Sunday, August 24, 2025
উৎপল সিনহা

উত্তর কলকাতার পাঁচমিশালি মেসবাড়ি। পাঁচমিশালি মানে হেড অফিসের বড়বাবু থেকে ট্রেনের হকার, কাগজবিক্রেতা হ’য়ে একেবারে ছাপোষা হরিপদ কেরানী পর্যন্ত সকলের একত্র-সহাবস্থান যে মেসে।
সেখানকার তরুণ রাঁধুনিটিও পড়ে থাকে মেসের রান্নাঘরের পাশে একফালি ছোট্ট বারান্দায়। দুবেলা রান্না করে, পরিবেশনও করে। আরো দুহাতা ভাত দাও তো, আরো এক হাতা ডাল দাও গো, আর এক টুকরো মাছ হবে নাকি হে , আর এক হাতা আলু পোস্ত হবে নাকি, জব্বর হয়েছে আজ রান্নাটা… এইসব বায়নাক্কা হাসিমুখে সামলে রাঁধুনি নিজে খেতে বসে রান্নাঘরের এক কোনে। কোনোদিন আধপেটা খায়, কোনোদিন সেটুকুও জোটে না , যেদিন একটুও খাবার অবশিষ্ট থাকে না সেদিন অভুক্ত ঘুমিয়ে পড়ে সে। এই ঘটনা ষাটের দশকের।

একদিন কীভাবে যেন মেসের সবার কাছে ধরা পড়ে যায় তার অভুক্ত ও অর্ধভুক্ত থাকার ঘটনা। বোর্ডারদের ক্রমাগত জেরায় সে জানায় গ্রামের বাড়িতে থাকা তার মায়ের উপদেশের কথা। মা বলেন, বাড়িতে হোক অথবা কোনো অনুষ্ঠানবাড়িতে কখনও আগে খেতে নেই। খেতে হয় সবার শেষে। কারণ, একেবারে শেষে যে বা যারা খাবে তার বা তাদের খাবার যেন কম না পড়ে সেটা না ভাবলে কিসের মনুষ্যত্ব। মায়ের সেই উপদেশ মেনে চলতে গিয়ে অনেক সময় খাওয়ার কথা মনেই থাকে না। এরপর আর কথা হ’তে পারে না। কারো মুখেই আর কথা সরে না। গোটা মেস জুড়ে এক আশ্চর্য নীরবতা নেমে আসে।

আরও পড়ুন- বেঁচে নাও এই মুহূর্তে, উৎপল সিনহার কলম

কোনো এক মফস্বলের বার্ষিক ক্লাব মিটিংয়ে উদ‍্যমী এক যুবক আবেগের বশে ব’লে ফেলেন চাইলে মুম্বাই (তখন বলা হত বোম্বাই ) থেকে অমুক ( ভারতসেরা ) গায়ককে এনে ক্লাবের মঞ্চে গান গাওয়ানো সম্ভব। একথা শুনে ক্লাবের বাকি সদস্যেরা হাসাহাসি ও ঠাট্টা তামাশা করতে থাকে। এতে জেদ চেপে যায় যুবকের। কয়েক দিন পরে কিছু টাকা জোগাড় ক’রে কাউকে কিছু না জানিয়ে মুম্বাইগামী ট্রেনে চেপে পড়ে সে। মুম্বাই পৌঁছে নানা বাধা পেরিয়ে, খ‍্যাতনামা গায়কের ম‍্যানেজারের জেরা অতিক্রম ক’রে অবশেষে গায়কের মুখোমুখি হয় যুবকটি। গায়ক সব শুনে তাঁর পারিশ্রমিকের অর্ধেক টাকা অগ্রিম চেয়ে বসেন। এবার যুবক অসহায় বোধ করতে থাকে। অগ্রিম টাকার কথা তো সে ভাবে নি। তাহলে কি তীরে এসেও ডুবে যাবে তরী?
সে অনেক অনুরোধ করেও গলাতে পারে না গায়ককে। অথৈ জলে পড়া যুবক বিদায়কালে বলতে থাকে তার ব‍্যর্থতা নিয়ে কি ভীষণ ব‍্যঙ্গ-বিদ্রুপ সহ‍্য করতে হবে তাকে। সইতে হবে কত অপমান। সব শুনেও নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল গায়ক প্রায় হাত জোড় ক’রে নিজের অপারগতার কথা জানান। তিনি বলেন তাঁরও খুবই খারাপ লাগছে, কিন্তু, অগ্রিম ছাড়া তিনি কোথাও গাইতে যান না। বিফল মনোরথ যুবকটি গায়ককে বিদায় জানিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে আপন মনেই বিড়বিড় করতে থাকে, ‘ অপমান, বিদ্রুপ সব আমি সহ‍্য ক’রে নেবো, কিন্তু ঠাকুমাকে মুখ দেখাবো কী ক’রে? তাকে যে বড় মুখ ক’রে বলে এসেছি… ‘

