‘কোথায় গেলে মারাদোনা’, উৎপল সিনহার কলম

” বাবা তোমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। তোমাদের খেলা দেখছেন। বাবা এখন দ্বাদশ ব‍্যক্তি। মনে রেখো, বাবা সবসময় তোমাদের জয় চাইছেন। উনি কাপ চাইছেন।ওনাকে কাপটা দিও। তোমরা কাপ জিতলে বাবা শান্তি পাবেন। ”

মর্মস্পর্শি এই কথাগুলো মেসির উদ্দেশে এক ভিডিও বার্তায় বলেছেন অকাল প্রয়াত ফুটবল-রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনার মেয়ে আলমা। জানা নেই আলমার অনুরোধ মেসিরা রাখতে পারবেন কিনা। আর্জেন্টিনা দলটা এবার তাদের প্রথম ম‍্যাচেই হেরেছে। কিন্তু এই দল ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বিখ্যাত। বিশ্ব ফুটবল বারবার সেই প্রমাণ পেয়েছে। ১৯৭৮ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে দুর্ধর্ষ নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে ড‍্যানিয়েল পাসারেল্লার নেতৃত্বে প্রথমবার বিশ্বকাপ জেতে আর্জেন্টিনা। বস্তুত তারপরই শুরু হয় মারাদোনা জাদু। মারাদোনার নেতৃত্বে ১৯৮৬ সালে আবার কাপ জেতে আর্জেন্টিনা মারাত্মক শক্তিশালী ত‍ৎকালীন পশ্চিম জার্মানিকে ৩—১ গোলে হারিয়ে। আর্জেন্টিনার হয়ে গোল করেন ব্রাউন, ভালদানো ও বুরুচাগা। জার্মানির গোলদাতারা ছিলেন রুমেনিগে ও ভয়লার।

তারপর ১৯৯০-এর সেই ফাইনাল, যা আর্জেন্টিনার কাছে এক অভিশপ্ত স্মৃতি। বিতর্কিত এই ম‍্যাচে পশ্চিম জার্মানির ব্রেহমের করা পেনাল্টি গোলে স্বপ্নভঙ্গ হয় আর্জেন্টিনার। কান্নায় ভেঙে পড়েন দিয়েগো। কাঁদে সারা বিশ্ব।

ফুটবলে জয়-পরাজয় যে জীবন-মৃত‍্যুর চেয়ে কোনো অংশে কম নয় তা মাত্র ষাট বছরের জীবনে বারবার বুঝিয়ে গেছেন মারাদোনা। এমন বর্ণময় ও বন্দিত চরিত্র বিশ্ব ফুটবলে আর আসেন নি। ‘ এ পৃথিবী একবার পায় তারে, পায়নাকো আর, ‘ বোধহয় দিয়েগোর জন্যেই লিখেছিলেন জীবনানন্দ। গোল করলে এবং ম‍্যাচ জিতলে বুক চাপড়াতেন দিয়েগো, আর হারলে চাপড়াতেন কপাল। তাঁর বুক চাপড়ানো আসলে যে হৃদয় চাপড়ানো সেই বার্তাও সহজেই বুঝতো ফুটবলপ্রেমীরা। তাঁর মুখ কখন অশ্রুঝলোমলো আর কখন বিষাদসিন্ধু তা-ও বোঝা যেত সহজেই। তাই তাঁর অকাল বিদায়ের মহাশোক আজও কাটিয়ে উঠতে পারে নি ফুটবলবিশ্ব। বিশ্বকাপে ছোট অথবা বড়ো সব ম‍্যাচেই সবার চোখ থাকে বলের দিকে । কিছু মন শুধু খুঁজে বেড়ায় মারাদোনাকে। এক বুক হাহাকার নিয়ে রাত জাগে বিশ্ব। কোথায় গেলে মারাদোনা? কেন চলে গেলে এত তাড়াতাড়ি?
বিশ্ব-ফুটবলকে নিঃস্ব করে চলে গেছেন দিয়েগো। ফুটবলপ্রেমীরা হয়ে পড়েছেন যেন চিরনিঃসঙ্গ।

মনে আছে মাদক সেবনের অপরাধে দিয়েগোকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলো ফিফা। কঠোর সেই শাস্তি মেনে নিতে না পেরে ফুঁসে উঠেছিল গোটা বিশ্ব। ফিফার কাছে চিরকালের ‘ ব‍্যাড বয় ‘ দিয়েগোর পক্ষে দাঁড়িয়েছিল কোটি কোটি মানুষ। তখন অনেক আশ্চর্য মন্তব্য পাওয়া গিয়েছিল ফুটবলভক্তদের কাছ থেকে। তার মধ্যে একটি হলো, সামান্য মাদক সেবন ক’রে যদি এমন দৃষ্টিনন্দন ড্রিবলিং করা যায় তাহলে ফিফা এবার ফুটবলে পরিমিত মাদক সেবন চালু করুক। কারণ, ফুটবল তো গুণ্ডা ও মাথামোটাদের দাঙ্গা নয়, জ‍্যামিতির আঁক কষা নয়, একপাল রোবটের যান্ত্রিক ছোটাছুটি নয়। ফুটবল হলো এক অতিবিরল শিল্প, যার পরতে পরতে লুকিয়ে রয়েছে নব নব উদ্ভাবনের বিস্ময়, অপূর্ব সৃজনশীলতা, মুহুর্মুহু আনন্দঘন মুহূর্ত তৈরি, স্বর্গীয় শিল্পসুষমা এবং নব্বই মিনিট ধ’রে অসংখ্য অপূর্ব চমক যা দেখে চোখ ও প্রাণ জুড়োয়। দিয়েগো মারাদোনার খেলায় যা মূর্ত হয়ে উঠতো সেটাই ছিল ফুটবলভক্তদের মনের আনন্দ, প্রাণের আরাম ও আত্মার শান্তি।

