আমার বলার কিছু আছে

হৈমন্তী শুক্লা

আমাদের কম বয়সে পুজোর গান নিয়ে সাংঘাতিক উন্মাদনা ছিল। অপেক্ষায় থাকতাম কাদের গান বেরোবে। পছন্দের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, শ্যামল মিত্র, নির্মলা মিশ্র, প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়। পুজোর প্যান্ডেলে গেলেই শোনা যেত এঁদের গান। শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে যেত।

পরবর্তী সময়ে পুজোর গানে পাওয়া গেল বম্বের শিল্পীদের। লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোসলে, সুমন কল্যাণপুর, মহঃ রফি, কিশোরকুমার। এঁদের জন্য সুর করতেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সলিল চৌধুরি, রাহুল দেববর্মন। রাহুল গাইতেনও। একটা অন্যরকম গায়কি ছিল ওঁর। অসম্ভব বুদ্ধিমান। এঁদের গান বাজত বিভিন্ন পুজো মণ্ডপে।

সেইসময় বেরত পুজো সংখ্যার বই। ছাপা হত শিল্পীদের ছবি। পুজোয় কোন শিল্পী কী কী গান গাইছেন, সাজিয়ে দেওয়া হত তালিকা। ছাপা হত গানের লিরিক্স, নোটেশন। সঙ্গে গীতিকার, সুরকারদের নাম। দারুণ চাহিদা ছিল ওই বইয়ের। রেকর্ডের পাশাপাশি হ‌ইহ‌ই করে বিক্রি হত।
পুজোর গানকে জনপ্রিয় করার পিছনে সেইসময় অনুরোধের আসরের বড় ভূমিকা ছিল। শনিবার ও রবিবার আমরা মুখিয়ে থাকতাম। আগ্রহ থাকত শেষে কার গান বাজবে, সেই নিয়ে। কিছু কিছু গান, গানের মিউজিক শুনে মন নেচে উঠত। মনে হত, যেন পুজো এসে গেছে। লতা মঙ্গেশকরের ‘সাত ভাই চম্পা’ গানের মিউজিক শুনে আমার অন্তত এমনটাই মনে হত।
১৯৭০ সালে বেরোয় আমার প্রথম পুজোর গান। শৈলেন মুখোপাধ্যায়ের সুরে। হিন্দুস্তান রেকর্ডস থেকে। একটা রেকর্ডে দুটো গান। ‘এ তো কান্না নয় আমার’ এবং ‘ময়ূর নাচ কে দেখবি আয়’। কথা লিখেছিলেন পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়। গান দুটো দারুণ সাড়া জাগিয়েছিল। বেজেছিল বিভিন্ন পুজোর প্যান্ডেলে, অনুরোধের আসরে। গানের জগতে ছড়িয়ে পড়েছিল আমার নাম। প্রশংসা করেছিলেন বড়রাও। আসলে তার আগে আমি ক্ল্যাসিক্যাল গাইতাম। বাবার অনুমতি নিয়ে গেয়েছিলাম বাংলা গান।

পরবর্তী সময়ে পুজোর গান গেয়েছি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দের সুরে। হেমন্তদার সুরে পুজোয় প্রথম গেয়েছিলাম ‘তোমার কাছে সবই পেলাম’ এবং ‘কত সহজ দেখা’ গান দুটি। মান্নাদার সুরে অসংখ্য গান। তার মধ্যে ‘আমার বলার কিছু ছিল না’ আমাকে শ্রোতাদের মনে স্থায়ী জায়গা পেতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল। গানটা মান্নাদা নিজের জন্য তৈরি করেছিলেন। আমি চেয়ে নিয়েছিলাম। পণ্ডিত রবিশঙ্করের সুরেও বাংলা গান গেয়েছি। দেখেছি, পুজোর গান নিয়ে সারাবছর মানসিক প্রস্তুতি থাকত শিল্পীদের মধ্যে।

