নন্দীগ্রাম থেকেই ত্রিপুরায় পরিবর্তনের সূচনার ডাক তৃণমূল নেতৃত্বের

সোমনাথ বিশ্বাস

“নন্দীগ্রাম” (Nandigram) একটি শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক রাজনৈতিক “রহস্য”! পূর্ব মেদিনীপুরের অচেনা-অজানা এক গ্রাম। যা আজ শুধু বাংলা, ভারত নয়, কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে বিশ্বের দরবারে রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ও চর্চিত একটি নাম। আজ থেকে হাজার বছর পরেও যখন এই দেশের বা এই রাজ্যের রাজনীতি নিয়ে চর্চা হবে, তখন নন্দীগ্রাম নামটা বারেবারে উঠে আসবে। কারণ, বাংলায় দীর্ঘ ৩৪ বছরের বাম জমানায় এই নন্দীগ্রাম আন্দোলন-ই পরিবর্তনের সূচনা ঘটিয়েছিল। তৃণমূল নেত্রী তথা রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এই নন্দীগ্রাম একটি নস্টালজিক অধ্যায়। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের দাবি করে থাকেন নন্দীগ্রাম আন্দোলন না হলে পশ্চিমবঙ্গের পরিবর্তনের পটভূমি হয়তো আজও রচনা হতো না।

এক অভূতপূর্ব রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আবাও আলোচনায় সেই নন্দীগ্রাম। তবে এই নন্দীগ্রাম আবার সেই নন্দীগ্রাম নয়। অর্থাৎ, পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব মেদিনীপুর নন্দীগ্রাম নয়, এই নন্দীগ্রাম দক্ষিণ ত্রিপুরার সুপরিচিত এক গ্রাম নন্দীগ্রাম! এখানেও আন্দোলনের ইতিহাস আছে, ইতিহাস ছিল, ইতিহাস থাকবে!

ত্রিপুরার নন্দীগ্রামের প্রেক্ষাপট:

বর্তমানে বাঙালি অধ্যুষিত উত্তর-পূর্বের ছোট রাজ্য ত্রিপুরা। পশ্চিমবঙ্গের পড়শি রাজ্য। ভৌগলিক অবস্থানের অনেক ফারাক। আয়তনে অনেক ছোট। তবে রাজনৈতিক সমীকরণ অনেকটাই একইরকম এই বাংলার মতই। এই মুহূর্তে ত্রিপুরা রাজ্যের শাসন ক্ষমতায় রয়েছে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি। দীর্ঘ বাম অবসান ঘটিয়ে ২০১৮ সালে বিজেপি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ত্রিপুরাতে। যেখানে তৃণমূল কংগ্রেসের একজনও সদস্য নেই কোনও পুরসভা বা পঞ্চায়েতেও! তাহলে বাংলার শাসক দলের ত্রিপুরা নিয়ে এত মাতামাতি কেন?

যা বলছেন ত্রিপুরা প্রদেশ তৃণমূলের সভাপতি:

ত্রিপুরা প্রদেশ তৃনমূলের সভাপতি সিং। তাঁর নেতৃত্বেই সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেসের এক প্রতিনিধি দল দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুম সফরে যান। সাব্রুমের হরিনা অঞ্চলের নন্দীগ্রাম এলাকার তৃণমূল কংগ্রেস পার্টি অফিসে যান এই প্রতিনিধি দল। দীর্ঘদিনের তৃণমূল কর্মী বেচারাম দাসের সঙ্গে তাঁরা দেখা করেন। তাঁর ও তাঁর পরিবারের খোঁজখবর নেন। আশিসলাল সিং জানান, সারা রাজ্যব্যাপী তৃণমূল কংগ্রেস আগামী বিধানসভা নির্বাচনকে পাখির চোখ করে ইতিমধ্যেই ঘুঁটি সাজাচ্ছে। সন্ত্রাস কায়েম করে লাভ হবে না। বিজেপির পায়ের তলা থেকে মাটি সরে গেছে। ২ মে বাংলায় তৃণমূলের ব্যাপক জয়ের পর আমাদের নন্দীগ্রামে সবচেয়ে বেশি উৎসব করেছে কর্মীরা। সেই আক্রোশে পার্টি অফিস ভাঙা হয়েছে। আক্রান্ত হয়েছে কর্মীরা। নন্দীগ্রামে পুলিশ লেলিয়ে দিয়েছে বিপ্লব দেব প্রশাসন। এখানকার মানুষ ফুঁসছে। জবাব দিতে তৈরি। এই নন্দীগ্রাম থেকেই মোথাবাড়িতে গিয়ে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে তৃণমূলে যোগ দেবেন শয়ে শয়ে মানুষ। আর পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রামের মতোই ত্রিপুরার নন্দীগ্রাম থেকেই পরিবর্তনের সূচনা হবে।

