‘উনিশের শহীদেরা’, উৎপল সিনহার কলম

উৎপল সিনহা

গলা মিলিয়ে গেয়েছি গান —
‘ মা আমার বন্দিনী ‘ ।
ভুলে যাই নি । ভুলে যাবো না
জীবনে কোনদিনই ।।

কিন্তু হায় , আমরা প্রায় ভুলেই গেছি । আমরা কথা রাখি নি ।
ভুলে গেছি শিলচরের রক্তাক্ত ১৯-শে মে । শহীদদের রক্তে রাঙা উনিশে মে ।
মনে রেখেছি সদ্য অতিক্রান্ত রক্তে ভেজা একুশে ফেব্রুয়ারি । কারণ , ভোলা যায় না এই
অবিস্মরণীয় দিনটি । কিন্তু একই কারণে ১৯-শে মে দিনটি কি অবিস্মরণীয় নয় ?
তাহলে ভুলে যাওয়া কেন ?

ইতিহাস যখন কোনো এক বিশেষ ঘটনার প্রতি সপ্রশংস আলোকপাত করে তখন আশ্চর্যরূপে সমগুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ আরেকটি ঘটনা সম্পর্কে কেমন যেন উদাসীন থাকে । ইতিহাসের বিচার বড়ো নির্মম । ইতিহাসের সত্য ও অর্ধসত্য নিয়ে বিতর্কের অন্ত নেই । এর সমাধান সময়ের হাতে । কিন্তু ইতিহাস যদি কোনো বিশেষ ঘটনাকে উপেক্ষা করে তখন ধীরে ধীরে ধুলোর আস্তরণ পড়তে থাকে উপেক্ষিত সেই বিশেষ অধ্যায়ে । ক্রমশ বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকে ইতিহাসের সেই দুয়োরানি । অথচ সম্মান ও মর্যাদায় দুটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলকের একই পংক্তিতে থাকার কথা ছিল ।
কী হয়েছিল উনিশে মে ?
আসুন , তার আগে জেনে নেওয়া যাক কে কানাইলাল নিয়োগী , কে চণ্ডীচরণ সূত্রধর আর হিতেশ বিশ্বাস-ই বা কে !
সত্যেন্দ্র কুমার দেব , কুমুদ রঞ্জন দাস , সুনীল সরকার , তরণী দেবনাথ , শচীন্দ্র চন্দ্র পাল , বীরেন সূত্রধর , সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য — এঁরাই বা কারা ?

এঁরা সকলেই ভাষাশহীদ । রফিক , জব্বার , বরকতের মতোই মাতৃভাষা রক্ষার লড়াইয়ে এঁরা সকলেই প্রাণ দিয়েছেন । আরও আছেন ভাষাশহীদ । এঁরা হলেন বিজন চক্রবর্তী , জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস ।

অসমের বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন ছিল তৎকালীন আসাম সরকারের অসমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ , যেহেতু ওই অঞ্চলের জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ছিল বাংলাভাষী । এই গণআন্দোলনের প্রধান উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৯৬১ সালের ১৯-শে মে । সেদিন ১১ জন প্রতিবাদী ভাষাপ্রেমীকে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে আসাম প্রাদেশিক পুলিশ গুলি ক’রে হত্যা করে ।

বরাক উপত্যকার বাঙালিদের ওপর বলপূর্বক অসমীয়া ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ১৯৬১ সালে কাছাড় গণসংগ্রাম পরিষদ নামে একটি সংগঠনের জন্ম হয় । অসম সরকারের এই অন্যায় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ১৪ এপ্রিল তারিখে শিলচর , করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে সংকল্প দিবস পালিত হয় ।বরাক উপত্যকায় হয় ভাষা রক্ষার পদযাত্রা । ১৯ মে শিলচর-সহ আসামের বিভিন্ন স্থানে শুরু হয় হরতাল ও পিকেটিং । শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে শুরু হয় সত্যাগ্রহ আন্দোলন । শান্তিপূর্ণ এই হরতাল জোর করে দমন করতে বিকেলে উপস্থিত হয় অসম রাইফেলস । শুরু করে দমনপীড়ন ও গ্রেপ্তার । আগুন জ্বলে ওঠে । লাঠি ও বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারা হতে থাকে আন্দোলনকারীদের । শেষে সাত মিনিটের মধ্যে ১৭ রাউন্ড গুলি চালানো হয় প্রতিবাদীদের লক্ষ্য করে । মোট ১১ জন মারা যান সেদিন । ২০ মে শিলচরের জনগণ শহীদদের শবদেহ নিয়ে শোকমিছিল সংগঠিত করেন ।

এই ঘটনার পর অসম সরকার বরাক উপত্যকায় বাংলাকে সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করতে বাধ্য হয় । শহীদের রক্ত হয় নি ব্যর্থ । কিন্তু রক্তের মূল্যে , প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত এই অধিকারকে কতটুকু মূল্য দিয়েছি আমরা ? কতটুকু স্বীকৃতি ? দিতে পেরেছি কি এর প্রাপ্য মর্যাদা ? শহীদবৃন্দ ও তাঁদের পরিবারগুলিকে প্রাপ্য সম্মান আমরা দিতে পেরেছি কি ?

