বিচারাধীন বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার: ফের বিতর্কে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়

এসএসসি দুর্নীতি মামলা হাইকোর্টে বিচারাধীন। কিন্তু সেই সম্পর্কেই সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে মুখ খুলে ফের বিতর্কে জড়ালেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Abhijit Ganguli)। সোমবার রাত ৮ টা য় একটি বেসরকারি নিউজ চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে এই দুর্নীতি মামলা নিয়ে নানা মন্তব্য করেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় অবশ্য নিজের বক্তব্যের সাপেক্ষে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের মত, তিনি ‘ব্যাঙ্গালোর প্রোটোকল’ বলে একটি প্রোটোকল অনুযায়ী বিচারপতি হিসেবে এই সাক্ষাৎকার দিলেন। “বিচার ব্যবস্থার প্রতি আমার সম্পূর্ণ আস্থা আছে। আমি জানি পরে এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক হতে পারে। ‘ব্যাঙ্গালোর প্রোটোকল’-এ বলা আছে, তিনি বিচারপতিদেরও বাক স্বাধীনতা আছে। আইন নিয়ে তিনি কথা বলতে পারেন। আমি সেই মতোই বলছি।” কিন্তু এখানেই প্রশ্ন উঠছে যদি বিচারপতি নিজেই এভাবে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমে মুখ খুলতে পারেন, তাহলে সেই বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমই বা বলতে পারবে না কেন?

সাক্ষাৎকারে বারবার বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, তিনি দুর্নীতি সহ্য করতে পারেন না। সেই কারণেই, চোখের সামনে “অ্যাডমিটেড দুর্নীতি” দেখলে তিনি পদক্ষেপ করেন। তাঁর কথায়, “এক সংস্থা বলছে, অন্যের সুপারিশে করেছি। আর এক সংস্থা বলছে জানি না। দুটো আলাদা হলফনামা আসে আমার কাছে। স্ববিরোধী মন্তব্য হওয়ায় মনে হল দুর্নীতি আছে।”

বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় গত কয়েক মাসে ১০টি মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। তবে, তিনিও মনে করেন, সিবিআই নিয়ন্ত্রিত হয় না সেটা নয়; কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার নিয়ন্ত্রিত হয়। CBI-এর কাজের গতি নিয়ে সন্তুষ্ট নন বলে জানান বিচারপতি। একবার তিনি বলেছিলেন, “যে অন্ধকার সুরঙ্গের শেষে আমি আলো দেখতে পাচ্ছি না”। সে প্রসঙ্গে এদিন সাক্ষাৎকারে অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জানান, “সিবিআইকে তদন্ত ভার দেওয়ার পরেও দেখছিলাম অনেক দেরি হয়ে যাচ্ছে। তখন কোনও অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছিলাম না বলে বলেছিলাম, আমি অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখতে পাচ্ছি না।” পরে উপেন বিশ্বাস তাঁকে জানান, সিবিআই-এর মধ্যেও সিট (SIT) গঠন করে দেওয়া যায়। এরপর তিনি তদন্তে সিবিআই-এর সিট গঠন করে দেন। তবে ক্ষুব্ধ বিচারপতির প্রশ্ন, “ইডি যদি দ্রুত তদন্ত করতে পারে, সিবিআই কেন পারছে না!”

যাঁরা দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছেন, ধরা পাড়লেই তাঁদের চাকরি যাবে বলে মত বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের। “যাঁরা দুর্নীতি শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছেন সেই শিক্ষকরা কী শেখাবেন! কটাক্ষ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের।

অনেক মামলায় সময় নির্দিষ্ট করে রায় দিয়েছিলেন বিচারপতি। সেই প্রসঙ্গে তাঁর মত, “যাদের কথা বলেছি তাঁদের প্রচুর টাকা। টাকা খরচ করে তাঁরা যে কোনও আইনজীবীর কাছে পরামর্শ নিতে পারে। কারণ সময় নষ্ট করলে তারা তথ্য-প্রমাণ নষ্ট করতে পারেন। এই জন্য আমি সময় বেঁধে দিয়েছিলাম।”

ক্যান্সার আক্রান্ত এসএসসি চাকরিপ্রার্থী সোমার চাকরি হওয়ায় তিনি অত্যন্ত খুশি বলেন জানান বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। এক্ষেত্রে মুখ্যমন্ত্রী এবং শিক্ষা দফতরের ভূমিকায় মানুষ হিসেবে তিনি অত্যন্ত আনন্দিত।

হাইকোর্টের একটি অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে মুখোমুখি হয়েছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের। নিজে গিয়েই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করেন। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় (Mamata Bandopadhyay) তাঁকে বলেন, “আপনি আপনার মতো কাজ করুন।” মুখ্যমন্ত্রী অত্যন্ত ভদ্র। খুবই ভদ্র ব্যবহার বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ওই মন্তব্য হাসিমুখে, ভালো মন নিয়ে বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী।

বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের বাবা ছিলেন আইনজীবী। ছোটবেলায় তিনি বাবাকে হারান। আইনজীবী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে গুরু হিসেবে মানেন অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। WBCS অফিসার হিসেবে ভূমি ও রাজস্ব দফতরে চাকরি পান। কিন্তু তাঁর কথায় সেই সময় ওই দফতর অত্যন্ত দুর্নীতিগ্রস্ত বলে চাকরি ছেড়ে দেন। এরপর আইনজীবী হিসেবে জীবন শুরু করেন। এসএসসির মামলা লড়েছিলেন বলে বিষয়টি সম্পর্কে সব জানেন বলে দাবি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের।

বিচার ব্যবস্থা সম্পর্কে কেউ বিরূপ কিছু বললে সেটা মেনে নিতে পারেন না অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। এ বিষয়ে তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য যে তাঁর পছন্দ হয়নি- সেটাও এদিনের সাক্ষাৎকারে প্রকাশ করেন বিচারপতি।

আরও পড়ুন- SSC দুর্নীতি মামলায় প্রথম চার্জশিট জমা ইডি-র, ‘অপা’-র ১০৩ কোটির সম্পত্তির খতিয়ান

এই সাক্ষাৎকারের জন্য সুপ্রিম কোর্ট যদি তাঁকে তিরস্কার করে, আইন ব্যবস্থা থেকে বের করে দেয়- তাহলেও তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়বেন বলে জানান জাস্টিস গাঙ্গুলি। তিনি এমন দু-একটি রায় দিয়ে যেতে চান, যাতে তিনি যখন থাকবেন না তখনও সেই রায় নিয়ে গবেষকরা কথা বলবেন, তার উদাহরণ দেওয়া হবে।

অবসরের পরে কি রাজনীতিতে যোগ দেবেন? সে জল্পনা একেবারে উড়িয়ে দেননি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “আমি রাজনীতিতে যাব না এরকম কথা এখনই বলতে পারি না।”

বিচারের ক্ষেত্রে বুদ্ধির পাশাপাশি আবেগও কাজ করে- মন্তব্য বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের। দুর্নীতির দমনে সন্ত্রাস মাঝে মাঝে অত্যন্ত ইতিবাচক ফল দেয় বলে মনে করেন তিনি। তবে, সেটা ‘সন্ত্রাসবাদ’ নয়- স্পষ্ট করে দিয়েছেন বিচারপতি।

আরও পড়ুন- বিস্ফোরক বাইচুং, বাইচুং-এর অভিযোগ এআইএফএফের বৈঠকে পাত্তাই দেওয়া হল না তাঁর প্রস্তাব

বিচারপতি হয়ে কোন কোন বিষয়টা ত্যাগ করতে হয়েছে? অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় জানান, “আমার মেলামেশায় রাশ টানতে হয়েছে। অনেক বন্ধুদের ত্যাগ করতে হয়েছে। কফি হাউসের আড্ডা মিস করি।” আর আগে পুলিশ স্যালুট করত না, এখন করে। আগে পুলিশ বাড়িতে আসলে ভয় পেতেন, কেন এলো? এখন না এলে জিজ্ঞাসা করেন, কেন এলো না? সরস মন্তব্য বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের।

বাঙালি ভাবা ভুলে গিয়েছে- আক্ষেপ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের। ঋত্বিক ঘটকের মতো তিনিও বলতে চান, “ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো।” তাঁর কথায়, আইনের পরিবর্তন করার প্রয়োজন নেই। মানুষের নৈতিক চরিত্রের পরিবর্তন করলেই হবে। শেষে আবার তিনি বলেন, “সাক্ষাৎকার দিয়েছি বলে যদি মনে হয় বিচার ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাহলে আমাকে তার জন্য ভুগতে হবে”। তবে এখানেই প্রশ্ন হচ্ছে বিচারাধীন বিষয় নিয়ে এত দীর্ঘ সাক্ষাৎকার তিনি যদি সংবাদমাধ্যমে দিতে পারেন, তাহলে সংবাদ মাধ্যম কেন এ বিষয়ে কথা বলতে পারবে না!

 

 

 

Previous articleবিস্ফোরক বাইচুং, বাইচুং-এর অভিযোগ এআইএফএফের বৈঠকে পাত্তাই দেওয়া হল না তাঁর প্রস্তাব
Next articleদ্রুত আরোগ্য কামনা: আহত ACP দেবজিৎ-কে দেখতে SSKM-এ মুখ্যমন্ত্রী