অসামান্য তারক সেন, উৎপল সিনহার কলম

‘… মানুষ তো গাছ নয়। তবু গাছের মতো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রক্তপাত দেখে কেন নিজের গভীরে? নিহত পল্লীতে কবিতার শব্দ নয়, শঙ্খ নয়, বেঁচে থাকে প্রতারক দেওয়াল লিখন। এ এক মায়াবী ঘটনা।

সারি সারি মানুষের বুকে হাত দিয়ে দেখ
আতাফলের মতো হৃদপিণ্ড ঝুলে আছে।
হৃদয় পাবে না।
( কবিতা : সামান্য ঘটনা )

কবি তারক সেন লিখেছেন যে খুব বেশি তা কিন্তু নয়, এখনো পর্যন্ত প্রকাশিত সংগ্রহে তাঁর কবিতার সংখ্যা একশো পঁচিশ অতিক্রম করে নি সম্ভবত, কিন্তু তাঁর একটি কবিতাকেও অসাবধানে এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব।
যেমন,
‘ অলকা দি
একদিন প্রথম কদমফুল
ফোটানো বর্ষায়
তুমি হ’তে চেয়েছিলে
নদী অলকানন্দা
আমি তখন ভাসিয়েছিলাম
নীল কাগজের নৌকা ‘
( কবিতা : অলকাদিকে আমার জলের স্বাক্ষর )

এই যে নির্ভার সারল‍্যে মৃদুস্ফুট যৌনতার সঙ্কেত,
এ হলো বড়ো মাপের কবির অন‍্যতম বৈশিষ্ট্য।
তারক সেনের জন্ম ১৫ মার্চ,
১৯২৮ সালে বাঁকুড়ার সোনামুখীতে। কর্মজীবন ও সাহিত্যচর্চার পরিমণ্ডল ছিল
বার্ণপুরের ইস্কো ইস্পাত কারখানার মফস্বল। কিন্তু স্থানীয় পরিপার্শ্ব ছুঁয়ে তাঁর কবিতা আমাদের পৌঁছে দেয় আবহমান সময় ও পরিসরের দ্বান্দ্বিক প্রবাহে। একইসঙ্গে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে দেয় এক রহস‍্যাচ্ছাদিত গুপ্তবিশ্বের দরজা।

‘ ভিজে চোখ। শুকনো আকাশ। মেয়েরা বলাবলি করছিলো ; জলের নাম বালি।
একবুক বালি ঠেলতে ঠেলতেই চলে গেলো বুকের বয়েস।
আমাদের গাঁয়ের পথটা
কেউ কি দেখাতে পারছো না
বুড়ি গঙ্গাকে?
সাগরে কে গেছে যে ফিরবে
শঙ্খ নিয়ে? ‘

অবিস্মরণীয় এই কবিতায় কবি তাদের কথা উল্লেখ করেছেন যারা ‘ জলকে বাঁকাতে জানে, ফলকে পাকাতে জানে ‘ এবং এই কবিতার উপসংহারে রেখেছেন একসময় শিল্পাঞ্চলের কবিতাপাঠক ও আবৃত্তিকারদের মুখে মুখে ফেরা এক অমোঘ আহ্বান ও পরম সংকল্প :
‘ তোমরা নতুন মেঘের মতো সংঘবদ্ধ হও চারিদিকে
ছাঁচার জলে বান ডেকে যাক বাঁচার।
আমরা মেয়ে বেচতে যাব না কোলকাতায়
কোলকাতা কিনে আনবো
মেয়ের বিয়েতে। ‘
( কবিতা : ময়ূর পাখায় চাঁদ )

এমন সহজ অথচ শিল্পময় উচ্চারণ করতে পারা বড়ো সহজ কাজ নয়। শব্দই কবির প্রধান শক্তি। কত সুক্ষ্ম তাঁর অবলোকন। তিনি একই সঙ্গে সমাজ ও সভ‍্যতাপ্রেমিক, আবার শ্রমজীবী প্রান্তিক ও নিম্নবিত্ত মানুষের প্রতিবাদী প্রতিনিধি।

‘ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জের কার্ড তুই ছিঁড়ে ফেলেছিস অনিমেষ।
নষ্ট দলিল সব ছিঁড়ে ফেলা
ভালো।
জানালার ডাকবাক্সে
তোর নামে মাধবীর কোনো
চিঠি নেই। ‘
এই কবিতার শেষে রয়েছে :
‘ বাইরে যে যাই হই —
সুশীল বা সমরেশ
অরূপ বিকাশ
ভিতরে সবাই অনিমেষ।
দুঃখের শিকড়ে সমগোত্র
ধরে আছি।
ভালোবাসাকে ফের ভালোবেসে
দুঃখকেই দুঃখ দিতে চাই। ‘

রাজধানীর সুখ-সুবিধা ও বিশাল সাহিত্য-পরিসর থেকে অনেক দূরে মফস্বলের এক রুক্ষ আধা-শহরে বসে গুটিকয়েক সাহিত্যপ্রেমীর সান্নিধ্যলালিত এই কবি কী ক’রে সমকালকে চিরকালের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার ক’রে দেওয়ার কাব‍্যভাষা নির্মাণের কৌশল আয়ত্ব করেছিলেন তা ভাবলে আশ্চর্য হ’তে হয়।

আরও পড়ুন- কবিতার বোধিবৃক্ষ, উৎপল সিনহার কলম

‘ কোথায় যাব এ ঘর- ছেড়ে
মরতে মিছিমিছি
জন্মদিনের ঘর তুলেছি
মৃত্যুদিনের ভীষণ কাছাকাছি। ‘
( কবিতা : ঘর )

