অবশেষে কাতারে মেসির হাতে বিশ্বকাপ। একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ। সব পেয়েও শুধুমাত্র বিশ্বকাপ না পেয়ে ট্রাজিক হিরো হয়ে বাকি জীবন বেঁচে থাকার ভয়াবহ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেন ফুটবল জাদুকর মেসি। এটা তাঁর প্রাপ্য ছিল অবশ্যই। বিশ্বকাপ বুকে জড়িয়ে হাসিমুখে মঞ্চ আলো করার ক্ষেত্রে মেসির চেয়ে যোগ্য এই মুহূর্তে আর কে-ই বা ছিলেন? রোনাল্ডো খুব কাছাকাছি থাকবেন মেসির। অল্পবয়সী এমবাপে একবার বিশ্বকাপ ছুঁয়েছেন। এবার নিজে হ্যাটট্রিক করেও ফ্রান্সকে ট্রফি দিতে পারলেন না। তিনিই এবারের ট্রাজিক হিরো। তবে তাঁর হাতে এখনো প্রচুর সময়। তিনি এখন মাত্র তেইশ। অবিস্মরণীয় ফুটবলার।

এবার ফাইনালে আমরা কী দেখলাম? প্রথমার্ধে আর্জেন্টিনা এতটাই আধিপত্য নিয়ে খেলছিল যে প্রায় সবাই ধরে নিয়েছিলেন বেশ ভালো ব্যবধানে হারতে চলেছে ফ্রান্স। মেসি খেলছিলেন জাদুকরের মতোই। গোল তো করলেনই। একটাও ভুল পাস নেই। পাসগুলো যেমন নিখুঁত তেমনি দৃষ্টিনন্দন। জায়গা নেওয়া ও ফাঁকা জায়গা তৈরি করার অনন্য কৌশলে মুগ্ধ করছিলেন সবাইকে। অপূর্ব মনোহরন ড্রিবলিং। তাঁর বাঁ পায়ের ভেল্কি ও কোমরের দোলা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছিল ফ্রান্স। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধে খেলাটা সম্পূর্ণ পাল্টে গেল। তখন বোঝা গেল আমরা বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখছি। আহা, কী অসাধারণ ঘাত-প্রতিঘাত! যেন অ্যালফ্রেড হিচককের কোনো শ্বাসরোধী থ্রিলার চলছে! মেসিদের তিন গোল শোধ করে দিয়ে খেলাটাকে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ ক’রে দিল ফ্রান্স। এমবাপে একাই একশো হয়ে উঠলেন। তারপর সবশেষে টাইব্রেকার এবং মেসিদের বাজিমাত। কাতার নাম্নী বোধিবৃক্ষতলে ফুটবল-সাধক লিয়োনেল মেসির সিদ্ধিলাভ।

মেসি কি সর্বকালের সেরা ফুটবলার? এর উত্তর তর্কসাপেক্ষ। সর্বকালের সেরা নিয়ে কখনোই কোনো স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় না। এ নিয়ে স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত প্রায় অসম্ভব। পেলে, মারাদোনা, ক্রুয়েফ, রোনাল্ডো কিংবা মেসি, সর্বকালের সেরা কে?

গবেষণার বিষয়। আসলে এঁরা প্রত্যেকেই তাঁদের নিজের নিজের যুগের সেরা। কারণ ফুটবল খেলাটা এগোয় বদলাতে বদলাতে। পাল্টাতে পাল্টাতে। খেলাটার নানা নিয়ম বদলাতে থাকে নিয়মিত । নিয়মের পরিবর্তন ঘটাতে হয় খেলাটাকে আরও উত্তেজক ও নান্দনিক ক’রে তোলার প্রয়োজনে। ফুটবলের সর্বোচ্চ নিয়ামক সংস্থা ফিফা এ ব্যাপারে সদাসতর্ক থাকে। পেলের যুগে অফসাইড সংক্রান্ত যে নিয়ম ছিল তা কি এখনও আছে? পেনাল্টি বক্সের বাইরে গোলকিপার এখন কি আর হাত দিয়ে বল ছুঁতে পারেন? খেলার নিয়মকানুন মাঝে মধ্যেই বদলাতে থাকে। বদলে গেছে অফসাইড, ফাউল, ফ্রি-কিক, পেনাল্টি ও থ্রো-ইন সংক্রান্ত নানা নিয়ম। দিনে দিনে আরও বদলাবে। ফুটবল ব্যাকরণ কোনোকালেই সম্পূর্ণ হবে না। আগে কি ফুটবলে প্রযুক্তির সুবিধা নেওয়া হতো? কিন্তু এখন তো নেওয়া হচ্ছে। তাই সর্বকালের সেরা নির্ধারণ করা ভীষণ কঠিন, প্রায় অসম্ভব।


