পাঁচ দশক আগের রবীন্দ্রসদনকে ফিরিয়ে আনল আকাদেমির মঞ্চ

পঞ্চাশ বছরেরও পর সোমবার সন্ধেয় আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস মঞ্চে অভিনীত এই 'টিনের তলোয়ার', অনুভূতি বলল, হয়ত প্রেক্ষিত বদলেছে, কিন্তু উৎপল দত্ত যে চোখ দিয়ে তৎকালীন সমাজকে বিঁধেছিলেন, তার দৃষ্টি ছিল নির্ভুল ও সুদূর নিক্ষেপিত। মূল সমস্যাগুলো আজও যেন খুব চেনা, বড়ই মন খারাপ করা।

কুণাল ঘোষ

‘টিনের তলোয়ার’ আবার মঞ্চে। উৎপল দত্তের (Utpal Dutta) বৈপ্লবিক নাটককে সফলভাবে ফিরিয়ে আনলেন আজকের বঙ্গরঙ্গমঞ্চে তাঁর উত্তরসূরিরা। রবীন্দ্রসদন(Rabindra sadan) মঞ্চে পাঁচ দশক আগে যে গগনবিহারী বার্তা, তারই সার্থক প্রতিফলন দেখলাম আকাদেমি (Academy of fine arts) মঞ্চে।


সেই ১৯৭১-এর ১২ অগাস্ট রবীন্দ্রসদনে প্রথম প্রদর্শন। তার পঞ্চাশ বছরেরও পর সোমবার সন্ধেয় আকাদেমি অফ ফাইন আর্টস মঞ্চে অভিনীত এই ‘টিনের তলোয়ার’, অনুভূতি বলল, হয়ত প্রেক্ষিত বদলেছে, কিন্তু উৎপল দত্ত যে চোখ দিয়ে তৎকালীন সমাজকে বিঁধেছিলেন, তার দৃষ্টি ছিল নির্ভুল ও সুদূর নিক্ষেপিত। মূল সমস্যাগুলো আজও যেন খুব চেনা, বড়ই মন খারাপ করা।

উৎপল দত্তর নাটককে আবার ফিরিয়ে আনলেন নৈহাটি নাট্যসমন্বয়ের কলাকুশলীরা, পার্থ ভৌমিকের নেতৃত্বে, যিনি অন্য পরিচয়ে তৃণমূল বিধায়কও বটে। রাজনৈতিক কর্মসূচির ব্যস্ততার ফাঁকে রাতভর মহড়া, তিনি যে তীক্ষ্ণ এক নাট্যচরিত্র, আগেও প্রমাণ হয়েছে, আবারও হল।উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’ ছিল এক বিপ্লব। কন্টেন্ট এবং মেকিং- দুদিক থেকেই।

