বেঁচে নাও এই মুহূর্তে, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

‘ আর কি কখনো কবে

এমন সন্ধ্যা হবে — ‘

আসলে এই জিজ্ঞাসার মধ‍্যেই প্রশ্নের উত্তর নিহিত রয়েছে। আর তা হলো, হবে না। আর কখনোই আজকের উল্লিখিত সন্ধ্যাটির মতো সন্ধ্যা ফিরবে না।
তাই, যা দেখার দেখে নিতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। যা বোঝার বুঝে নিতে হবে। প্রতিটি মুহূর্তই বিরল এবং অতুল ঐশ্বর্যময়। কোনো মুহূর্তই কোনোভাবে নষ্ট করা যাবে না। কারণ, জীবনানন্দ কবির ভাষায় : এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায় নাকো আর। যে মুহূর্তটি চলে গেল তা চিরতরে হারিয়ে গেলো।
‘ আপনারে দেয় দেয় গো ঝর্ণা
আপন ত‍্যাগরসে উচ্ছলি
লহরে লহরে নূতন নূতন
অর্ঘ্যের অঞ্জলি… ‘
মুহূর্তগুলিও ঝর্ণানির্গত জলধারার মতো ক্ষণেক্ষণে নতুন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তাঁর প্রিয় মানিক দা (সত‍্যজিৎ রায়) সম্পর্কে লিখেছেন : উনি প্রতিটি মুহূর্তকে ফলবান করার প্রয়াস ক’রে গেছেন সারাজীবন। কোনো সময়কেই তিনি নষ্ট করতেন না।
রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যে যাঁরা এসেছেন তাঁরাও কবি সম্পর্কে একই কথা লিখে গেছেন।
অনিত‍্য তথা অনিশ্চিত জীবনের বিভিন্ন ভাষার গানে ও কবিতায় :
‘ হরপল ইয়াহাঁ জি ভর জিও… ‘

‘ আগে ভি জানে না তু
পিছে ভি জানে না তু
যো ভি হ‍্যায়
বস্ ইয়েহি এক পল হ‍্যায় ‘

‘কল ক‍্যা হোগা কিস্ কো পতা ‘
‘ কে জানে ক’ ঘন্টা
পাবে রে জীবনটা ‘

‘ রহে না রহে হম.. ‘

‘ কাল রহে না রহে হম…’

অ‍্যাডভেঞ্চারপ্রিয় মানুষেরা বলেন কালকের জন‍্য কিছু ফেলে রাখতে নেই। জীবন চরম অনিশ্চিত। কিন্তু সংসারী গৃহস্থেরা নিজেদের নিঃশেষ ক’রে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে ক্রমাগত সঞ্চয় করতে থাকেন। তাঁদের একমাত্র চিন্তা , কাল কী হবে? তাঁরা অনাগত আগামীর কথা ভেবে বর্তমানের আনন্দকে মাটি করেন হাসিমুখে।

