‘ফতোয়ার যাঁতাকল’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

তুমি কী খাবে আর কী পরবে
কি করবে না আর কি করবে
সেটা ঠিক ক’রে দেবে কে ?
ভূতুড়ে মুখোশ পরা কারা যেন দলে দলে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ।
তুমি কোন সুরে গাইবে গান
কোন তালে বাঁধবে প্রাণ
সেটা তোমার হাতে নেই আর
হায় তোমার যে দিন গিয়েছে !

নীতিপুলিশ বাহিনী নাকি তুলে নিচ্ছে তেহরান ? সত্যি ? এ তো দারুণ এক খবর !
আজ্ঞে না । এটা সম্পূর্ণ ভুল খবর । বরং প্রকৃত ছবিটা যথেষ্ট ভয়াবহ । মাশা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে হিজাব বিরোধী বিক্ষোভ ও আন্দোলনে শত শত প্রাণ বলিদান দুনিয়ার দেশে দেশে প্রতিবাদের প্রেরণা জোগাচ্ছে ঠিকই , কিন্তু সার্বিক সাফল্য এখনও বহু যোজন দূরে ।
আর আমাদের দেশে ?

সত্য সেলুকাস , কি বিচিত্র এই দেশ ! এদেশে এখন হিজাব পরার ধর্মীয় অধিকার নিয়ে আন্দোলন হচ্ছে । অনেক নারী এমনও ভাবেন যে হিজাব নিকাব প’রে তাঁরা পরম ঐশ্বরিক কর্ম করছেন ! তাঁরা জানেনও না যে মৌলবাদী ফতোয়ার কারণেই তাঁদের জীবনে এতো বাধাবিপত্তি । জানেন না যে ধর্মীয় পাষণ্ডরা বড়ো নিরাপদে থাকে নারীরা হারেমে বন্দী থাকলে ।

দেশে দেশে কালে কালে নারীদের তীব্র প্রশ্নবাণে বিদ্ধ হয়েছেন দার্শনিক , সমাজতাত্ত্বিক ও রাষ্ট্রনায়কবৃন্দ । নারী তার অধিকার বুঝে নিতে চায় । কিন্তু আজও তেমন কিছুই বদলায় নি । এই মুহূর্তে ইরানের বাস্তব ছবিটি তো ভয়ংকর !

নীতিপুলিশ বাহিনী ও প্রশাসন প্রতিবাদীদের গুলি করে মারছে । ফাঁসিতে ঝোলাচ্ছে । চালাচ্ছে তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন । এমনকি মেয়েদের যৌনাঙ্গ লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে ! বর্বর প্রশাসনের নৃশংসতা পাশবিকতাকেও লজ্জা দেবে ।

‘ ফতোয়া খতরে মে ‘ ! তার মানে পিতৃতান্ত্রিক একটা স্থায়ী ব্যবস্থা প্রশ্নের মুখে । ধর্ম প্রশ্নের মুখে । দমনপীড়ন না চললে , গুলি না চললে , মৃত্যুদণ্ড না দিলে তো আন্দোলন উত্তরোত্তর বাড়তে থাকবে । দিকে দিকে সংহত ও সংক্রামিত হতে থাকবে । বিপদের মুখে পড়বে মৌলবাদ । এ কি হতে দেওয়া যায় ?

এটা করো ওটা কোরো না
এটা পরো ওটা প’রো না
এটা খাও ওটা খেয়ো না
থেমে থাকো আগে যেও না
এতদিন প্রাণভরে বেঁচেছিলে
যেটা ক’রে , এখন আর
সেটা কোরো না ।
যদি মানো আমরা যা চাই
তাহলে তো কোনো ভয় নাই
অবাধ্য যদি তুমি হও
বাঁচবার যোগ্যই নও ।

এতসবের পরেও আশার কথা এই যে , প্রশ্ন , প্রতিবাদ ও স্বপ্ন অবিনশ্বর । মৌলবাদ কেন , কোনো শক্তিরই রেহাই নেই বিপরীত প্রতিক্রিয়া থেকে । হাজার বছর ধরে চলে আসা সতীদাহ প্রথাকেও তো শেষপর্যন্ত মাথা নোয়াতে হয়েছিল রাজা রামমোহন রায়ের দুর্জয় সত্ত্বার কাছে । ফতোয়া পরাজিত হয় নি কি ? ইরানের মতো ধর্মীয় ফতোয়ায় আপাদমস্তক মোড়া একটা দেশে প্রচণ্ড শক্তিশালী মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নারীশক্তি , এর চেয়ে রোমাঞ্চকর সংবাদ এই মুহূর্তে আর কীইবা হতে পারতো ! এখন পাথর নড়ছে । আর বেশিদিন নয় । পাহাড় ভেঙে ইরানের নারীদের জয় এখন শুধুই সময়ের অপেক্ষা ।

গোটা বিশ্ব আলোড়িত হচ্ছে , মুগ্ধ বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখে দেখছে ইরানের মেয়েদের মরণপণ লড়াই । কোনঠাসা প্রান্তিক শক্তিগুলো উজ্জীবিত হচ্ছে দিকে দিকে । এক চরম লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে জগতের নিপীড়িত ও বঞ্চিত শ্রেণী । ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার এই লড়াই না থাকলে সভ্যতা এগোবে কী ক’রে ?
‘ ও মেয়ে শোনো ‘ কবিতাটিতে তসলিমা কী লিখছেন দেখা যাক :
তোমাকে বলেছে — আস্তে ,
বলেছে — ধীরে ,
বলেছে — কথা না ,
বলেছে — চুপ ।
বলেছে — বসে থাকো ,
বলেছে — মাথা নোয়াও ,
বলেছে — কাঁদো ।

তুমি কি করবে জানো ?
তুমি এখন উঠে দাঁড়াবে
পিঠটা টানটান করে ,
মাথাটা উঁচু করে দাঁড়াবে ,
তুমি কথা বলবে ,
অনর্গল বলবে ,
যা ইচ্ছে তাই বলবে ,
জোরে বলবে ,
চিৎকার করে বলবে ,
এমন চিৎকার করবে
যেন ওরা দুহাতে ওদের
কান চেপে রাখে । …

আরও পড়ুন- ‘বিশ্বাসঘাতক’ বিজেপির বিরুদ্ধে এবার সর্বাত্মক আন্দোলনের ডাক দিল নন্দীগ্রাম

Previous articleEntertainment : দক্ষিণী ছবিতে ‘মহাপ্রভু’ যিশু, পৌরাণিক লুকে বাজিমাত টলি অভিনেতার ! 
Next article‘ব্যতিক্রমী’ বিয়ে