ত্রিপুরায় খেলা শুরু হয়ে গিয়েছে:

একুশে বাংলায় অভূতপূর্ব ফলাফলের পর এবার সর্বভারতীয়স্তরে মুখ্যমন্ত্রী তথা দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Mamata Banerjee) বিজেপি (BJP) তথা মোদি বিরোধী মুখ করে তুলতে বদ্ধপরিকর তৃণমূল কংগ্রেস (TMC)। তাই দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ((Abishek Banerjee) নেতৃত্বে চব্বিশের লোকসভা ভোটকে মাথায় রেখে ভিন রাজ্যে সংগঠন তৈরিতে মরিয়া ঘাসফুল শিবির।

সেইমতোই পড়শি রাজ্য বাঙালি অধ্যুষিত ত্রিপুরায় সংগঠন বাড়াতে উঠেপড়ে লেগেছে তৃণমূল। বিজেপি প্রশাসনের বাধার মুখে পড়লেও ত্রিপুরার পলিটিক্যাল গ্রাউন্ড রিয়েলিটি রিসার্চে সেখানে পাঠানো হয়েছিল ভোট কুশলী প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা IPAC-এর সদস্যদের। সম্প্রতি, আগরতলায় গিয়েছিলেন ব্রাত্য বসু, মলয় ঘটক, ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, ডেরেক ও’ব্রায়েন এবং কাকলি ঘোষ দস্তিদাদের মতো বাংলার হেভিওয়েট তৃণমূল নেতা-মন্ত্রী-সাংসদরা। তাঁরা ত্রিপুরার স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে সংগঠনের কাজ খতিয়ে দেখেছেন। সোমবার যাবেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

এদিকে আগরতলায় বাংলার নেতৃত্বের উপস্থিতিতেই ত্রিপুরায় খেলা শুরু করে দিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। তৃণমূলে যোগ দেন বিরোধী শিবিরের ৭ পরিচিত নেতা-‌নেত্রী। বিরোধী শিবির থেকে আগত ৭ নেতা-‌নেত্রীর হাতে তৃণমূলের পতাকা তুলে দেন ব্রাত্যু বসু, মলয় ঘটক, ডেরেক ও’ব্রায়েনরা। বিরোধী শিবির থেকে তৃণমূলে যোগ দিচ্ছেন নেতা-‌নেত্রীরা সেই ভিডিও টুইট করেছেন রাজ্যের মন্ত্রী মলয় ঘটক। বিরোধী শিবির থেকে সুবল ভৌমিক, প্রকাশ দাস, ইদ্রিস মিঞা, তপন দত্ত, পান্না দেব, প্রেমতোষ দেবনাথ ও বিকাশ দাস তৃণমূলে যোগ দেন । টুইটে মলয় ঘটক লেখেন, ‘‌’বিরোধী শিবির থেকে নেতা-‌নেত্রীরা তৃণমূলে যোগ দিলেন সচ্চে দিনের সন্ধানে। আর বিরোধী শিবির থেকে যাঁরা তৃণমূলে যোগ দিলেন তাঁদের সবাইকে স্বাগত জানাচ্ছি।’‌’