‘ দাঁড়ান, কী ব’লে এসেছেন ঠাকুমাকে? ‘

যুবক জানায় তার নবতিপর ঠাকুমা দীর্ঘদিন ধরে শয‍্যাশায়ী। হাঁটাচলা করতে পারেন না। গান ভালোবাসেন। ভীষণ অসুস্থতাতেও গুনগুন ক’রে গাইতে ভোলেন না। তাঁর ভীষণ ইচ্ছে, ‘ আপনার সামনে ব’সে আপনার একটা গান তিনি শুনবেন। আপনি আসতে পারেন শুনে তিনি শিশুর মতো উচ্ছাস প্রকাশ ক’রে একটা অনুরোধ করেছেন,তা হলো, আপনার অনুষ্ঠানে তাঁকে কোলে ক’রে অন্তত পাঁচ মিনিটের জন‍্যে হ’লেও নিয়ে যেতেই হবে। বেশিক্ষণ বসে থাকার শক্তি তো ওনার নেই। মাত্র একটি গান শুনেই উনি বাড়ি ফিরে যাবেন। আপনার সেই গানটি আমার ঠাকুমার ভীষণ প্রিয় গান। গানটি হলো… ‘
গায়ক কয়েক মুহূর্ত চুপ ক’রে থাকেন। তারপর কিছুটা উদাস গলায় বলেন, ‘ অ‍্যাডভান্স দিতে হবে না, আপনি ফিরে গিয়ে ঠাকুমাকে বলুন ওনার প্রিয় গানটি অবশ‍্যই উনি শুনতে পাবেন।
তারপর স্বগতোক্তি করলেন যেন খুব নিচু স্বরে : ঠাকুমাকে গান শোনাতে যেতে হবে যে…

আরও পড়ুন- অসামান্য তারক সেন, উৎপল সিনহার কলম

অসীম সেন। আজ চাকরি থেকে অবসর নেবেন। কলকাতার ডালহৌসিতে তাঁর অফিস। বর্ধমান থেকে হাওড়া পর্যন্ত যান লোকাল ট্রেনে। তারপর বাসে অফিসপাড়া। তিরিশ বছর ধ’রে লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করছেন অসীম বাবু। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো হকারের কাছ থেকে কোনো জিনিস কেনেন নি তিনি। আসলে কেনার দরকার পড়ে নি। সকালের ট্রেনে যান, রাতের ট্রেনে ফেরেন। অসংখ্য হকারের দেখা পান ট্রেনে। নানা রঙের হকার। নানান সামগ্রী। খাবার-দাবার থেকে শুরু ক’রে সেফটিপিন পর্যন্ত। আর, আশ্চর্য তাদের প্রচার কৌশল। কারোর দৃপ্ত কন্ঠ, স্পষ্ট উচ্চারণ। কারোর আবার গলা ভাঙা। উচ্চারণ অস্পষ্ট। কেউ চিৎকার করে, কেউ মৃদুভাষী। অসীম বাবু বছরের পর বছর ধ’রে হকারদের এই বিচিত্র প্রচার কৌশল ও বেচাকেনা দেখতে দেখতে আজ অবসরের দোরগোড়ায়। কিন্তু কখনও কিছু কেনেন নি।

