শীতলকুচির ঘটনা আর কিছু প্রশ্ন

পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভোট উৎসবে শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ হিসাবে বেশ কিছু প্রশ্ন তুলছি।

১. একটা বিবৃতিতে বলা হয়েছে বহু মহিলা হাতা খুন্তি নিয়ে বাহিনীকে আক্রমণ করতে এলে
নাকি ‘আত্মরক্ষার্থে’ গুলি চালিয়েছে সিআরপিএফ। তার মানে বাহিনী আক্রান্ত হয়েছিল। আক্রমণকারীরা কি সশস্ত্র ছিল? এখনো অবধি তেমন কোনো খবর নেই (পরে তৈরি হতেও পারে অবশ্য)। তাহলে গুলি চালাতে হল কেন? যদি আক্রমণকারীরা সশস্ত্র হয়ে থাকে, তাহলে সেই অস্ত্রে কেউ কি ঘায়েল হয়েছে? আক্রমণ তো আঘাতের চিহ্নেই প্রমাণ রেখে যায়, তাই না?
২. আক্রমণ করতে এসে সি আর পি এফ কে মহিলারা ঘিরে ধরেছে। অথচ ওদের গুলি একজন মহিলাকে আক্রান্ত করল না, করলো পুরুষদের। কী করে সম্ভব?

৩. গুলি চালানোর যে রুলস এণ্ড রেগুলেশন আছে তাতে মবকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ভয় দেখানোর জন্য প্রথমে শূন্যে, তারপর মাটির দিকে, তাতেও কাজ না হলে শরীরের নীচের দিকে।এরপরও যদি জাজ না হয় তশলে সুপারিন্টেন্ডেন্ট পদের কোনো অফিসারের নির্দেশ নিয়ে তবে গুলি চালানো যায়। সেই নিয়ম কি আদৌ মানা হয়েছে? আর তা যদি মানা না হয় তাহলে খুন করার ইচ্ছা নিয়ে সন্ত্রাস চালানোর অভিসন্ধি নিয়ে এটা করা হয়েছে। কেন? কেন বাহিনী মানুষদের শরীর তাক করে গুলি ছুঁড়লো? কেন?

৪. চারজনের মৃত্যু (শোনা যাচ্ছে অন্তত ৮জন আহত) মানে কম করেও ১০-১২ রাউন্ড গুলি চলেছে। ভয়ঙ্কর হিংস্র আক্রমণ না হলে এমনভাবে গুলি চলে? এমন ভয়ঙ্কর আক্রমণ হল বাহিনীর ওপর, অথচ স্থানীয়রা সে-কথা বলছেন না! আশ্চর্য! এই ঢাক ঢাক গুড় গুড় করছে কেন কমিশন?

৫. যাঁরা গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেলেন, তাঁরা কি সবাই বিক্ষোভকারী? এখনো অবধি পাওয়া খবরে, তাঁদের মধ্যে অন্তত ৩জন ‘সাধারণ ভোটার’। ভাবুন, বাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে হিংস্র মব। তাঁদের হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে গুলি ছুঁড়ছে বাহিনী। অথচ গুলি লেগে মারা যাচ্ছেন সেই ঘিরে ফেলা বিক্ষোভকারীদের থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়ানো সাধারণ ভোটার। কীভাবে এটা সম্ভব? ভিতরের গল্পটি কী?

৬. ট্রেইনড জওয়ান, হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল। তাঁরা জানেন কীভাবে বিক্ষোভ ঠেকাতে হয়। তাঁদের ঘিরে ফেলতে কম করেও ৬০-৭০ জন সশস্ত্র মানুষ লাগেই। যদি বাস্তবে সেটাই ঘটে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর জায়গায় গেছিল। অথচ মিডিয়া বা সাধারণ মানুষ, কেউই ঠিক সেই পরিস্থিতির কথা বলতে পারছেন না। তাহলে কী এমন হল যে বাহিনী ‘বাধ্য হল’ গুলি চালাতে?