সেই ১৮৭৬ সালের চালচিত্র। বঙ্গের রঙ্গমঞ্চে একদিকে বৃটিশের দমনপীড়ন, সরকারবিরোধী প্রচার থামাতে নানা অপবাদ দিয়ে পুলিশি তান্ডব। অন্যদিকে, কিছু পয়সাওয়ালা বাবু, যাঁরা বৃটিশের তল্পিবাহক, আবার নাটকের গোষ্ঠীগুলির আর্থিক নিয়ন্ত্রণের সুবাদে একাধিক অভিনেত্রীর দখলদার। এই কঠিন সময়ের মধ্যেই গিরিশ ঘোষরা(Girish Ghosh) কাজ করেছেন। উৎপলবাবুর বেণীমাধব যেন গিরীশের ধাঁচে গড়া। ময়না যেন বিনোদিনী। বসুন্ধরা যেন স্বপ্নভাঙা একাধিক পতিতাপল্লীর সদস্যার প্রতিনিধি, যাঁরা নাটককে ঘিরে নতুন জীবনের গান গাইতে চেয়েছিলেন। আর প্রিয়নাথ চরিত্রটি বেড়া ভাঙার হুঙ্কার দেওয়া নতুন প্রজন্মের কন্ঠ। নাটকে তৎকালীন সমস্যার সবকিছুরই উল্লেখ।
আর মেকিং-এও অভিনবত্ব এনেছিলেন উৎপল। যাত্রার উপস্থাপনার কায়দাকে তথাকথিত নাক উঁচু মঞ্চের সংস্করণে রূপান্তরিত করেছিলেন তিনি। আলো, মিউজিক, গানের প্রয়োগও ছিল তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে।
পার্থ ভৌমিকদের নাটক এই মূল ভাব ধরে রাখতে পুরোপুরি সফল। মুরারি মুখোপাধ্যায়ের নির্দেশনা, অরিত্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রযোজনা নিয়ন্ত্রণ দারুণ। দুতিন জন অভিনেতা, অভিনেত্রীর অভিনয় দেখার জন্য একাধিকবার নাটকটি দেখা যায়। নাটকের ফিনান্সার নারীলোভী ‘বাবু’ বীরকৃষ্ণ দাঁর চরিত্রে পার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় একশোয় দুশো। চরিত্রটিকে অসাধারণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পার্থ। বসুন্ধরার চরিত্রে দেবযানী সিংহ দক্ষতার ছাপ রেখেছেন। রাস্তার সব্জিওয়ালী থেকে নাটকে রাজকুমারীর ভূমিকায় পৌঁছে, তারপর ‘বাবু’র হাতছানিতে সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো ময়নার ভূমিকায় রায়তি ভট্টাচার্য মানানসই। প্রিয়নাথের ভূমিকায় নভোজিত দেব যথাযথ। বারবার নজর কেড়েছেন হরবল্লভের ভূমিকায় সুনীত ভট্টাচার্য। সুনীত দক্ষ ভিডিও এডিটর জানতাম, তবে মঞ্চের চরিত্রে এরকম নজরকাড়া চুম্বক হয়ে উঠতে পারে, সেটা এতটা ভাবতে পারিনি।
এবং পার্থ ভৌমিক(Partha Bhowmik)। বেণীমাধবের চরিত্রে অনবদ্য। তিনিই যেন গিরীশ ঘোষ, কখনও নিজস্ব নাট্যশালা গড়ার তাগিদে নিজের হাতে তৈরি ময়নাকে তুলে দিচ্ছেন বীরকৃষ্ণর হাতে। কখনও নাটক বাঁচাতে তিনি আপোসের পথে। কখনও তাঁর বিশ্বাস, নাটকে বৃটিশের বিরুদ্ধে বললেই কি বৃটিশ চলে যাবে? উল্টে এতগুলো ছেলেমেয়ে পথে বসবে। কখনও তিনি এক টিমলিডার। কখনও তাঁর মুখে নিঃসঙ্গতার হাহাকার। আবার ক্লাইম্যাক্সে এই বেণীমাধব যখন ‘সধবার একাদশী’ নাটক করতে করতে অত্যাচারী ল্যামবার্ড সাহেবকে দেখে মানসিক অগ্ন্যুৎপাতে ‘তিতুমীর’-এর সংলাপ বলতে থাকেন, সহঅভিনেতারাও বদলে যান দেশপ্রেমের সজ্জায়। শিল্পীর মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসে বিপ্লবী চেতনার আগুন। অনেক গোষ্ঠীই নিশ্চয়ই এর মধ্যে নাটকটি করেছেন। কিন্তু বড়বড় ছাপ রাখল নৈহাটি নাট্য সমন্বয়।

টিনের তলোয়ারের প্লট ১৮৭৬-এর। মঞ্চে এলো ১৯৭১-এ, আরেক ইতিহাসের বাঁকে। এবং এখন ২০২২-এ দেখার সময়ও মনে হচ্ছে, সমাজটা তো রোগমুক্ত হল না। শোষকের চেহারা বদলেছে, শোষণের পদ্ধতি বদলেছে, শোষণ বন্ধ হল কই? শিল্পী তাঁর দল রাখতে, পেট চালাতে আপোস করবেন নাকি ঝুঁকি নিয়ে বিপ্লব করবেন? ময়নারা অনেক কষ্টে তিল তিল করে নিজেদের তৈরি করার পর স্বাধীন জীবন বাছবে নাকি বীরকৃষ্ণদের কাছে আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে? শিল্পের টিম লিডার মানুষের কথা ভাববেন নাকি ফিনান্সারের স্বার্থসিদ্ধিতে বাধ্য হবেন? প্রশ্নগুলো থেকেই যাচ্ছে, সম্ভবত থেকেও যাবে। আর তাই যুগে যুগে পার্থ ভৌমিকদেরও দরকার, যাঁরা বাংলা নাটকের মঞ্চে উৎপল দত্তের ‘টিনের তলোয়ার’-এর চরিত্রগুলিকে হাজির করে দেখাবেন- অ্যাকশন রিপ্লে।


Previous articleক্ষমতার অপব্যবহার করে ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে নাড্ডার দলীয় কর্মসূচি অনৈতিক, দাবি তৃণমূল নেতার
Next articleকলকাতায় আনা হচ্ছে ইউটিউবার রোদ্দুর রায়, আজই তোলা হতে পারে আদালতে