Thursday, December 25, 2025

শ্রীরামকৃষ্ণ ভাবধারায় গঙ্গাপুজো, জয়ন্ত ঘোষের কলম

Date:

Share post:

[ আজ দশহরা৷ ইতিহাসবিদদের মতে আরও অনেক কিছুর মতো সেন-রাজাদের আমলেই দশহরা তিথিতে দেশের প্রধান জলবাণিজ্য পথ ‘গঙ্গা নদীর পুজো’ শুরু হয়েছিল। শঙ্করাচার্য গঙ্গাস্তোত্র রচনা করলেও গঙ্গাকে দেবী হিসেবে পুজো করার প্রথা শুরু হয়েছিল সেন রাজাদের আমলেই। তাই আজ গঙ্গাপুজোও৷
গঙ্গাপুজো উপলক্ষে বিশেষ নিবন্ধ৷ ]

শাশ্বত ভারতের মহান ধর্ম ও সংস্কৃতির দুটি স্তম্ভ হল নগরাজ হিমালয় ও পুণ্যসলিলা মা গঙ্গা। তাই বেদ, গীতা, উপনিষদ, ভাগবতের সাথে ভগবতী গঙ্গার নাম সমানভাবে উচ্চারিত হয়ে থাকে। কারণ শাস্ত্রমতে ভারতাত্মার মূর্তপ্রতীক হলেন গঙ্গা। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে বিশ্বের অগণিত মানুষ তাই আজও অন্তরে গভীর গঙ্গাভক্তির ভাব পোষণ করে থাকেন। এ কারণেই গঙ্গা সাধারণ কোনও নদী নয়, এক পবিত্রতম জীবনপ্রবাহ। এর প্রতিটি পবিত্র জলকণা মানুষের মনকে জৈবস্তর থেকে দৈবস্তরে উন্নীত করে।

রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরাও আচার্য শঙ্করের পরম্পরা মেনেই (রামকৃষ্ণ মিশনের সাধুরা হলেন শঙ্করাচার্যের দশনামী সম্প্রদায়ের অন্তর্ভূক্ত পুরী সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসী। কারণ শ্রীরামকৃষ্ণের গুরু ছিলেন ঈশ্বর তোতাপুরী।) সুরেশ্বরী মা গঙ্গাকেই দেবমাতা হিসাবে পুজো করে থাকেন। সুর মানে দেবতাগণ। এদের ঈশ্বরী অর্থাৎ পরমাজননী- মাতৃস্বরূপা মহাপ্রকৃতি। আবার ‘পতিতোদ্ধারিণী মা গঙ্গে’ হলেন অসংখ্য দেশভক্ত স্বতন্ত্রসেনানীর কাছে আরাধ্য দেশজননী। মিশরের নাইল, চিনের হোয়াংহো, রাশিয়ার ভলগা, জার্মানির রাইন ও বাংলাদেশের পদ্মার মতন ভারতের গঙ্গা হল জাতীয় জীবনের প্রাণপ্রবাহ। গঙ্গার গৌরব গাঁথা ছড়িয়ে আছে ভারতের নানা ভাষার সাহিত্য সম্ভারে। বিশেষতঃ পৌরাণিক কাহিনী গুলিতে।

