সত্যই ঈশ্বর, কিন্তু ঈশ্বর সত্য নয়

 

পার্থ প্রতিম বিশ্বাস

ভারতবর্ষে বসবাসকারী শতকরা ৯৯% মুসলমানই কোনো একসময় হিন্দু ছিলেন। হিন্দু সমাজের মাথা হিসাবে পরিচিত তথাকথিত বর্ণ হিন্দুরা সবার আগে জাতপাত সৃষ্টি করে কিছু মানুষকে (হতে পারে তারা দুর্বল, গরীর ও অশিক্ষিত ছিলেন) নিচু জাতি হিসাবে চিহ্নিত করলো। তারপর নিজেরাই নিজেদের পছন্দসই কিছু উটকো বিধি চালু করে ওই তথাকথিত নিচু জাতের মানুষগুলোর ওপর অত্যাচার শুরু করলো। সেই অত্যাচার এতটাই চরমে পৌঁছালো যে, মানুষগুলো নিজেদের বাঁচার স্বার্থে ধর্মান্তরিত হলেন। তাদের সবাই যে মুসলিম হলেন, এমনটা কিন্তু মোটেও নয়। বহু মানুষ খ্রিষ্টান বা অন্য ধর্মেও নিজেদের পরিবর্তন করেছেন। এতেও তথাকথিত বর্ণ হিন্দুরা থামেনি। ধর্ম বা সমাজ থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পরেও তারা বিশেষ করে মুসলমানদের ওপরেই অত্যাচার শানিয়ে আনলো। আজও সেই ট্রাডিশন সমানে চলেছে।

এটা যেমন ইতিহাস, তেমনি এর কিছু অন্যথাও আছে।
লক্ষণ সেনের পর মূলতঃ মুসলিমদের দাপটেই অত‍্যন্ত গরীব হিন্দু সম্প্রদায় যাদের ডেস্টিটিউটস বলা যেতে পারে তারা প্রাণ বাঁচাবার তাগিদে মুসলিম ধর্ম অবলম্বন করে। একইভাবে গরীব হিন্দু খ্রিষ্টান হয় ঔপনিবেশিক শাসনের ফলশ্রুতি হিসেবে। ব্রাহ্মন‍্যবাদ জাত পাতের জনক এবং যুগ যুগ ধরে নিম্নবর্নের মানুষদের এরা শোষণ বঞ্চনা নিপীড়ন দমন করেছে। সবটাই জোর যার, মুলুক তার।
এই ইতিহাস নিয়ে বিতর্ক করার কোনো জায়গা নেই।

আসলে ধর্ম না কর্ম, কোনটাকে আমরা গুরুত্ব দেবো, এটা আগে ঠিক করতে হবে। শ্রী শ্রী গীতা বলছে “কর্মই ধর্ম”। আমরা যারা শ্রী শ্রী গীতাকে মানি, যারা বিশ্বাস করি, সময় করে পড়তে না পারলেও শ্রী শ্রী গীতা বইটা ঘরে রাখলেই শান্তি বজায় থাকে, তাদের কাছে এই ধন্দ কিন্তু আজও রয়েই গেছে। ধর্ম তত্ব নিয়ে আলোচনা করতে বসলে পুঁথিকে বাদ দিয়ে আলোচনা কোনোমতেই সম্ভব নয়। আর কোনো মোটা মাথার শয়তান যদি আমাদের ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চায়, নিজের মনগড়া মোটা দাগের ইতিহাস পড়িয়ে ধান্দা করতে চায়, তাতে কিছু অশিক্ষিত অন্ধ সায় দিতেও পারে কিন্তু নুন্যতম শিক্ষা আছে এমন কারও পক্ষে সায় দেওয়া সম্ভব নয়। যুগ এগিয়ে চলেছে, ধারণা বিশ্বাস আস্থা সবই বদলাচ্ছে। ২১ শতকে বসে আমরা কিছুতেই পঞ্চদশ শতকের মানসিকতা পোষণ করতে পারিনা। ধর্ম নিয়ে আলোচনা আমাদের ততক্ষণই ভালো লাগে যতক্ষন আমাদের পাপী পেট ক্ষিদের জ্বালায় চিৎকার করে ককিয়ে ওঠেনা।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেই নিই, ১৯৪৭ এর আগষ্টে তৎকালীন ভারতবর্ষ ভেঙে আলাদা একটা মুসলিম দেশ হয়েছিলো, তাহলে এটাও মানতে হবে যে, ১৯৪৭এর ভারতবর্ষে থাকা মোট ২৮ কোটি মুসলমানের সংখ্যালঘু অংশ অর্থাৎ সাড়ে ১৩ কোটি ওই নতুন সৃষ্টি হওয়া মুসলিম দেশে চলে গিয়েছিলেন। আর নবগঠিত ভারতবর্ষকে মা তথা মাতৃভূমি মেনে একদা তার বুকেই জন্ম নেওয়া সাড়ে ১৪ কোটি অর্থাৎ সংখ্যাগুরু মুসলমান সব প্ররোচনা উপেক্ষা করেই ভারতবর্ষে থেকে গিয়েছিলেন। সেই তাদের এবং তাদের উত্তরাধিকারদের আমরা কোনোমতেই অস্বীকার উপেক্ষা অবহেলা অসম্মান বা ঘৃণা করতে পারিনা।

এই আলোচনা বা বিচারের ক্ষেত্রে সর্বাগ্রে যা মনে রাখা দরকার, তা হলো ” সত্যই ঈশ্বর কিন্তু ঈশ্বর সত্য নয়”।

ইতিহাস আলোচনার সময়ে ইতিহাসেই থাকতে হয়। ব্যাক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ সম্বলিত মতামত সে আলোচনাকে বিকৃত পথে নিয়ে যেতে বা প্রভাবিত করার চেষ্টা করতে পারে, কিন্তু ইতিহাসকে কখনোই বদলে দিতে পারেনা।
সবরকম স্বার্থের উর্ধ্বে উঠে সঠিক পথ দেখাতে চাই সুস্থ আলোচনা ও সিদ্ধান্ত।

রাজা রামমোহন যখন সতীদাহ প্রথা বন্ধ করতে এবং ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর যখন বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করতে উদ্যোগী হন, তখন তাদের সাথে সংখ্যা নয় অকাট্য যুক্তিটুকুই ছিলো। তাইতো সামান্য সংখ্যক মানুষের সমর্থন নিয়েই এবং প্রবলতর বিরুদ্ধ মত থাকা স্বত্তেও তাঁরা জয়ী হয়েছিলেন।

আজ নিজেদের বিক্রিত এবং বিকৃত মানষিকতা দিয়ে ইতিহাসকেও যারা বিকৃত করতে চান, সেই তাদের নামটাও একদিন ইতিহাসে লেখা হবে কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার যে, তারা সর্বদাই ইতিহাসের মীরজাফর বা বিভীষণের তালিকাতেই থাকবেন। তাই আলোচনায় বসার আগে বা সময়ে চিন্তায় একটু শান দিতে হবে।

আমি বা আমার মতো দেশের অধিকাংশ মানুষ, যাদের পরিচয়ের খাতায় হিন্দু শব্দটাও আছে, তারা বাস্তবে কখনোই মুসলমানদের শত্রু ভাবিনা বা ভাবেন না। যারা ভাবেন তারা নিজেরা কতটা হিন্দু সেটাই বিতর্কের বিষয়।

Advt

Previous articleকরোনা মোকাবিলায় নাইট কার্ফু ত্রিপুরায়
Next articleকরোনায় আক্রান্ত ধোনির বাবা-মা, ভর্তি হাসপাতালে