এই যে জার্মানি-কোস্টারিকা ম‍্যাচটা পরিচালনা করলেন তিনজন মহিলা রেফারি, এও তো এক বিপ্লব। ‘ মহিলাদের হাঁটু দেখা যাবে না ‘, কাতারের এই মৌলবাদী ফতোয়াকে বুড়ো আঙুল দেখালো ফিফা। ফুটবল হয়ে উঠলো মৌলবাদ ভাঙার অন‍্যতম অস্ত্র। এও কি কম কথা? ফুটবলের এই অন্তহীন ঐশ্বর্য আরও গরিমাময় হয়ে ওঠে মারাদোনার আগমনে। হ’য়ে ওঠে তীব্র আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মারাদোনা কখনোই মিডিয়া ও কর্পোরেট গোষ্ঠীর তৈরি কাগুজে বাঘ নন। ওভাররেটেড নন। আজীবন বামপন্থী বর্ণময় এই বিরল ফুটবলার সম্ভবত ফুটবলবিশ্বের সর্বকালের সেরা বিতর্কিত চরিত্র। বাঁ-পায়ে বিশ্বজয়ী এই মানুষটি একইসঙ্গে প্রতারক, মাদকাসক্ত, বাউণ্ডুলে, উদ্ধত, প্রতিস্পর্ধী, বিদ্রোহী, জাদুকর ও ফুটবলসাধক।

শুধুমাত্র ড্রিবলিং, হেডিং বা পাসিং নয়, সারা শরীর দিয়ে, সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে ফুটবল খেলতেন ফুটবলের অবিসম্বাদিত এই নেতা। পায়ের তো বটেই, শরীরের বিভিন্ন অংশ দিয়ে এমন সুক্ষ টাচ ও পাস আমাদের এই গ্রহে আর কি কখনও দেখা যাবে? দেখা যাবে তেমন অপরূপ বল নিয়ন্ত্রণ? প্রায় একার ক্ষমতায় একটা দেশকে বিশ্বকাপ জেতাচ্ছেন অথবা ফাইনালে তুলছেন একজন ফুটবলার, আর কি কখনও দেখা যাবে?
দর্শকেরা ফুটবল মাঠে সবসময়ই একজন জাদুকর খোঁজেন যিনি অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। যিনি অপূর্ব দৃষ্টিনন্দন খেলার মাধ্যমে আনন্দে পাগল করে দিতে পারেন মানুষকে। এই সবই করে দেখিয়েছেন দিয়েগো। আবার একইসঙ্গে রাষ্ট্রের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন হার না মানা এই স্বাধীনপাখি। আপসহীন প্রেমিক ও প্রতিবাদী এই ‘ আনপ্রেডিক্টেবল ‘ ফুটবলারকে অগ্রাহ্য করার সাহস দেখাতে পারেন নি অবশিষ্ট বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রনায়কও। দর্শকেরা মাঠে এসে হ‍্যামলিনের সেই বাঁশিওয়ালার সন্ধান করতে থাকেন যার সম্মোহনে বিহ্বল ও মোহিত হয়ে পরম পরিতৃপ্ত প্রাণে অন‍্য এক জগতে পৌঁছে যাওয়া যায়। যে জগতে আনন্দ অফুরান।
দিয়েগো চলে গেছেন, কিন্তু রেখে গেছেন এক নিজস্ব পৃথিবী। দিয়েগোর গড়া সেই পৃথিবীতে একরাশ আশ্চর্য আনন্দ নিয়ে আজও বসবাস করেন বিশ্বের কোটি কোটি ফুটবলভক্ত।

কাতারে এখন চলছে বিশ্বকাপ ২০২২-এর কোয়ার্টার ফাইনাল পর্ব।
এখানে রইলো শেষ ষোলোর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ফলাফল :
নেদারল্যান্ডস ৩—০ ইউএসএ
আর্জেন্টিনা ২—১ অস্ট্রেলিয়া
ফ্রান্স ৩ — ১ পোল‍্যান্ড
ইংল‍্যান্ড ৩ — ০ সেনেগাল
মরোক্কো ৩ — ০ স্পেন ( টাইব্রেকার )
ব্রাজিল ৪ — ১ সাউথ কোরিয়া
পর্তুগাল ৬ — ১ সুইজারল্যান্ড

আরও পড়ুন- বিজেপি এভাবে আমায় ভাঙতে পারবে না আরও শক্ত করবে: সাকেত গোখলে

Previous article‘পুরুষ কথা’ এবং ‘INDIA’S SONS’ কে একসূত্রে গাঁথলো অভিযান ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড চ্যারিটেবল ট্রাস্ট
Next articleবিশ্বকাপে বিদায় ইংল‍্যান্ডের, কোয়ার্টার ফাইনালে ইংল‍্যান্ডকে ২-১ গোলে হারিয়ে সেমিফাইনালে ফ্রান্স