ধাপ। ঘুমের প্রথম ১০ থেকে ২৫ মিনিট পর আমরা ধীরে ধীরে প্রবেশ করতে থাকি গভীর ঘুমের দিকে। এ সময় ধীরে ধীরে শিথিল হতে থাকে আমাদের শরীরের সমস্ত অস্তি ও পেশীগুলি। যার ফলে ঘুমের মধ্যেই আমাদের হাত পা সহ শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রমশ অসাড় হতে শুরু করে। বিজ্ঞান বলছে, মানব শরীরে এই ঘুমের সময় দেহের মধ্যে চলতে থাকে সারাদিনের ধকল ও অন্যান্য কঠিন পরিশ্রমের পর শরীরের ক্ষয়ক্ষতিগুলি মেরামতের কাজ। তবে শরীরের সমস্ত অঙ্গ নিস্তেজ হয়ে গেলেও দুটি অঙ্গ সক্রিয় থাকে। তা হল আমাদের মস্তিষ্ক এবং চোখ। আর ঠিক এই জায়গাতেই রেয়েছে বোবা ভূতের আস্তানা।

গবেষণা অনুযায়ী, মানুষের গভীর ঘুমের এই পর্যায়ে যদি কোনভাবে আমাদের চেতনা চলে আসে দৃষ্টি সক্রিয় থাকায় আমরা আবছা আবছা দেখতে পাই। কিন্তু শরীরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পেশি নিষ্ক্রিয় থাকায় হাত-পা নাড়ানোর অবস্থা থাকে না আমাদের। এই অবস্থাটা মানুষের জীবনে সবচেয়ে অসহায় অবস্থা। শরীরের কোনও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নড়াচড়ার ক্ষমতা না থাকায় মনে হয় বুকের উপর কেউ চেপে বসে রয়েছে। স্বাভাবিক সত্তা থেকে আমাদের মস্তিষ্ক তখন যা ঘটছে তার কারণ খোঁজে। উপযুক্ত কারণের খোঁজ না পাওয়ায় ঠেলে বেরিয়ে আসে শৈশব থেকে মানুষের অবচেতন মস্তিষ্কে লুকিয়ে থাকা ভূতের দল। ভূত ও অলৌকিকতার সঙ্গে অবগত মানুষের মস্তিষ্ক তখন হ্যালুসিনেট করে চেনা পরিচিত ভূত সত্তাকে। ব্যাস দুয়ে দুয়ে চার হয়ে যায় এখানেই। তবে এর সমাধান হলো যদি এই অবস্থায় কেউ ওই আক্রান্ত ব্যক্তির শরীর স্পর্শ করেন তখন স্পর্শ সংবেদনশীলতায় শরীরের বাকি অংশগুলো চেতনা ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। অন্যথায় বেশ কিছুটা সময় বোবা ভূত আপনার বুকের উপর চেপে ভয় দেখিয়ে যাবে আপনাকে। আর এই সময়টুকু আপনার জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় একটা সময়।

আরও পড়ুন:রীতি মেনেই পালিত হবে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথি, সাধারণের জন্য এবারও বন্ধ বেলুড়

২০১১ সালে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে এ বিষয়ে বিস্তর গবেষণা চালানো হয়েছিল। তাদের রিসার্চ অনুযায়ী, এই বোবা ভুতে আক্রান্ত হওয়ার পিছনে অভিযুক্ত আপনি নিজেই। আপনার বিষণ্ণতা ও অনিয়মিত ঘুম মূলত এর জন্য দায়ী। আরও যে সমস্ত কারণগুলি উঠে আসে তা হল, নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত না ঘুমানো, কম ঘুম, উপুড় হয়ে ঘুমানো, অতিরিক্ত মাদক সেবন, বাইপোলার ডিজঅর্ডার, শক্তি বৃদ্ধির ওষুধ খাওয়া এবং অতিরিক্ত ঘুম কাতুরে হওয়া। সবশেষে এটাই বলা যায়, আপনার দৈনন্দিন অভ্যাস যদি সঠিক থাকে তাহলে এই ভুতের খপ্পরে পড়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই আপনার। অন্যথায় রাতবিরেতে ভুতের খপ্পরে পড়তে হতে পারে আপনাকে।

Advt

Previous articleরীতি মেনেই পালিত হবে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথি, সাধারণের জন্য এবারও বন্ধ বেলুড়
Next articleপিটারসনদের কাছে হারল সচিন, সহবাগরা