বাংলায় দশভূজা হলেও ত্রিপুরার রাজবাড়ির দেবী দুর্গা দ্বিভুজা

বাংলায় তিনি দশভুজা কিন্তু ত্রিপুরায় দেবী লুকিয়ে রাখেন তাঁর বাকি আট হাত। তাই   ত্রিপুরার রাজবাড়ির দুর্গামন্দিরের দেবী দুর্গা সেখানে দ্বিভূজা। এই রূপেই গত ৫১৭ বছর ধরে দেবীর পুজো হয়ে আসছে। ত্রিপুরার রাজবাড়ির দুর্গামন্দির লোকমুখে ‘দুর্গাবাড়ি’ নামেই পরিচিত। এখানকার দেবীর রূপের বিশেষত্বই হল তাঁর দ্বিভুজা রূপ।   বাকি আটটি ছোট হাত থাকে শাড়ির আঁচলে ঢাকা। কিন্তু এর কারণ কী?

আরও পড়ুন:ছোটদের তৈরি পটচিত্র মণ্ডপ : মুখ্যমন্ত্রীর হাতে উদ্বোধন হওয়া এই পুজো নজর কাড়ছে সবার

তাহলে আসুন লোককাহিনীতে আসা যাক। কথিত আছে, একবার শারদীয়া দুর্গাপুজোর সময় ত্রিপুরার মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মানিক্যর ( রাজত্বকাল ১৭৬০ – ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দ) স্ত্রী তথা ত্রিপুরার মহারানি রাজপুরোহিতের পরামর্শ ছাড়াই দ্বিপ্রহরে যখন মা দুর্গার অন্নভোগ অর্পণ করার পর দেবীর ভোগ দর্শনের জন্য দরজা খুলেছিলেন, তখনই তিনি দেখতে পান যে মা দুর্গা দশ হাতে অন্ন গ্রহণ করছেন। এটা দেখে তিনি প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যান। ওই রাতেই মহারাজা কৃষ্ণকিশোর মানিক্যকে মা দুর্গা স্বপ্ন দেন যে আগামী বছর থেকে যেন দুই হাতেই দুর্গামূর্তি পুজো করা হয়। সেই থেকে তিনি দ্বিভুজা।

ত্রিপুরার মহারাজাদের দেবী দুর্গার আরাধনার প্রথম প্রামাণ্য নিদর্শন পাওয়া যায় মহারাজা রত্ন মানিক্য (রাজত্বকাল ১৪৬৪-৬৭ খ্রিস্টাব্দ)-র মুদ্রায়। ওই মুদ্রাগুলিতে ‘শ্রী দুর্গাপদ’, ‘শ্রীদুর্গারাধনাপ্রাপ্ত’ ইত্যাদির উল্লেখ রয়েছে। সেই পুজো হত বসন্তকালে। আবার ত্রিপুরা রাজবংশের বর্তমান রাজপুরুষ প্রমথেশ দেববর্মনের মতে, মহারাজা রত্নমানিক্যের আগের থেকেই ত্রিপুরা রাজপরিবারে দুর্গাপুজোর প্রচলন ছিল।

মহানবমীতে ত্রিপুরার প্রাচীন রাজধানী উদয়পুরে অবস্থিত দেবী ত্রিপুরেশ্বরীর মন্দিরে ত্রিপুরা রাজপরিবারের পক্ষ থেকে বিশেষ পুজো দেওয়া হত। মহারাজ বীরচন্দ্র স্বয়ং উপস্থিত থাকতেন, কখনও কখনও নিজেই ঘোড়া চালিয়ে চলে যেতেন উদয়পুর। মহারাজা বীরচন্দ্র মানিক্য (রাজত্বকাল ১৮৬২ – ১৮৯২ খ্রিস্টাব্দ)  বিজয়া দশমীতে অসমে ভোজনের আয়োজন করতেন। অসম ভোজন অনুষ্ঠানে মহারাজা বীরচন্দ্র সবার সঙ্গে মেঝেতে আসন করে খেতেও বসতেন।    ভোর না হওয়া পর্যন্ত চলত খাওয়াদাওয়া। দেবী দুর্গার বিসর্জনের জন্য ত্রিপুরার যুবরাজ রাধাকিশোর দায়িত্ব নিতেন।

সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মানুষ এখানে আসতেন। চাকলারোশনাবাদ-সহ কৈলাসহর, অমরপুর, বিলোনিয়া, তেলিয়ামুড়া, চট্টগ্রাম, গণ্ডাছড়া, ধর্মনগর-সহ অনেক অঞ্চল থেকেই রাজভক্ত প্রজারা আসতেন।

বিজয়াদশমীর দিন উজ্জ্বয়ন্ত রাজপ্রাসাদের পাশে এখন যেখানে টাউন হল, সেখানে তৎকালীন উজির বাড়ির সামনের ফাঁকা জায়গায় রাজ্যের সমস্ত বাড়ির দুর্গা প্রতিমা এক জায়গায় জড়ো হত। সমবেত ঢাক ও কাঁসরবাদন এবং ধূপতি নৃত্য হত। প্রথমে মহারাজা বাহাদুর, তারপর মহারানি সমস্ত দুর্গা প্রতিমা দেখে প্রণাম জানাতেন। তারপর দু-তিনটে সুসজ্জিত হাতি, ২০-২৫ জন ঘোড়সওয়ার, পদাতিক সৈন্য ও সেনাবাহিনীর ব্যান্ডপার্টিকে সামনে রেখে শোভাযাত্রা শুরু হত। সবার আগে থাকত প্রভুবাড়ি বা গোঁসাইবাড়ির প্রতিমা, তার পিছনে রাজবাড়ির প্রতিমা, উজিরবাড়ির প্রতিমা, অন্য সভাসদদের প্রতিমা এবং রাজবংশের বিভিন্ন সদস্যদের বাড়ির প্রতিমাগুলি সারিবদ্ধ ভাবে বাঁশের মাচায় চাপিয়ে কাঁধে নিয়ে দশমীঘাটের দিকে শোভাযাত্রা এগিয়ে যেত। তৎকালীন দক্ষিণ ভারতের দেশীয় রাজ্য মহীশূরের দশেরা ও কোচবিহার রাজ্যের বিজয়াদশমী ছাড়া আর কোথাও এমন শোভাযাত্রা দেখা যায় না।

advt 19

Previous articleনারকেলডাঙায় পুরনো বাড়ি ভেঙে মৃত ১ শ্রমিক, আহত ৩
Next articleএবার বিয়ের মতো ব্যক্তিগত বিষয়েও নাক গলাতে চাইছে RSS! কী বলছেন ভাগবত?