আজ অবসরের দিনে ঘন্টা দুয়েকের বেশি থাকতে হলো না অফিসে। অফিসে ঢুকেই মিষ্টিমুখ। সহকর্মীদের অনেকেই যেন একটু বিমর্ষ আজ। তবু সবার সঙ্গে বসে চা খাওয়া। তারপর ফেয়ারওয়েলের ছোট্ট অনুষ্ঠান। সহকর্মীদের ভাষণে অসীমবাবুর কর্তব‍্যপরায়ণতা ও সুমধুর ব‍্যবহারের ভূয়সী প্রশংসা। প্রচুর উপহার, মানপত্র, স্মারক ও মিষ্টির প‍্যাকেট একটা বড় ব‍্যাগে ভ’রে দুজন জুনিয়র সহকর্মী একটা ট‍্যাক্সি ডেকে অসীমবাবুকে পৌঁছে দিয়ে গেল হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত। তারপর তিনি একা।

নির্দিষ্ট সময়ে ৮ নং প্ল‍্যাটফর্ম থেকে বর্ধমানগামী ট্রেনে উঠলেন। আজ মনটা একটু দমে রয়েছে। হালকা একটা বিষাদ যেন ছেয়ে আছে বুকের ভেতরটায়। তিরিশ বছরের চাকরীজীবন আজ শেষ। ট্রেন চলছে। হকারেরা উঠছে, নামছে। হঠাৎ শুনলেন একজন হকার বলছে, ‘ লজেন্স খান, লজেন্স ; লাল-নীল-সবুজ-খয়েরী নানা রঙের নানা স্বাদের লজেন্স, আপনি লজেন্স খেলে বাড়িতে আমার বাচ্চাটা ভাত খাবে। ‘

এই শেষের ক’টা শব্দ শুনে অসীমবাবু কেমন যেন নড়ে গেলেন। মনটা এমনিতেই আজ কেমন যেন আর্দ্র ও দ্রব হ’য়ে আছে। তার ওপর ‘ আপনি লজেন্স খেলে আমার বাচ্চাটা ভাত খাবে ‘ শুনে বুকের ভেতরে যেন একটা ধাক্কা খেলেন অসীমবাবু। হকারকে কাছে ডাকলেন। দীর্ঘ তিরিশ বছরে যা করেন নি আজ তা-ই করলেন। বেশ কয়েক প‍্যাকেট লজেন্স কিনে ব‍্যাগে ভরলেন।

বাড়িতে পৌঁছে দুপুরের খাবার খেলেন না। লজেন্সের প‍্যাকেট খুলে একটা লজেন্স মুখে দিলেন। সঙ্গেসঙ্গেই মনে ভেসে উঠলো একটি অভুক্ত বাচ্চার মুখ। সে অপেক্ষা করছে তার বাবার জন্য। বাবা এলেই বাড়িতে ভাতের হাঁড়ি চড়বে। আহ্, কী যে সুন্দর গরম ভাতের গন্ধ!

আরও পড়ুন- সেতারে জিলা কাফি, উৎপল সিনহার কলম

Related articles

পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য ‘শ্রমশ্রী’ প্রকল্পে নাম নথিভুক্তি শুরু

পরিযায়ী শ্রমিকদের সুবিধার্থে এবার আরও এক পদক্ষেপ রাজ্য সরকারের। ‘আমাদের পাড়া আমাদের সমাধান’ কর্মসূচির আওতায় দুয়ারে সরকার শিবিরেও...

‘নিখুঁত ভুলগুলি’, উৎপল সিনহার কলম

একটা দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান হয়ে ওঠে ...একটি দুঃখের কথা পথে ও বিপথে ঘুরে প্রত্যাখ্যাত হতে হতে গান...

ষোলতেই ১৩০ কেজি! ছেলের খাবার জোগাতেই নাজেহাল বাবা-মা

মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘি থানার কাবিলপুর পঞ্চায়েতের মথুরাপুর গ্রাম। এখানেই থাকেন দিনমজুর মুনশাদ আলি। তাঁর ছোট ছেলে জিশান আলি...

কবে থেকে শুরু জয়েন্টের কাউন্সেলিং? দিনক্ষণ জানিয়ে দিল বোর্ড

ফলপ্রকাশের পর এবার ১৫ দিনের মধ্যেই কাউন্সেলিং প্রক্রিয়া তথা ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ করবে জয়েন্ট এন্ট্রান্স বোর্ড। এবার কাউন্সেলিং...
Exit mobile version