আমের দেশে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

সুখেন্দু শেখর রায়

[ আজ, ১৬ জুন, দৈবকণ্ঠ ও সুরের যাদুকর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ১০১তম জন্মদিন। ১৯৭৭ সালে মালদহ ষ্টেডিয়ামে প্রথমবার হেমন্তবাবুকে
নিয়ে গেছিলাম আমাদের অনুষ্ঠানে। তারই স্মৃতিচারণা, অল্প কথায়। ]

বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ছাড়া কী অন্য শিল্পী নেই?’ নতশিরে মৃদুস্বরে বলেছিলাম, আমরা আপনাকে ছাড়া যে অনুষ্ঠানই করব না। শেষ পর্যন্ত বেলাবৌদির কথায় নিমরাজি হলেন
বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, ‘আমি ছাড়া কী অন্য শিল্পী নেই?’ নতশিরে মৃদুস্বরে বলেছিলাম, আমরা আপনাকে ছাড়া যে অনুষ্ঠানই করব না। শেষ পর্যন্ত বেলাবৌদির কথায় নিমরাজি হলে

আসলে দু-দুটো রাত ট্রেনে কাটাতে হবে৷ কলকাতা- মালদহ-কলকাতা। হয়তো সেকারণেই আপত্তি করছিলেন। জানতে চাইলেন,
– আর কোন শিল্পীরা থাকবেন’?
বললাম, এখনও কাউকে ঠিক করা হয়নি। আপনি যেতে রাজি হলে অন্যদের যোগাযোগ করব।
– অন্যেরা বলতে কারা? আমি তাঁকে জানালাম, আরতি মুখোপাধ্যায়ের কথা ভেবেছি আমরা। তিনি হৈ হৈ করে উঠলেন, ‘আরতি এখন খুব বড় শিল্পী, তা জানো? কত টাকা চাইতে পারে ধারণা আছে?’
চুপ করে আছি দেখে তিনি হঠাৎ ফোনের ডায়াল ঘোরাতে লাগলেন। তারপর সেই দৈবকণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘আরতি। শোনো। আমি মালদহে একটা অনুষ্ঠানে যাব। তুমিও যাবে। ওরা এসেছে। পাঠাচ্ছি তোমার কাছে।’
বেলা বৌদি আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। এরপর আরতি মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি গেলাম। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, হেমন্তদা বলেছেন। আমাকে তো যেতেই হবে। তা ওনাকে কত সাম্মানিক দেবেন?’
বললাম, ১২ হাজার টাকা। আরতি’র উত্তর, ‘তাহলে আমাকে ৮ হাজার দেবেন তো?
আমরা তো শুনে অবাক৷ তখন ১৯৭৭ সাল। আরতি কলকাতাতেই ৮-১০ হাজার টাকা নিতেন। কারণ, সেইসময় তাঁর হংসরাজ, গীত গাতা চল, তপস্যা, আঁখিয়ো কি ঝরোকো সে ইত্যাদি ছায়াছবির গান সুপারহিট হয়েছে। আমরা যেন আকাশ ছুঁয়ে ফেললাম।

হেমন্ত-আরতির সঙ্গে যুক্ত হলেন শ্রাবন্তী মজুমদার, কৌতুকনক্সায় শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়-চিন্ময় রায়, আবৃত্তিতে বসন্ত চৌধুরি, নৃত্যে, রুমকি-ঝুমকি।
মনে পড়ে, হাওড়া-নিউ জলপাইগুড়ি প্যাসেঞ্জারের প্রথম শ্রেণির কামরায় হেমন্তদা, বেলা বৌদি, আমি আর আরতিদি। পাশের ক্যুপে রুমকি-ঝুমকি, দুই বোন, ওদের মা মিসেস রায় আর শ্রাবন্তী।

ট্রেন প্রত্যেক ষ্টেশনে দাঁড়াচ্ছে দেখে বিরক্ত হেমন্ত বলে উঠলেন, এ যে একেবারে গরুর গাড়ি। কখন পৌঁছবে কে জানে। ব্যান্ডেলে ট্রেন দাঁড়াল । দেখি, রেলের কোনও বড় অফিসার লোকলস্কর আর একগাদা খাবার নিয়ে হেমন্তদার কাছে হাজির। নমস্কার করে বললেন, স্যর, আপনারা কতজন আছেন? উনি আমার দিকে হাত তুলে ইশারা করলেন। আমি বললাম, এই কামরায় আমরা মোট ৮ জন। পাশের কামরায় মিউজিসিয়ান ৪ জন। চলুন আমার সাথে। হেমন্তদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, বসন্ত, শুভেন্দুরা কোথায়? জানালাম, ওরা মোটর গাড়িতে যাবেন। হেমন্তদা কপট রাগ দেখিয়ে বললেন, তা আমাদের জন্য গাড়ির ব্যবস্থা করনি কেন? আমার চটজলদি উত্তর, রাস্তার একেবারে বেহাল অবস্থা। অতদূর পথ বৌদি আর মেয়েদের নিয়ে যাই কী করে…।
ঠিক আছে, এসো, খেতে বসো। এরপর দুই ঘরে দুটো ফোল্ডিং টেবিলে প্রচুর খাবার রেখে রেলের লোকেরা পাশের কামরায় চলে গেলেন।
খুব ভোরবেলায় মালদহে পৌঁছে সেই সময়ের একমাত্র ভদ্রস্থ হোটেল, সরকারি ট্যুরিস্ট লজে উঠলাম। সারাদিন ওরা বিশ্রাম নিলেন। হেমন্ত-আরতি রেওয়াজ করলেন খানিকক্ষণ। ততক্ষণে ছোট্ট শহর ইংরেজবাজারে রটে গিয়েছে হেমন্ত-আরতি, সব শিল্পীরা কলকাতা থেকে এসে পৌঁছেছেন। মালদা স্পোর্টস্ ষ্টেডিয়ামের টিকিট কাউন্টারে মানুষের ঢল নামল।