৭. ইলেকশন কমিশনের পরিষ্কার নির্দেশ আছে কোন বুথে কোথাও উত্তেজনাকর কিছু হলে সেখানকার ভিডিও করতে হবে। এক্ষেত্রে সেই ভিডিও কোথায়? কেন এই ঘটনার একটা ছবি বা ভিডিও প্রকাশ হল না? এখন তো সব মানুষই নানা ঘটনার ভিডিও আপলোড করে দেয় সোস্যাল মিডিয়াতে। এক্ষেত্রে হয় নি কেন? তাহলে কি কেউ ভিডিও করে নি? নাকি ভিডিও করা মানুষদের ফোন বাহিনী সিজ করে নিয়েছে। তেমন একটা খবর অবশ্য শোনা যাচ্ছে। সুতরাং সত্যকে প্রকাশ্যে আনতে চাইছে না কেন?
৮. যে সি আর পি এফ জওয়ানরা গুলি চালিয়েছিল, আরও অন্যান্য জওয়ানরা এসে ওদেরকে নিয়ে চলে গেল। ঘটনাস্থলে পড়ে রইলো নিরিহ ভোট কর্মীরা। উন্মত্ত জনতার হাতে তারা শেষে আক্রান্ত হলেন। তাহলে তাদেরকে বাঁচাবে কে? তাহলে কি নির্বাচন কমিশন বাহিনী কে দিয়ে গুলি চালিয়ে সন্ত্রাস করে মানুষ কে ভয় দেখাতে চেয়েছে? ভোটকর্মী ও সাধারণ ভোটারদের নিরাপত্তা দেবে কে?

৯. মুসলিম জনগণের উপর এই আক্রমণ করে কি এই বার্তা দিতে চাইলো কি যে, তোমরা ভোট দিলে বিজেপির বিপক্ষে দেবে। তাই আর ভোট দিতে তোমরা এসো না। এলেই তোমাদের এই দশা হবে।

১০. যাঁরা মারা গেলেন, তাঁদের নাম কী? পরিচয় কী? ওই বুথের চরিত্র কী? এগুলোও জানার খুব প্রয়োজন নয় কি?

১১. এই রাজ্যে আগেও পুলিশের গুলিতে মানুষ মারা গেছেন, পুলিশের লাঠির আঘাতেও কদিন আগে মারা গেছেন একজন বাম-সমর্থক। রাষ্ট্রের হাতে রক্ত লেগেই থাকে বারবার। কিন্তু ৮ জন গুলিবিদ্ধ, ৪ জনের মৃত্যু– এইটা খুব স্বাভাবিক ও সাদামাটা ঘটনা নয়। নিছক ‘আত্মরক্ষা’-র জন্য এই ঘটনা ঘটানো হয়েছে বলেও মনে হয় না। এটা হয়তো একটা স্টেটমেন্ট, বা রাষ্ট্রের ক্ষমতা প্রদর্শনের প্রতীক।যা এই দফা-সহ বাকি দফার ভোটে কাজে লাগবে। আর, এমন বেনজির ঘটনা নিয়ে যতটা উত্তাল হওয়া উচিত, টেলিভিশন মিডিয়া তার সামান্যও উত্তাল নয়। অন্তত বাহিনীর ওপর আক্রমণ নিয়েও তো প্রচার চলতে পারত। কিন্তু সেভাবে নামছে না। কারণ, সেই ‘আক্রমণ’ প্রতিষ্ঠা করা চাপ। উলটে প্রচারে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। তাই চেষ্টা চলছে এই ঘটনাকে খবরের ভিড়ে একটা খবর-মাত্র করে রাখার। তাহলে কি চেষ্টা চলছে আমাদের অভ্যস্ত করার? যেভাবে চলে আর কী?

অঙ্কগুলো মিলিয়ে দেখলে যা বেরোচ্ছে, তা বেশ ভয়ের। এই নির্বাচন শুধুমাত্র একটা বিধানসভা নির্বাচন থাকছে না। উত্তাল প্রতিবাদ ছাড়া আর কোনো পথ আছে কি?

ভয় এর পরিবেশ তৈরী করতেই কি এই পদক্ষেপ? মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলার নামে বা বোকা বানিয়ে সেন্ট্রাল ফোর্স দিয়ে বন্দুকের নল দেখিয়ে কি বিজেপিকে ভোট দেওয়ার মরিয়া চেষ্টা চলছে?

তাই পরিশেষে বলি স্বতস্ফূর্ত ভাবে ভোট দিন। শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রেখে ভোট দিন। অন্যকেও ভোট দিতে সাহায্য করুন। ফ্যাসিস্ট নাৎসি বাহিনীর শক্তি কে পরাজিত করার জন্য ভোট দিন। যাকে ইচ্ছে ভোট দিন। শুধু বিজেপিকে ভোট দেবেন না। একটি ভোটও নয়।

Advt

Previous articleTMC vs BJP: নানুরে বোমাবাজির ঘটনায় আটক, আনন্দপুর সংঘর্ষে লাঠিচার্জ পুলিশের
Next articleবেশি খেলতে গেলে শীতলকুচির খেলা খেলে দেব, প্রচারে লাগামহীন সায়ন্তন