ঘোমটার আড়ালে কেন সিপিএম!গোয়েবেলসীয় কায়দায় সেই মিথ্যাচার

অভিজিৎ ঘোষ
সেই মিথ্যাচার সমানে চলছে। ক্ষমতাচ্যুত হয়েও কোনও শিক্ষাই কাজে লাগেনি কমরেডদের। শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমেছে সিপিএম। সেটা তাদের স্বভাব। কিন্তু শনিবার নাগরিক মঞ্চের নামে একটি মিছিল হল কলকাতায়। এবং মানুষ চেয়ে দেখলেন সিপিএমের মুখোশ। যাঁরা মিছিলে ছিলেন তাঁদের ৯৮ শতাংশ সিপিএমের পরিচিত মুখ, এলাকার কর্মী, ছাত্র, যুব এবং মহিলা। প্রশ্ন হল, কোন কারণে নাগরিক মঞ্চের মুখোশ পরে সিপিএম এই নাটুকেপনায় অংশগ্রহণ করেছিল। প্রকাশ্যে আসতে অসুবিধে কোথায়? নাকি মানুষের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক দল ছাড়াও সাধারণ মানুষও রয়েছেন! সিপিএমের এই বহু পুরনো স্ট্র্যাটেজি এখন ধরা পড়ে গিয়েছে। বহু ব্যবহারে ক্লিশে। মিছিলের হাতেগোনা সংখ্যা সে কথাই জানান দিচ্ছে।

আরও পড়ুন: পূর্বসূরি বসুকেই বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন মমতা, অভিজিৎ ঘোষের কলম
তবু যাঁরা মিছিলে অংশ নিলেন তাঁদের মধ্যে অবশ্যই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ রয়েছেন। যাঁরা যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি বিচার করেন। তাঁদের কাছে কিছু প্রশ্ন, কিছু জিজ্ঞাসা, কিছু যুক্তি এবং ঠিক-ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দাবি
রইল। তার কারণ, এই মুহূর্তে গোয়েবেলসীয় কায়দায় মিথ্যাচার শুরু হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি তো রয়েছেই। তার সঙ্গে মিডিয়ার একাংশ। কিন্তু সাদাকে সাদা কিংবা কালোকে কালো বলতে অসুবিধে কোথায়? প্রথমেই বলে রাখা ভাল, হ্যাঁ কিছু ভুল হয়েছে। ত্রুটি আছে। সরকার তার সংশোধন করছে। যদি কেউ অন্যায় করে থাকে তার শাস্তি হবে। কিন্তু আইন মেনে আদালতের নির্দেশে যে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তাকে কেন বারবার নানা কারণে বাধা দেওয়া হচ্ছে? দেরি হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তাতে লাভ কাদের? নিশ্চিতভাবে বিরোধীদের। আশা করি এই ছোট্ট কথাটা চাকরিপ্রার্থীরা বুঝবেন।
করুণাময়ীতে চাকরিপ্রার্থীদের তুলে দেওয়ার নির্দেশ কার ছিল? আদালতের। শনিবার মিছিলে হাঁটা কেউ কেউ কাদের গালাগাল করা শুরু করেছেন? রাজ্য সরকারকে। প্রশ্ন হচ্ছে, কোর্টের নির্দেশ মানা কি রাজ্য সরকারের অন্যায় হয়েছে? মাথায় রাখুন, আদালতের নির্দেশ না পাওয়ার কারণে অবস্থানকারীদের ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্পর্শ করেনি পুলিশ। এরপর আদালতের নির্দেশ। মাইকে বারবার অনুরোধ। উপেক্ষা অবস্থানকারীদের। দাবি, পর্ষদ সভাপতি এসে তাঁদের প্রত্যেকের হাতে নিয়োগপত্র দিয়ে যাবেন। এটাকে আবদার বলবেন নাকি অন্যায্য জেদ? আজকে যাঁরা কোর্টের নির্দেশ উপেক্ষা করতে বলছেন, কয়েকদিন আগেই তাঁরা বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় কোনও নির্দেশ দিলেই তা কার্যকর করার জন্য শোরগোল ফেলে দিতেন। তাহলে সেদিন বা আজ কেন ১৮০ ডিগ্রি উল্টো অবস্থান?