অনুষ্ঠান শুরু হল সন্ধে ৬টায়। একের পর এক শিল্পীরা মঞ্চে আসছেন, লোকে হৈ হৈ করে উঠছে আনন্দে। আরতির গানের পরে সবশেষে উঠলেন হেমন্তদা। তাঁকে দেখামাত্র ষ্টেডিয়ামের ১৪/১৫ হাজার লোক উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিলেন। সেটিই ছিল মালদহে তাঁর প্রথম অনুষ্ঠান । গর্বে তখন আমার বুকের ছাতি ৪৮ থেকে হয়তো ৫৬-তে পৌঁছেছিল। শুরু করলেন ৬টি রবীন্দ্র সঙ্গীতে, তারপর ২০টি আধুনিক বাংলা-হিন্দি গান৷ তুমুল হর্ষধ্বনি, উচ্ছ্বাস, আবেগের ঢেউয়ে ভাসতে ভাসতে রাত সাড়ে ১০টা নাগাদ হোটেলের পথে রওনা হলাম। গাড়িতে হেমন্তদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি দু-দুবার আমাকে স্লিপ পাঠিয়ে অনুষ্ঠান শেষ করতে বলছিলে কেন? আমি বললাম, দার্জ্জিলিং মেলে আপনাদের ফেরার টিকিট। ষ্টেশনে ট্রেণ আসবে ১১টা ২০ মিনিটে, সাড়ে ১১টায় ছেড়ে যাবে। মিস হলে আবার পরের রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তার আগে কোনও ট্রেণ নেই।
” ও এই ব্যাপার! তা আমাকে আগে বলনি কেন?” লজে পৌঁছেই ম্যানেজার বিষ্ণুবাবুকে বললেন, একটু ষ্টেশন ম্যানেজারকে ফোনে ধরুন তো। তারপর লাইন পেতেই বললেন, আমি হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বলছি, আসলে আমার পৌঁছতে দেরি হবে। আপনি একটু দেখবেন।” এরপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “এদের বল মিনিট কুড়ি পরে খাবার সার্ভ করতে। আমি ততক্ষণে স্নানটা সেরে নিই।” বলেই ঘরে চলে গেলেন। আরতিদি কপালে হাত দিয়ে আমার দিকে হেসে বললেন, ‘জানিনা কপালে কী আছে!’

আমরা সবাই ডাইনিং হলে বসে আছি খাবার সাজিয়ে। উনি ধোপদুরস্ত ধুতি আর ফুলহাতা শার্ট পড়ে নিশ্চিন্তে খেতে বসলেন। এরপর পৌনে ১২টা নাগাদ ষ্টেশনে পৌঁছে দেখি, ষ্টেশন মাস্টার প্রবেশ পথে ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সঙ্গে জনা ৩০ রেলের কর্মচারী, বিশাল রেলরক্ষীবাহিনী, আর যাত্রীদের ভীড় । আমি হতবাক হয়ে তখন এদিক-ওদিক চাইছি। হেমন্তদা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে কামরায় নিয়ে গেলেন। বেলাবৌদি আর আরতিদির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই ছোকরাকে কী করে বোঝাই যে রেলের লোকজন আমাকে কত ভালবাসে। একসময় সারা ভারত ঘুরে ঘুরে ওদের শ্রমিক সংগঠণের ফাংশানে গান গেয়েছি। এমন ঘটনা আমার সঙ্গে আগেও ঘটেছে৷ আর ওরা সব বার আজকের মত আমাকে সাহায্য করেছে। তো এখন তুমি নিশ্চিন্ত নিশ্চয়?”
আমি ওদের কোনওমতে প্রণাম করেছিলাম। চোখভরা জল, বাকরুদ্ধ হয়ে নামতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই বেলাবৌদি হাত ধরে বললেন, “পাগল ছেলে। কলকাতায় আসলে দেখা করো কিন্তু”৷ আড়চোখে দেখলাম হেমন্তদা শূণ্যদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রয়েছেন। আর আরতিদি শাড়ির খুঁট দিয়ে চোখ মুছলেন।

ট্রেন ছেড়ে গেল। রাত তখন বারটা।

লেখক রাজ্যসভার সাংসদ

Previous articleক্ষুব্ধ পাইলট, পরিস্থিতি টালমাটাল বুঝে নিভৃতবাসে গেলেন গেহলট
Next articleরোনাল্ডোর জন‍্য বড় ক্ষতি ঠান্ডা পানীয় সংস্থার