কেন তৃণমূলে যোগদান? এ প্রসঙ্গে বিরোধী দল থেকে আসা নেতারা জানান, গোটা দেশজুড়ে বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির স্বৈরাচারী শাসনে বিরক্ত মানুষ। দম বন্ধ হয়ে আসছে সাধারণ মানুষের। সেখান থেকে একমাত্র সকলকে মুক্তি দিতে পারেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই আগামী দিনে ত্রিপুরার রাজনীতিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বেই পথ চলতে চান তাঁরা। পশ্চিমবঙ্গের মতো ত্রিপুরাতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নে সামিল হওয়ার জন্যই তৃণমূলের হাত ধরা। আর তেইশের বিধানসভা ভোটে ত্রিপুরা থেকে বিপ্লব দেবের বিজেপি সরকারকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর।

আরও পড়ুন- অবৈধ সম্পর্কের সন্দেহে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুনের চেষ্টা, গুরুতর জখম যুবক

বাংলার মতোই ত্রিপুরাতেও বামেরা এবং কংগ্রেস নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে এখন অতীত। তাই একমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পারেন বিজেপিকে হারাতে। ঘাসফুল শিবিরে যোগ দিয়ে এমনটাই দাবি করেন সুবল ভৌমিক, প্রকাশ দাস-সহ বিরোধী শিবিরের নেতারা। তৃণমূল শীর্ষ নেতৃত্বের দাবি, এদিন বিরোধী শিবির থেকে ৪২ জন নেতা-‌নেত্রীর তৃণমূলে যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কোভিড পরিস্থিতির জেরে জেলাশাসক এতজনকে এক জায়গায় রেখে অনুষ্ঠানের অনুমতি দেয়নি। তাই সেই সময় ৭ জনকে তৃণমূলে যোগ দেওয়ানো হয়।

এখানেই শেষ নয়। আরও আশ্চর্য আছে। তৃণমূলের নির্বাচনী উপদেষ্টা প্রশান্ত কিশোরের (Prashant Kishor) সংস্থা আইপ্যাক-এর ২৩ জন আধিকারিক(Team IPAC In Tripura)কে হাউজ অ্যারেস্ট করে রাখার পর তাঁদের ছাড়াতে আদালতে সওয়াল করেন ত্রিপুরা প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি পীযূষ বিশ্বাস। মামলায় মহামারী আইন ভাঙতে পারেন এই যুক্তিতে জামিন দেওয়ার বিরোধিতা করেন সরকারি পক্ষের উকিল। যদিও সেই যুক্তি ধোপে টেকেনি। আইনজীবীর দায়িত্ব নেওয়া ত্রিপুরা প্রদেশ কংগ্রেস নেতা পীযূষ বিশ্বাস স্পষ্টই জানান, “গৃহবন্দী করে অনর্থক হয়রানি করা হচ্ছিল এই প্রতিনিধি দলটিকে।” এরপরই আই প্যাকের কর্মীদের জামিন মেলে।

কিন্তু তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত সংগঠনের জন্য সওয়াল করছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, এই ঘটনাতেই শোরগোল পড়ে গিয়েছে ত্রিপুরায়। তবে, কি কংগ্রেস নেতাদের সঙ্গে তৃণমূলের ‘হিসেবনিকেশ’ হয়ে যাচ্ছে তলেতলে? বেনুগোপালের জিজ্ঞাসায় অবশ্য পীযূষ বিশ্বাস কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের দিকেই আঙুল তুলেছেন বলে খবর। কেন ত্রিপুরায় এখন তৃণমূলকে নিয়ে আলোড়ন চলছে, তার জবাবে পীযূষ জানিয়েছেন, যে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে তৃণমূল ত্রিপুরায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তার সিকিভাগ চেষ্টাও কংগ্রেস করছে না।

সবমিলিয়ে অভিষেকের পদধ্বনির আগেই ত্রিপুরায় এককাট্টা তৃণমূল। সঙ্গে সেই নস্টালজিক নন্দীগ্রাম…!

আরও পড়ুন- মুখ্যমন্ত্রীর সূচনার আগে “খেলা হবে” দিবসের প্রস্তুতি নেতাজি ইন্ডোর-এ

 

Previous articleটোকিও অলিম্পিক্সে সেমিফাইনালে ভারত
Next articleঅবিরাম বৃষ্টিতে জলমগ্ন বার্ণপুর, ত্রাতার ভূমিকায় সায়নী