এক শ্রেণির মিডিয়া উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কিছু ছবি দেখাচ্ছে। ক্ষতি নেই। দেখান। বলা হচ্ছে, অবস্থানকারীদের সঙ্গে পাশবিক আচরণ করে জায়গা ফাঁকা করা হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বারবার অনুরোধের পরেও না সরায় পুলিশ বাধ্য হয়েছে অবস্থানকারীদের পাঁজা কোলে তুলে দিতে। আপনারাই বলুন, সরিয়ে দেওয়ার এর বিকল্প কী ছিল? আপনারা কি চাইছিলেন পুলিশ লাঠি চালাক, কাঁদানে গ্যাস, জল কামান ব্যবহার করুক! এসব ব্যবহার না করায় কি নিতান্ত হতাশ হয়েছেন? মুড়িটা বেশ ভালই মাখা হয়েছিল কিন্তু প্রশাসনের ইতিবাচক আচরণে খাওয়াটা জমল না। তাই না? আপনারা চেয়েছিলেন প্ররোচনা দিতে। যাঁদের সঙ্গে শিক্ষাঙ্গনের কোনওরকম যোগাযোগ নেই তাঁদের সেই রাতে বিপ্লবীর ভূমিকা দেখে অসিতবরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি ঐতিহাসিক ছবির কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। গুলি চলবে, বুলডোজার আসবে। তবেই না আন্দোলনটাকে এক সপ্তাহ টেনে নিয়ে যাওয়া যাবে! সে সব অচিরেই শেষ। দুঃখ হওয়ারই তো কথা। একবার ভাবুন না, আপনার সন্তান বা আত্মীয় ওই করুণাময়ী চত্বরে ইন্টারভিউ দিতে আসছেন। কিন্তু ধরনার কারণে তাঁরা পৌঁছতেই পারলেন না। আপনার কেমন লাগবে একটু জানাবেন?
যাঁরা এই ধরনার কথা বলছেন, তাঁদের মনে করিয়ে দিই কলকাতার বুকে আরও পাঁচ জায়গায় এই ধরনা চলছে প্রায় দেড় বছর যাবৎ। মাঝে মধ্যেই সব চ্যানেলগুলো ধরনার সময়ের কাউন্টিং দেখায়। ৫০১, ৫০২… ৭০০, ৭০১… এদের একজনকেও জোর করে তোলা হয়েছে কি? হয়নি। হলে এতদিন ধরনায় বসলেন কী করে? এঁদের তোলা হল না। তাহলে করুণাময়ীর ধরনাকারীদের কেন তোলা হল ভাববেন না? পর্ষদ সভাপতি পরিষ্কার বলছেন, প্রার্থীদের ইন্টারভিউয়ে বসতেই হবে। তার কারণ, এঁরা কেউই প্যানেলভুক্ত নন। তাই চলতি বছরের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাঁরা যেন শামিল হন। ২০১৬ সালের নিয়োগ নীতি মেনেই নিয়োগ করতে হবে। আজকে যাঁরা নন ইনক্লুডেড ক্যান্ডিডেট তাঁরা পরপর দু’বার ইন্টারভিউ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁরা এমপ্যানেলড হননি। তাই নন ইনক্লুডদের নিয়োগ দেওয়া যাবে না। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরাও চাকরির দাবিদার। ১৬,১০১ জনের প্রশিক্ষণ রয়েছে। ২০১২ সাল থেকে টেট পাশ প্রার্থীদের যদি বয়স থাকে তাহলে তাঁরা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন। ৪০ বছর অতিক্রম করলে সেক্ষেত্রে বয়সসীমায় ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত রাজ্য সরকারের। কারণ, সেক্ষেত্রে আইন পরিবর্তন করতে হবে।
বলা হচ্ছে, কোনও মন্ত্রীর ধরনাকারীদের সঙ্গে কথা বলা উচিত ছিল। কী আশ্চর্য! মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বারবার। আরও অনেকের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কথা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী একবার ডেকে বসেছেন। তাহলে এই আবদার কেন? যাঁদের অঙ্গুলিহেলনে রাস্তায় বসেছিলেন, এটা কি তাঁদের মুখরক্ষার ফর্মুলা?
কেন আন্দোলনের পথে? আদালতের নির্দেশে আইন মেনে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে প্রাথমিক, উচ্চপ্রাথমিক এবং নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণিতে। পোর্টাল খুলে আবেদনপত্র জমা নেওয়া হচ্ছে, পাশাপাশি ইন্টারভিউও শুরু হয়েছে। আদালতের নির্দেশে বাকি প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এরপর সরকারের করণীয় কী? আসন ফাঁকা হলে নিয়ম মেনে এমপ্যানেলড চাকরিপ্রার্থীদের নেওয়া হবে। তাহলে এই প্রক্রিয়াকে শ্লথ করতে বারবার কেন ধরনা? যারা রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে চায় সেই সিপিএম এবং বিজেপি কোনও নোটিশ বেরোলেই চলে যাচ্ছে কোর্টে। তাই যদি হয়, তাহলে করুণাময়ীর ধরনাকারীদের পুলিশ যখন তুলে দিল, তখন আইনত পদক্ষেপ করতে ওইসব বিপ্লবী রাজনৈতিক দলগুলির লিগাল সেল আদালতে গেল না কেন? কে আটকেছিল? কেউ আটকায়নি। আপনারা জানেন, ওই ধরনা বেআইনি। আদালতে টিকবে না। তাই চাকরিপ্রার্থীদের চ্যাংদোলা করে তোলার দৃশ্য সামনে রেখে এক শ্রেণির মিডিয়ার বদান্যতায় ‘আবেগের’ ব্যবসা শুরু করলেন। ব্যবসা চলুক। কিন্তু বাড়ি ফিরে আয়নায় নিজেদের মুখ দেখার সাহস থাকবে তো?
সবশেষে বলি, যাঁরা বিপ্লবে-বিদ্রোহে ফেটে পড়ছেন, মধ্যপ্রদেশের বিজেপি সরকারের ব্যাপম কেলেঙ্কারির কথা জানেন তো? কিংবা উত্তরাখণ্ডের প্রশ্ন ফাঁস কেলেঙ্কারি? ত্রিপুরায় বাম ও বিজেপি আমলে ১০,৩২৩ জন শিক্ষকের চাকরি চলে যাওয়ার কথা ভুলে গিয়েছেন কি? একবার মনে করার চেষ্টা করুন। বাংলার সরকার ভুল সংশোধন করে নিয়মের নিগড়ে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বাঁধতে চাইছে। বিরোধীরা চাইছে অরাজক পরিস্থিতি চলতে থাকুক। নইলে কোন ইস্যুতে রাজনীতি হবে? মৃতদেহ নিয়ে রাজনীতি। দুর্ঘটনা নিয়েও রাজনীতি। রাজনৈতিক কাঙালিপনার একটা সীমা থাকা উচিত। বিরোধীরা সেই সীমা অতিক্রম করে গিয়েছে। কোনও অভিযোগ নয়। যাঁরা যুক্তি দিয়ে পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখেন, তাঁদের কাছে এই ক’টি কথা রইল। বিচারের ভার আপনাদের হাতেই।