‘ মুখোমুখি দেখছে মুখ
মানুষ এবং মানুষ
মুখোমুখি দেখছে মুখ
সময় এবং আয়না

এখন কে কার ভীড়ে
হারিয়ে যাবে
কিছুই বলা যায় না। ‘
( কবিতা : ভীড় )

‘ খাদের অনেক নীচে
নেমে গেছে ডুলি।

নেমে যাচ্ছে মানুষ
উঠে আসছে কয়লা। ‘
( কবিতা : কয়লাপ্রবণ দেশ )

তারক সেন ‘ কলে জল পড়া দেখে ‘ বুঝে নিতে পারতেন
‘ নদীর বয়েস ‘। তিনি কয়লা-শহরের রুক্ষ হৃদয় ভালোবাসায় ভিজিয়ে দেওয়ার গান গেয়ে গেছেন সারাজীবন। প্রবল অন্তর্দাহ ও গোপন রক্তপাত বুকে নিয়ে তিনি দীর্ঘপথ অতিক্রম করেছেন একা ক্লান্তিহীন যোদ্ধার মতো। ঝড়- বাদলে
আঁধার রাতে বুক চিতিয়ে একলা চলার দুঃসাহস কবি
তারক সেনকে বাংলা কবিতার ইতিহাসে স্থায়ী আসন দিয়েছে। পঞ্চাশ-ষাট দশকে লেখা কবিতা যদি আজকের পাঠক মুগ্ধ-বিস্ময়ে
পড়েন তাহলে সেই কবির প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকতে পারে না। এখন পড়া যাক আরেকটি কবিতা :

‘ যে কবিতা মানুষের অশোভন
হাই ওঠা থামাতে পারে না / তাকে আর যুদ্ধে পাঠিও না /
বোবাদূত না পাঠানো ভালো।
গুমোটের দিনে যে কবিতা শুধু
দগ্ধ মেঘের মত শূন্যের নীলাকাশে ভেসে যায় /
একফোঁটা বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারে না / সেইসব কবিতার
মতদেহ / লজ্জায় সরিয়ে ফেল সংকলন থেকে। ‘
(কবিতার সন্ধ‍্যা : বিষাদ
ভেঙেছে ধনুঃশর )

আরও পড়ুন- বেঁচে নাও এই মুহূর্তে, উৎপল সিনহার কলম

‘ যা কিছু বলতে এসেছো বলো / খুলে দাও অন্ধকার, /
মৈত্রী যদি ভেঙ্গে যায় যাক /
সঙ্ঘ যদি ভেঙ্গে যায় যাক /
তুমি তো তোমার কাছে / আমি তো আমার কাছে
প্রতিশ্রুত আছি। ‘
( ভালোবাসা : বিষাদ ভেঙেছে
ধনুঃশর )

অপূর্ব সব উপমা ব‍্যবহার করেছেন এই কবি তাঁর কবিতায়। কিন্তু কবিতাকে কখনোই ইঙ্গিত আর সঙ্কেতের
ভারবাহী গাধায় পরিণত হ’তে দেন নি। প্রয়োজন হলেই কবিতাকে স্বচ্ছ জলের মতো
নিরাভরণ সারল‍্যে উপস্থাপিত করেছেন বিদগ্ধ পাঠকের কাছে। অনাবশ‍্যক শব্দভার ও বাহুল্য বর্জন ক’রে কবিতাকে সুদূরগামী করা ছিল তাঁর অন‍্যতম সাধনা।
শব্দের পর শব্দ জুড়ে পাঠকের হৃদয় পোড়ানোই যদি না যায়, কবির অন্তর্দাহ যদি পাঠকের হৃদয়ে সঞ্চারিত না করা যায় তাহলে কবিতা লিখে কী লাভ?

‘ আলো চাই — আলো নেভানোর মতো অন্ধকার চাই। ‘
( দুই বাংলার দগ্ধ পদাবলী )

‘ আমাদের আগে আগে / গ্রান্ডট‍্যাঙ্ক রোড ধরে / তসরের জামা পরে / হেঁটে যায় তরল তৈমুর / সেই জানে / দু’ বিঘে অন্ধকারে ফেলা আছে বীজ /
সেই জানে চাঁদ ছিঁড়ে
চাঁদমালা পরার নিয়ম।
মুখের সমস্ত বিভা
নাইবা দেখালে। ‘
( অসম্পূর্ণ চাঁদমালা )

তারক সেন বুঝেছিলেন কবিতার প্রচলিত রীতি ও প্রথা ভাঙতে হ’লে আগে নিজেকে ভাঙতে হবে। কবিতাকে নতুন ভাষার দরজায় পৌঁছে দিতে হলে নিজের মানসিকতা বদল খুবই জরুরি। যুগের হুজুগ ও সমকালের আহ্বানকে কখনোই উপেক্ষা করতে পারেন নি এই কবি। কিন্তু তিনি উচ্চকিত হওয়ার প্রবণতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পেরেছিলেন। প্রেমে বা প্রতিবাদে কখনোই তিনি নান্দনিকতাকে বর্জন করেন নি। ভাবীকালকে স্বাগত জানিয়েছেন এই ভাষায় :

‘ তোমাদের কবিতা আমাদের কবিতার অহংকারকে
চূর্ণ করুক।
সে আমার পরম প্রার্থিত সুখ। ‘

আরও পড়ুন- জল পড়ে পাতা নড়ে, উৎপল সিনহার কলম

 

 

Previous article২১শে জুলাই পালিত হবে একাধিক বিজেপি শাসিত রাজ্যেও, শোনানো হবে মমতার ভাষণ
Next articleBreakfast news: ব্রেকফাস্ট নিউজ