কারা জাগবে ‘ স্বপ্ন বাসর ‘? কাদের ভাঙবে বুক? শিকে ছিঁড়বে কাদের ভাগ্যে? কাদের পুড়বে কপাল, তীরে এসেও ডুববে তরী? কারা আসবে আলোর বৃত্তে, কারা মিশে যেতে চাইবে অনন্ত আঁধারে? কারা নাচবে, গাইবে, ফেটে পড়বে সমবেত আনন্দ-উল্লাসে? কারা ভেঙে পড়বে কান্নায়, কারা স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণায় একরাশ বিষন্নতা নিয়ে নীরবতার হাত ধরে মাথা নিচু করে ধরবে দেশে ফেরার উড়ান? কপাল মন্দ কার? কার চিচিং ফাঁক?
যদিও একমাঘে যায় না শীত আর খেলায় থাকে হার-জিত, তবুও সব হার বা সব জয়ের চরিত্র এক নয়। ধারে ও ভারে আলাদা। হার সবসময়ই যন্ত্রণাদায়ক। যে কোনো পরাজয় ভুলতে সময় লাগে।
কিন্তু বিশ্বকাপ ফাইনালে হার? এর মতো গুরুতর পীড়াদায়ক হার অন্য কোনো পরাজয়ের সঙ্গে তুলনীয় নয়। এতবড়ো মঞ্চে পরাজয়ের ঘা কোনোদিনই শুকোয় না। চিরস্থায়ী যন্ত্রণার মতো দপদপ করতে থাকে বুকের গভীরে আমরণ।
আসলে বিশ্বকাপ ফুটবলের ফাইনালে উঠতে হলে ভয়ঙ্কর সব বাধার পাহাড় অতিক্রম করতে হয়। একের পর এক কঠিন প্রতিপক্ষকে প্রাণপণ লড়াইয়ে ধরাশায়ী করতে করতে এগোতে হয় স্বপ্নের ফাইনালের দিকে। প্রতিপক্ষের তীক্ষ্ম অস্ত্রে রক্তাক্ত ও ক্ষতবিক্ষত হয়েও শুধুমাত্র জয়মাল্য গলায় প’রে পরবর্তী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিতে হয়। ফাইনালে পৌঁছোতে গিয়ে প্রাণশক্তির শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত নিংড়ে দিতে হয় ফুটবলারদের। সেইসঙ্গে চূড়ান্ত মানসিক ধকলে বিধ্বস্ত খেলোয়াড়েরা পেণ্ডুলামের মতো দুলতে দুলতে সব পেয়েছির দেশে পৌঁছনোর দুর্মর আশায় একটা দারুণ ঘোরের মধ্যে দিয়ে এগোতে থাকে। প্রায় নিঃশেষ জীবনীশক্তির অবশিষ্টাংশ সম্বল ক’রে নেমে পড়ে ফাইনাল ম্যাচে। সেখানে কেউ হারতে চায় না। কিন্তু ফুটবলের অমোঘ নিয়মে একটা দলকে তো হারতেই হয় । যে দল অর্থাৎ যে দেশ হারে তারা বেদনার অথৈ অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। প্রবেশ করতে চায় বিষন্নতার কৃষ্ণগহ্বরে। খেলোয়াড়দের সঙ্গে সমর্থকদের হৃদয়েও নেমে আসে সান্ত্বনাহীন নিকষ অন্ধকার। বিশ্বকাপের ফাইনালে পরাজয়ের গ্লানির আঁধার থেকে ফেরার পথ খুঁজে পাওয়া সত্যিই দুষ্কর।
দীর্ঘ চার বছর ধরে পরম যত্নে লালিত স্বপ্ন যখন মাত্র নব্বই মিনিটের ( বড় জোর একশো কুড়ি মিনিটের ) যুদ্ধে ভেঙে চুরমার হয়ে যায় তখন সেই স্বপ্নভঙ্গের ভয়াবহ যন্ত্রণা মৃত্যুযন্ত্রণারও অধিক। অবর্ণনীয় সেই শোকের অভিঘাত।
আর যারা জেতে? যারা শেষপর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয়? বিশ্বজয়ীর শিরোপা মাথায় যারা হাসতে হাসতে মাঠ ছাড়ে মাথা উঁচু ক’রে? তারা দেশে দেশে নন্দিত হয়। স্বপ্নপূরণের আনন্দও বর্ণনাতীত। চার বছর তারা বসে থাকে সব পেয়েছির দেশের রাজসিংহাসনে বিশ্ববিজয়ীর মুকুট মাথায়।