মেসিকে এত পছন্দ করেন কেন ফুটবলপ্রমীরা? কারণ মানুষ শেষপর্যন্ত ব্যক্তিগত নৈপুণ্য, ব্যক্তিগত দক্ষতা ও ব্যক্তিপ্রতিভার পূজারী। যতই সাম্যের কথা বলা হোক না কেন মানুষ শেষপর্যন্ত ব্যক্তিপূজার অনুসারী। সমষ্টিকে নায়ক মানতে নারাজ মানুষ। তাদের ব্যক্তিনায়ক চাই, নেতা চাই, জনগণমনঅধিনায়ক চাই। এমনকি একনায়ক হলেও তাঁদের আপত্তি নেই। দেশে দেশে কালে কালে ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যায় ব্যক্তিপূজা সর্বকালীন সর্বক্ষেত্রেই। তাহলে ফুটবল তার বাইরে যাবে কী করে? তাই প্রশ্ন উঠবেই মেসি কি সর্বকালের সেরা? এই প্রশ্নে তুমুল তর্কাতর্কি হবে কিন্তু উত্তর পাওয়া যাবে না। মেসিকে ফুটবলভক্তদের এতো পছন্দের একমাত্র কারণ মেসি ফুটবল মাঠে বারবার অসম্ভবকে সম্ভব ক’রে দেখিয়েছেন তাঁর ব্যক্তিগত দক্ষতায়।

এবার একটু নজর দেওয়া যাক মেসিকে নিয়ে বিশ্বখ্যাতদের করা কিছু বিরল মন্তব্যে।
পেলে : একই লেভেলে বছরের পর বছর ধ’রে খেলে চলেছে মেসি। ওকে কখনও খারাপ খেলতে দেখি নি।
ক্রুয়েফ : দশে দশ দেবো। অনন্য ক্লাস। জাত খেলোয়াড়।
বেকেনবাউয়ার : মেসি ঈশ্বরের মতো। ওর সব আছে।
মারাদোনা : আমার জায়গাটা নেবে ও-ই।
গুয়ার্দিওলা : মেসিকে ব্যাখ্যা না ক’রে স্রেফ দেখে যান। কোনো সিস্টেম বা কোচ ওকে থামাতে পারে না।
রাইকার্ড : মেসির খেলাটা, বিশেষ ক’রে গোলগুলো শিল্পকলা।
তোস্তাও : মেসি মারাদোনার চেয়েও ভালো। বাস্তব ও অবাস্তবে মেশা ফুটবল খেলে।
বড় রোনাল্ডো : তীক্ষ্ম ও সম্পূর্ণ।
ফিগো : মেসিকে দেখা মানে অর্গ্যাজমের পরের অবিশ্বাস্য তৃপ্তি।
ইনিয়েস্তা : মেসি যা পারে, অন্যেরা শতচেষ্টাতেও পারে না।
রোনাল্ডিনহো : আমি একবার বিশ্বসেরা হয়েছিলাম। কিন্তু তখন বার্সেলোনাতেই সেরা ছিলাম না।
ইব্রাহিমোভিচ : মেসির ডান পায়ের দরকার নেই। বাঁ পা-টাই যথেষ্ট।
অঁরি : মেসির খেলার এক মুহূর্তও মিস করতে চাই না।
নেইমার : মেসিই আসল লোক। আর কী বলবো?
গুলিট : ওকে দেখছি। আমরা ভাগ্যবান।
রুমেনিগে : ওর চেয়ে ভালো আর কেউ ছিল না।
রোমারিও : প্রতিদিন মেসি নিজেকে ছাপিয়ে যায় নিউটন ও আইনস্টাইনের মতো।
হাজি : এত বিনীত ও ভদ্র অথচ মাঠে আগুন!
স্টোইচকোভ : মেসিকে থামাতে দরকার মেশিনগান।
লিনেকার : ও এমন ফুটবল খেলে যা দেখতে আমরা অভ্যস্ত নই।
বেকহ্যাম : ওর ধারেকাছে কেউ নেই।
ভালদানো : প্রকৃত জিনিয়াস।
ফার্গুসন : সর্বকালের অন্যতম সেরা।
বিলার্দো : অ্যানাটমির কোনো তত্ত্বই মানে না মেসি।
ওয়েঙ্গার : অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে।
আর্দিলেস : এই গ্রহের বাইরের ফুটবলার।
ফালকাও : মেসি কি সত্যিই ফুটবলার? না প্লে-স্টেশন, ক্যারেকটার?
রুনি : মেসি একটা রসিকতা। সর্বকালের সেরা।
তেরেস : মেসিকে যারা পছন্দ করে না তারা ফুটবল বোঝে না।

আরও পড়ুন- ঋণ জালিয়াতি-কাণ্ড: সোমবার পর্যন্ত CBI হেফাজতে ICICI ব্যাঙ্কের প্রাক্তন CEO ও তাঁর স্বামী