ব্রহ্ম-পুরাণের মতে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লা দশমী তিথিতে অর্থাৎ দশহরায় মা গঙ্গা ভগবান শঙ্করের জটাজুটের মধ্য হতে উৎপন্ন হয়ে এই ধরাধামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তাই এদিনটিকে মা ভগবতী গঙ্গার ধরার লীলার জন্মদিনও মানা হয়। কলুষনাশিনী গঙ্গার উৎসকেন্দ্র গঙ্গোত্রী থেকে মোহনাস্থল গঙ্গাসাগর পর্যন্ত দুই পাশের অববাহিকার প্রতিটি স্থানই বারাণসীর সমতুল পবিত্র তীর্থভূমি। গঙ্গার পবিত্র প্রবাহের প্রভাবে মানুষের অন্তরে শুভ সংস্কারের চৈতন্য আনে। ঈশ্বরীয় ভাব জাগায়। গঙ্গাবারি সিঞ্চনে তাই মনের সকল পাপ ধুয়ে মুছে সাফ্ হয়ে যায়। মিশনের সাধুরা মূলতঃ জগতের হিতের জন্যই গঙ্গাপুজো করেন। মহামুনি বাল্মিকী তাঁর ‘গঙ্গাষ্টকম্’ স্ত্রোত্রে লিখছেন- “গাঙ্গ্যং বারি মনোহারি মুরারি চরণ চ্যুতম্। ত্রিপুরারি শিরঃচারি পাপহারি পুনাতু মাম্।।” অর্থাৎ, হে গঙ্গা, তুমি শ্রীবিষ্ণুর চরণারবিন্দ হতে নিঃসৃত মহাদেবের মস্তকে প্রবাহিত, তাই তুমি পাপহারিণী ও মনোহারিণী, তোমার স্বচ্ছসলিল আমাকে নিয়ত পবিত্র করুক। এই পবিত্রকারী শ্লোকটি শ্রদ্ধাভরে উচ্চারণ করে সকল জ্ঞানীগণ প্রত্যহ স্নান করে গঙ্গাজল পান করেন। কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের অনন্য সৃষ্টি শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় দশম অধ্যায়ের বিভূতিযোগে একত্রিশতম শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, পবনঃ পবতামস্মি রামঃ শস্ত্রভৃতামহম্। ঝষাণাং মকরশ্চাস্মি স্রোতসামস্মি জাহ্নবী।। অর্থাৎ, পবিত্রকারী বস্তুদের মধ্যে আমি বায়ু, শস্ত্রধারীদের মধ্যে আমি দাশরথি রাম, মৎসকুলের মধ্যে আমি মকর এবং নদীসমূহের মধ্যে আমি গঙ্গা। তাই শাস্ত্রানুযায়ী মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্র, পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণ ও পতিতপাবণী মা গঙ্গা অদ্বৈত স্বরূপ। তাই গঙ্গাজল বিনা কোন দেবদেবীর পুজো হয় না। কলি যুগে যিনি রাম, যিনি কৃষ্ণ সেই একাধারে শ্রীরামকৃষ্ণও তাই গঙ্গাজলকে ব্রহ্মবারি জ্ঞান করতেন। তিনি শুদ্ধতার প্রশ্নে গঙ্গাজলের প্রাধান্য বিশেষভাবে দিতেন। তিনি আজীবন শ্রদ্ধাভরে গঙ্গাজল পান করেছেন। কেউ বিশেষ অশুদ্ধাচারী এসে তাঁকে স্পর্শ করে প্রণাম করলে তিনি গঙ্গাজলে নিজেকে বিশুদ্ধ করে নিতেন। মদ্যপ গিরিশচন্দ্র তাঁর কাছে এলে তিনি তাঁকে গঙ্গায় স্নান করে আসতে বলতেন। শ্রীশ্রীমায়েরও ছিল বিশেষ গঙ্গাবাই। তিনিও নিত্য গঙ্গাস্নান করতেন। তাঁকেও কেউ অশুদ্ধাচারী স্পর্শ করলে তিনিও যন্ত্রণা পেতেন। গঙ্গাজলে নিজেকে শুদ্ধ করে নিতেন।