শরীরের ঘাম, রক্ত, অশ্রু ও জীবনীশক্তির শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত মাঠের সবুজ ঘাসের গালিচায় নিঃশেষে নিংড়ে দেওয়ার পুরস্কার পেয়ে তারা ধন্য হয়, গর্বিত হয়। এই গরিমায় পৌঁছনোর জন্যই তো তাদের এত ত্যাগ, এত তিতিক্ষা, এত কৃচ্ছসাধন।
সাফল্য এমনই এক অবস্থা, এমনই এক অনুভব যা ব্যক্তি মানুষকে যেমন ঠিক তেমনই একটি দল অথবা দেশকেও একেবারে ভেতর থেকে বদলে দেয়। এনে দেয় চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস এবং অধিষ্ঠিত করে বিশেষ এক মর্যাদার আসনে। সাফল্যের পথ যতটা কণ্টকাকীর্ণ ও দুর্গম, সাফল্য প্রাপ্তির পরবর্তী পথ ততটাই কুসুমাস্তীর্ণ ও আনন্দময়। বিশ্বজয়ীরা সর্বকালেই সর্বত্র পুজ্যতে। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন দেশের সমর্থকেরা চার বছর ধরে ভাসতে থাকেন আনন্দসাগরে। এর সঙ্গে যোগ হয় শিরোপা ধরে রাখার স্বপ্ন।
আজ বিশ্বকাপের ফাইনাল।
আজ কাতারে কাপ কার?
ফ্রান্সের নাকি আর্জেন্টিনার? বিশ্বকাপের ফাইনালে হার! এর চেয়ে বড়ো ম্যাসাকার
কী-ই বা হতে পারে আর?
এমব্যাপের ফ্রান্স আজ বিশ্বকাপ-ফাইনাল খেলবে মেসির আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে। দুই দলই সমান শক্তিশালী। কেউ কারোর চেয়ে কম নয়। দুই দলই পরস্পরের শক্তি ও দুর্বলতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। লড়াই হবে আজ সমানে সমানে। ফ্রান্স গতবারের চ্যাম্পিয়ন। তারা কি এবারও পারবে শিরোপা ধরে রাখতে? পক্ষান্তরে আর্জেন্টিনা তাদের হৃতসম্মান পুনরুদ্ধার করতে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপাবে। তারা দেখতে চাইবে মেসির হাতে বিশ্বকাপ।
গোটা বিশ্বজুড়ে মেসি নামক ফুটবল জাদুকরের শেষ স্বপ্ন পূরণের সঙ্গী হতে চান কোটি কোটি ফুটবলভক্ত। আজ অবিস্মরণীয় এক ম্যাচের সাক্ষী থাকতে চায় পৃথিবী। একদিকে শিল্পময় ল্যাটিন আমেরিকার ফুটবল ঘরানা। অন্যদিকে দারুণ কৌশলী ইউরোপীয় ঘরানা। কারা জিতবে?
ফান্স অথবা আর্জেন্টিনা যারাই জিতুক না কেন ফুটবল যেন উৎকর্ষতার চরম শিখর ছুঁতে পারে আজ। সর্বোচ্চ উচ্চতায়, সর্বোচ্চ মান-এ পৌঁছে যাক আজকের ফাইনাল খেলা। ফুটবল আজ গান হয়ে উঠুক, হয়ে উঠুক এক টুকরো কবিতা। ফুটবল শিল্পীদের রংতুলির সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম আঁচড়ে প্রকৃত অর্থেই আজ নক্সিকাঁথার অপরূপ বুনন হয়ে উঠুক মাঠের বিস্তীর্ণ সবুজ গালিচা। দুলে উঠুক ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়। নয়নাভিরাম ফুটবলে জুড়িয়ে যাক চোখ ও মন। জয় হোক ফুটবলের।
আরও পড়ুন- আগামিকাল বিশ্বকাপ ফাইনাল, ফ্রান্সের জয়ের প্রার্থনায় সাজছে চন্দননগর