পুজো উপলক্ষে তখন পাড়ায় পাড়ায় হত জলসা। বিজয়া সম্মিলনী। ছোটবেলায় সেইসব জলসায় বহু বিখ্যাত শিল্পীর গান শুনেছি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সামনে থেকে শোনার সুযোগ হয়েছে তখনই। কোনও কোনও আসরে গাইতেন বম্বের শিল্পীরা। ফাটাফাটি গানবাজনা হত। এইভাবেই কাটত পুজোর দিনগুলো।
নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পুজোর গান নিয়ে আগ্রহ ছিল। সুমন, নচিকেতার কথা-প্রধান গান মানুষের মুখে মুখে ফিরত। শোনা যেত প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। ইন্দ্রনীল, শ্রীকান্ত, সৈকত, মনোময়, রূপঙ্কর, রাঘব, স্বাগতা, শুভমিতার পুজোর গানও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এরা প্রত্যেকেই আমার খুব প্রিয় শিল্পী। নচিকেতা চক্রবর্তী এবং স্বাগতালক্ষ্মী দাশগুপ্তর গান আমার পুজোর অ্যালবামে ছিল। বলতে পারি, বিভিন্ন প্রজন্মের সুরকারদের সুরে আমি গেয়েছি।
এখন সময় পাল্টেছে। গান তৈরি হচ্ছে প্রচুর। তবে মনে দাগ কাটছে না। রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি পেরিয়ে চলছে ইউটিউবের যুগ। একটা-দুটো করে গান প্রকাশ পায়। ভিউয়ার হয় প্রচুর। বয়ে যায় কমেন্টের বন্যা। অনেক শিল্পী এইসব প্রশংসা শুনে আনন্দে নাচেন। আমার কিন্তু হাসি পায়। শুকনো কথায় ঠিক কী লাভ হয় বুঝি না। এইসব গান তো আগের মতো মুখে মুখে ছড়ায় না। আসলে সস্তায় হয় না কিছুই। আগে গান শোনার জন্য রেকর্ড প্লেয়ার, টেপ রেকর্ডার বের করতে হত। তারপর ক্যাসেট, সিডি। এখন ফোনে আঙুল ছোঁয়ালেই গান। শোনার জন্য কোনও খরচ করতে হয় না।
নতুন গান তেমন না চললেও, এখনও বহু মানুষ ইউটিউবে পুরোনো বাংলা গান শোনেন। আসলে নতুন গানে প্রাণ নেই। অনুষ্ঠানে এখনকার গান পরিবেশিত হলে শিল্পী-শ্রোতা দুই পক্ষই নেচে ওঠেন।

তখনকার দিনে গানের আমেজ ছিল আলাদা। মানুষ চোখ বন্ধ করে শুনতেন। একবার নৌসাদজি বলেছিলেন, ‘বাংলা গান প্রাণে শান্তি দেয়, ওয়েস্টার্ন নাচায়।’ বর্তমান প্রজন্মের গানে ওয়েস্টার্ন প্রভাব বেশি। তবে এদের মধ্যে কয়েকজনের গান আমার ভাল লাগে। পছন্দ করি কিছু বাংলা ব্যান্ডের গান। ক্যাকটাসের হলুদ পাখি আমার খুব প্রিয়। এই গানও তো বেশ কয়েক বছর আগের। পুজোর নতুন গান নিয়ে এখন সত্যিই আর কোনও উন্মাদনা নেই। এখনও পুজোর প্যান্ডেলে পুরোনো দিনের গানই শোনা যায়। আসলে মানুষ কিন্তু ভাল গান শুনতে চান। উপযুক্ত মাধ্যম দরকার।
এইবছর পুজোয় আমার বেশ কয়েকটা গান বেরিয়েছে। কিন্তু কেউই সেভাবে জানেন না। শুনছি, ভিউয়ার হচ্ছে প্রচুর। কীভাবে হচ্ছে বুঝি না বাপু।

পুজোর জলসা এখনও হয়। তবে বদল ঘটেছে সেখানেও। প্রচুর আলো, প্রচুর মিউজিক, এতে আমাদের একটু অসুবিধা হয়। বেশিরভাগই নতুন প্রজন্মের শিল্পী। পাশাপাশি ডাক পাই আমরাও। আমাদের গান শোনার মতো প্রেস্টিজিয়াস শ্রোতা এখনও কিছু কিছু আছেন। আছেন রুচিশীল উদ্যোক্তাও। তাঁরা আমাদের কাছে পুরোনো গানগুলোই শুনতে চান।

অন্য শিল্পীদের অসংখ্য পুজোর গান আমার প্রিয়। তালিকা দীর্ঘ। তবে নিজের কোনও গান আমার পছন্দের তালিকায় নেই। সেরা গানটা এখনও আমি গেয়ে উঠতে পারিনি।

আরও পড়ুন- হিন্দু মহাসভার পুজোয় অসুরের বদলে গান্ধীজি! মামলার পর রাতারাতি বদলাল অসুরের চেহারা

অনুলিখন : অংশুমান চক্রবর্তী


 

 

 

Previous articleহিন্দু মহাসভার পুজোয় অসুরের বদলে গান্ধীজি! মামলার পর রাতারাতি বদলাল অসুরের চেহারা
Next article“শিবের নির্দেশ”, ৬ বছরের নাবালকের বলি চড়ালো দুই কিশোর