আরও পড়ুন-পরাজয় মানতে না পেরে ৩৫৬-র দাবি তুলছে বিজেপি: তীব্র কটাক্ষ কুণালের

শ্রীরামকৃষ্ণের দৃষ্টিতে পতিতপাবনী মা গঙ্গা ও শ্রীশ্রীমা সারদার মধ্যে কোন ফারাক ছিল না। শ্রীশ্রীমায়ের লীলাপার্ষদ যোগীন মা একবার মায়ের জাগতিক জীবন দেখে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন। তাই শুনে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁকে গঙ্গায় ভেসে যাওয়া গলিত পচা শব দেখিয়ে বলেছিলেন যে পুণ্যতোয়া গঙ্গা যেমন চিরপবিত্র ঠিক তেমনি শ্রীশ্রীমাকেও জানবে পবিত্রতমা দেবীস্বরূপা। তাইতো অভেদানন্দজী তাঁর মাতৃবন্দনায় লিখলেন, “পবিত্র চরিতং যস্যা পবিত্র জীবনম্ তথা। পবিত্রতা স্বরূপিন্যৈ তস্মৈ দেব্যৈ নমো নমঃ।।” এই কারণেই স্বামীজী যখন শ্রীশ্রীমায়ের কাছে যেতেন রাশি রাশি গঙ্গাজল শরীরে ছিটাতেন ও খেতেন। শ্রীশ্রীমাও শ্রীশ্রীঠাকুর যে এক এবং অভেদ তাই গঙ্গা ছিল শ্রীশ্রীমায়ের ধ্যানের  বস্তু। ঠাকুরের শরীর যাওয়ার পরেই শ্রীশ্রীমা একটি দিব্যদর্শন করেছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পায়ে পায়ে সিড়ি দিয়ে গঙ্গায় নামছেন আর তাঁর পূতঃ শরীর গঙ্গার জলে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ নরেন্দ্রনাথ এসে সেই জল জয় শ্রীরামকৃষ্ণ বলে চতুর্দিকে ছিটিয়ে দিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ তনু দ্রবীভূত গঙ্গাবারির এই কাহিনী বৈকুন্ঠলোকের ভগবান শ্রীবিষ্ণুরই কথা মনে করিয়ে দেয়।

রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা তাই পতিতপাবনী মা গঙ্গাকে শ্রীরামকৃষ্ণ জ্ঞানে জগতের হিতে লোককল্যাণের জন্য সারাবছরই পুজো করে থাকেন। দশহরায় সেই গঙ্গাপুজোই শ্রীরামকৃষ্ণ পুজোর নামন্তর হয়ে একটু অন্য মাত্রা পায়।

(লেখক – প্রবন্ধকার ও গ্রন্থকার)

spot_img

Related articles

১৭ বছর পর বাংলাদেশে ফিরলেন খালেদাপুত্র, তারেককে ঘিরে উচ্ছ্বাস-বিএনপি সমর্থকদের

বাংলাদেশের ফিরলেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান (Tarique Rahman returns in Bangladesh)। বৃহস্পতি সকালেই তিনি সিলেট...

এক দশক পর শীতলতম বড়দিন পেল বাংলা!

যিশু জন্মদিনের সকালে (Christmas morning) কলকাতার তাপমাত্রা (Kolkata temperature) নামলো ১৩.৭ ডিগ্রিতে। শীতের আমেজে জমজমাট বড়দিনের আবহাওয়া। দক্ষিণবঙ্গে...

মধ্যরাতে কর্নাটকের ট্রাক-বাসের ভয়াবহ সংঘর্ষে ঝলসে মৃত্যু অন্তত ১০ জনের

বড়দিনে ভয়াবহ দুর্ঘটনা কর্নাটকে। বেসরকারি একটি বাসের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষের (bus truck accident) ফলে বাসে আগুন ধরে যাওয়ায়...

ক্রিসমাসে রক্তাক্ত ঢাকা, চার্চ টার্গেট করে বিস্ফোরণে মৃত ১

বড়দিনের উৎসব শুরু হবার আগেই বুধবার সন্ধ্যায় ককটেল বিস্ফোরণে রক্তাক্ত বাংলাদেশের ঢাকা (Blast in Dhaka, Bangladesh)। মগবাজার ফ্লাইওভারে...