পাশ্চাত্যে এই ‘ মুহূর্ত ‘ বা ‘ মোমেন্ট ‘ নিয়ে খুব চর্চা হয়। এ নিয়ে অনেক কবিতা ও গান রয়েছে সেখানে। ‘ লিভ ইন দ‍্য মোমেন্ট ‘, ‘ লিভ ফর দা মোমেন্টস্ ‘ ইত্যাদি নিয়ে তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন ভাবনা, ধারণা, মতামত ও ব‍্যাখ‍্যাও আছে তাঁদের।
মুহূর্তের জন‍্য বাঁচো? না।
মুহূর্তের মধ‍্যে বাঁচো? না।
মুহূর্তকে নিয়ে বাঁচো? না।
মুহূর্তে বাঁচো। মুহূর্তকে সঙ্গে নিয়ে বাঁচো। মুহূর্তের পরাগরেণু মেখে বাঁচো।
মুহূর্তে নিহিত থাকে হিরন্ময় আনন্দলোক। মুহূর্তে লুকানো থাকে কাঙ্খিত অমরাবতী। মুহূর্তে লগ্ন হ’য়ে থাকে
অনন্ত-অসীম।
সাহিত্যিক শৈবাল মিত্র লিখে গেছেন : আজ আছি।
সত‍্যিই তো। আগামীকাল কে থাকবে আর কে থাকবে না কে বলতে পারে? তাই সাতপাঁচ না ভেবে আজকের উত্তাল জীবনতরঙ্গে জয় মা ব’লে তরী ভাসাতেই হবে। দুরন্ত ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এগোতে হবে। দেখে নিতে হবে, শুনে নিতে হবে যতটুকু দেখা ও শোনা যায়। বুঝে নিতে হবে যতটুকু বোঝা সম্ভব। প্রতিক্ষণের অনিত‍্যতার আলোয় নিত‍্যতাকে অনুভব ক’রে নিতে হবে। জানার মাঝে অজানাকে ও সীমার মাঝে অসীমকে স্পর্শ করার অন্তিম সুযোগ হয়তো আজকের এই পরম মুহূর্তটিই।

‘ সময় গেলে সাধন হবে না ‘
যিনি লিখেছেন তিনিই তো লিখে গেছেন :
এমন মানব জনম আর
কি হবে
মন যা করো ত্বরায় করো
এই ভবে।
আর ভাস্কর চক্রবর্তী?
তিনি কী লিখে গেছেন?

‘ দুই দীর্ঘশ্বাসের মধ‍্যিখানে মৃত্যু, আমি তোমাকে জন্মাতে দেখেছি ‘ ( এপিটাফ )

‘ মৃত্যুর কোনো সময়জ্ঞান নেই । এলেই হলো!

‘ আমি তো আর দু’দিন কি চারদিন
কে আগামীকাল মারা যাবে,
আমি জানি না ‘

শুধু কবিরা নন, কে আগামীকাল মারা যাবে কেউ জানেন না। তাই, সঞ্চয়ী সঞ্চয় করুন যত খুশি, বিষয়ী ভবিষ্যতের ভাবনায় রাত জাগুন, সংশয়ী ত্রিশঙ্কু হ’য়ে ঝুলে থাকুন কিংকর্তব‍্যবিমূঢ় হ’য়ে, কিন্তু তুমি, হে জীবনরসিক অভিযাত্রী, তোমার দোলাচলে থাকা শোভা পায় না কখনও। কাল নয়, এমনকি আজ বিকেলে কিংবা দুপুরেও নয়, এখনই, এই মুহূর্তেই তোমাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে উত্তাল জীবনসমুদ্রে, কারণ, যে
পরমাকাঙ্খিত পরের মুহূর্তটির জন‍্য তুমি অপেক্ষা করছো সেটি তোমার জীবনে আর না-ও আসতে পারে। তাই, যা বলার বলে নাও। যা করার করে নাও। গেয়ে নাও প্রাণভরে গান।

এ লেখার শুরু হয়েছিল রবি ঠাকুরের গানে। শেষেও থাক তাঁরই অনুপম উপলব্ধি :

‘ কবে তুমি আসবে বলে
রইবো না বসে
আমি চলবো বাহিরে
শুকনো ফুলের পাতাগুলো
পড়তেছে খসে
আর সময় নাহি রে। ‘

আরও পড়ুন- রাজ্যের সরকারি কর্মী এবং পেনশনভোগীদের স্বাস্থ্য বীমা প্রকল্পে আয়ের ঊর্ধ্বসীমা বাড়লো

 

 

Previous articleফের ভেন্টিলেশনে তরুণ মজুমদার
Next articleBJP মহিলা মোর্চায় কোন্দল: রাজ্য সভানেত্রীর বিরুদ্ধে প্রতারণা ও হেনস্থার অভিযোগ সাধারণ সম্পাদিকার