আরও পড়ুন- ঘন কুয়াশায় বিপত্তি! কুলপিতে হুগলি নদীতে ডুবছে বাংলাদেশী বার্জ

আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদদের কেউ তেমন মনে রাখে নি । বাংলা ভাষা রক্ষার জন্যই প্রতিবাদ , প্রতিরোধ , জমায়েত , আত্মবলিদান , তবু ১৯ মে ১৯৬১ কেন যে একুশে ফেব্রুয়ারির মতো চিহ্নিত , স্বীকৃত ও সম্মানিত নয় , কেন আপামর বাঙালির স্মরণ , মনন ও চিন্তনে তেমন সাড়া জাগায় না বাংলা ভাষার জন্যই এই মহান আত্মত্যাগ , তা বড়োই বেদনাদায়ক ।

এই অবজ্ঞা , এই উপেক্ষাই কি প্রাপ্য শহীদদের ? জাতি হিসেবে বাঙালি যদি আত্মবিস্মৃতই হয় তাহলে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটি মনে রাখে কেন , ঘটা করে পালনই বা করে কেন ? এটা কি দ্বিচারিতা নয় ? বাঙালির বৃহত্তর অংশের ভণ্ডামি নয় ?

বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনে নিহত মানুষেরা কি বাংলা ভাষার জন্যই প্রাণ বিসর্জন দেন নি ? তাঁরা কি বাঙালি ছিলেন না ?

পাশাপাশি লক্ষ্য করে দেখার বিষয় এই যে , শহুরে শিক্ষিত বাঙালির নিজেদের মাতৃভাষা নিয়ে এখন যে হীনম্মন্যতাবোধ দেখা যাচ্ছে তার চেয়ে লজ্জাজনক উদাহরণ ভাষা-পৃথিবীতে আর নেই । আসলে কলকাতা বা ঢাকার বাঙালিদের ইংরেজি ও হিন্দি ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার মুরোদ নেই । এঁরা ইউরোপপন্থী বাংলা প্রসার আন্দোলন ও আগ্ৰাসী হিন্দি ও ইংরেজি সাম্রাজ্যবাদের দোসর । এপার বাংলায় যাঁরা ভদ্রলোক ও বুদ্ধিজীবী তাঁরা বেশ ভালো বোঝেন শাসকের ভাষা । আগে ফরাসি , পরে ইংরেজি ও এখন হিন্দিপ্রেম , তাই বাংলাভাষার প্রতি এঁদের কোনো দায় নেই । ঔপনিবেশিকতার উচ্ছিষ্ট ভক্ষণে এঁরা সারাক্ষণ ব্যস্ত ও রীতিমতো পরিতৃপ্ত । এঁদের চিন্তা চেতনা আচ্ছন্ন করে রয়েছে ঔপনিবেশিকতার মৃতবৎ অবশেষ ।
তবে হ্যাঁ , আশার কথা এই যে এঁদের সঙ্গে বৃহত্তর গ্রামবাংলার কোনো সম্পর্ক নেই । ছিলোও না কোনোদিন । আবহমান বাংলার মাটি ও জল থেকে কখনও বিচ্ছিন্ন হবে না গ্রামবাংলার মানুষ । তাঁদের মুখে মুখে বেঁচে থাকবে বাংলা ভাষা । বেঁচে থাকবে বাংলা গান , বাংলা ছড়া ও কবিতা , লোকগীতি , পল্লিগীতি , মঙ্গলকাব্য , আর অপার সৌন্দর্যে ভরা রূপসী বাংলার মাটি ও মানুষের পরাণকথা ।

বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদদের উপেক্ষা তথা বিস্মরণ একটা নির্দিষ্ট সময়ের , একটা নির্দিষ্ট কালের অধঃপতনের চিহ্নমাত্র । শহুরে জগাখিচুড়ি বাঙালি সংস্কৃতির সার্বিক অবক্ষয়ের দহনকাল একদিন অবশ্যই সমাপ্ত হবে । এখন হয়তো আরও পঞ্চাশ বছর ধরে মনে হবে বাংলা ভাষার জন্য‌‌‌ প্রাণ দিয়ে অপরাধ করেছিলেন বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদবৃন্দ । তারপর একদিন বিস্মরণের ধুলোর আস্তরণ সরিয়ে এপার বাংলার ভাষা শহীদদের প্রকৃত সম্মান জানাবেন গ্ৰামবাংলার সরলসাদা খেটে খাওয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণ।
সেদিন সব অবজ্ঞা , সব উপেক্ষা , সব বঞ্চনা ও অবহেলার অবসান হবে ।

এপার বাংলার ভাষা শহীদেরা ফুলে ও মালায় সজ্জিত হয়ে বীরের সম্মানে অলংকৃত হয়ে হাসিমুখে এসে দাঁড়াবেন লাখো মানুষের হৃদয়ের আলোয় উদ্ভাসিত রূপসী বাংলার সুনীল আকাশের তলায় ১৯-শে মে-র অবিস্মরণীয় গৌরবগাথা বুকে জড়িয়ে । সেলাম জানাবে মহাকাল ।

আরও পড়ুন- রাস্তায় জঞ্জাল ছুড়লেই মোটা অঙ্কের জরিমানা! বড় সিদ্ধান্ত কলকাতা পুরসভার

Previous articleBreakfast news : ব্রেকফাস্ট নিউজ
Next articleBreakfast Sports: ব্রেকফাস্ট স্পোর্টস